Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Science News

হকিংয়ের সন্দেহ কি অমূলকই? তার কোনও চুল নেই! জানাল ব্ল্যাক হোল

তাই চাল-চুলো আলাদা হলেও, চুলের বিচারে একটা ব্ল্যাক হোল থেকে অন্যটাকে আলাদা করে চিনে নেওয়ার কোনও উপায়ই নেই আমাদের হাতে। তারা সবাই গিলে খাচ্ছে, নাগালে যা পাচ্ছে, তার সব কিছু। গিলে খাচ্ছে আলো। তারাদের। গিলে নিচ্ছে যাবতীয় তথ্যাদি (ইনফরমেশন্‌স)-ও।

‘এম-৮৭’। প্রথম যে ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে।

‘এম-৮৭’। প্রথম যে ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে।

সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৫:২৯
Share: Save:

আমার মস্ত টাক। আপনার মাথাভর্তি চুল। চুল দিয়ে যায় চেনা। আমার থেকে আলাদাও করা যায়।

কিন্তু এই ব্রহ্মাণ্ডের বিদঘুটে, কিম্ভূত ‘রাক্ষস’গুলির মাথায় চুল নেই একটাও! মস্ত ‘টাক’ থাকে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের। তাই চাল-চুলো আলাদা হলেও, চুলের বিচারে একটা ব্ল্যাক হোল থেকে অন্যটাকে আলাদা করে চিনে নেওয়ার কোনও উপায়ই নেই আমাদের হাতে। তারা সবাই গিলে খাচ্ছে, নাগালে যা পাচ্ছে, তার সব কিছু। গিলে খাচ্ছে আলো। তারাদের। গিলে নিচ্ছে যাবতীয় তথ্যাদি (ইনফরমেশন্‌স)-ও।

হালের একটি গবেষণা এ কথাই প্রমাণ করল হাতে-কলমে। গবেষণাপত্রটি ছাপা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্স’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায়। গবেষকদলে রয়েছেন উইল এম ফার ও ম্যাক্সিমিলানো ইসি, মার্ক এ শিলের মতো বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।

‘চুল নেই তো ব্ল্যাক হোলের?’ শেষ বয়সে দ্বিধায় ছিলেন হকিং!

শেষ বয়সে পৌঁছে ‘ইনফরমেশন থিয়োরি’র গোলকধাঁধায় ঢুকে যে সংশয় ইতিউতি উঁকিঝুঁকি মেরেছিল প্রয়াত কিংবদন্তি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মনে, তা নিয়ে কিছুটা হলেও, প্রশ্ন উঠে গেল।

আপনার থেকে আমাকে আলাদা করে চেনার অনেক উপায় রয়েছে। কেউ মোটা, কেউ রোগা। কারও মাথায় ঘন চুল তো কারও তেল চুপচুপে টাক। কেউ ফর্সা, কেউ কালো। আপনি লম্বা হলে আমি বেঁটে।

মস্ত টাক! ব্রহ্মাণ্ডের সেই রাক্ষসের।

কিন্তু আমাদের চেনা, জানা রাক্ষসরা সব সময়েই বিদঘুটে, কিম্ভূত। কোনও ফর্সা রাক্ষস দেখেছেন কখনও? দেখেছেন সুন্দর, সুপুরুষ রাক্ষস?

ব্রহ্মাণ্ডের ‘রাক্ষস’কে চেনার কাজটা খুব সহজ!

ব্রহ্মাণ্ডের রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলগুলিকেও খুব একটা আলাদা করে চেনার উপায় নেই। আমাদের চেনা, জানা রাক্ষসদের মতোই তারা চেহারাটা হয় দু’রকমের। হয় খুব ভারী, না হলে অতটা ভারী নয়। ব্রহ্মাণ্ডে ‘তুর্কিনাচন’-এর সময় তাদের ঘূর্ণিতেও আলাদা করা যায়। কেউ যদি এক দিকে ঘোরে, তা হলে অন্য ব্ল্যাক হোলটি ঘোরে উল্টো দিকে।

আরও পড়ুন- মিলে গেল বাঙালির পূর্বাভাস, ভিন মুলুকের বার্তা নিয়ে সৌরমণ্ডলে ঢুকল ‘পাগলা ঘোড়া’!​

তাই আমাদের চেয়ে ব্ল্যাক হোলদের চিনে ফেলার কাজটা অনেক সহজ! ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাক্ষস ব্ল্যাক হোলগুলিকে তাই বলাই যায়, আমাদের চেয়ে বেশি সরল-সিধে!

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ থেকে অঙ্ক কষে বিশ শতকের প্রায় মাঝপর্বে এই কথাটাই বলেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ব্ল্যাক হোলদের ‘আইডি কার্ড’ বানানোর জন্য দেওয়া হয়েছিল ‘নো হেয়ার (কোনও চুল নেই) থিয়োরেম’। বোঝানো হয়েছিল, ভর আর ঘূর্ণি এক হলে ব্রহ্মাণ্ডের দু’টি রাক্ষসকে আলাদা করে চেনার আর কোনও উপায় নেই। ‘চুল’ (অন্য কোনও ‘প্যারামিটার’ বা মাপকাঠি) থাকলে হয়তো সে ক্ষেত্রে ‘টাক-মাথা’র ব্ল্যাক হোল থেকে আলাদা করা যেত! কিন্তু তেমন কোনও ‘চুল’ নেই ব্রহ্মাণ্ডের ভয়ঙ্কর রাক্ষসদের মাথায়।

ব্ল্যাক হোল কী জিনিস? দেখুন ভিডিয়ো

আমাদের সূর্যের ভরের (‘সোলার মাস’) চেয়ে ওজনে সে কতটা বেশি, মূলত সেই তুলাদণ্ডেই আলাদা করা হয় ব্ল্যাক হোলগুলিকে।

আর সেই রাক্ষসটা আমাদের কতটা কাছে রয়েছে বা দূরে, তা মাপা হয় আলোকবর্ষের (সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার গতিবেগে ছুটলে বছরে আলো যে দূরত্ব পেরয়) স্কেলে।

চুল নেই ব্ল্যাক হোলের! জানা গেল কী ভাবে?

কাছাকাছি চলে আসার পর জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে একটি ব্ল্যাক হোল যখন আর একটি ব্ল্যাক হোলকে ধাক্কা মারে তখন সেখান থেকে তৈরি হয় একটি আরও বড় চেহারার একটি ব্ল্যাক হোল। আর সেই ধাক্কাধাক্কির ফলে একটি তরঙ্গের জন্ম হয় ব্রহ্মাণ্ডের স্থান-কালে (স্পেস-টাইম)। সেই তরঙ্গকেই বলা হয় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা ‘গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ’।

পুকুরের মাঝখানে ঢিল ফেললে তৈরি হওয়া তরঙ্গ ধীরে ধীরে ছড়াতে ছড়াতে ঘাটে এসে মিশে যায়। ঠিক তেমন ভাবেই দু’টি ব্ল্যাক হোলের মধ্যে কয়েকশো কোটি বছর আগে ধাক্কাধাক্কির ফলে জন্মানো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ওয়াশিংটনে হ্যানফোর্ড ও লিভিংস্টোনে বসানো ‘লাইগো’র দু’টি ডিটেক্টরে ধরা পড়েছিল ২০১৫-য়।

স্টিফেন হকিং

সেই মহাকর্যীয় তরঙ্গই সূক্ষ্ণ ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। আর সেটা করতে গিয়েই তাঁরা দেখেছেন, ভর আর ঘূর্ণি ছাড়া আর কোনও ‘চুল’ নেই ব্ল্যাক হোলদের মাথায়। যা খাপ খায় নো হেয়ার থিয়োরেমের বক্তব্যের সঙ্গে।

‘আনন্দবাজার’-এর তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল পুণের ‘ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’ (আয়ুকা)-এর অধিকর্তা, দেশের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ‘লাইগো-ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের অন্যতম সদস্য সোমক রায়চৌধুরীর সঙ্গে। সোমকের বক্তব্য, ‘‘এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। যা নো হেয়ার থিয়োরেমের সারবত্তাকে আরও শক্ত জমিতে দাঁড় করাল।’’

কী ভাবে নিশ্চিত হলেন গবেষকরা?

সোমক জানিয়েছেন, দু’টি ব্ল্যাক হোলের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ফলে তৈরি হওয়া ব্ল্যাক হোলটি কাঁপতে থাকে। অত জোরে ধাক্কাধাক্কি হলে, কিছু ক্ষণের জন্য হলেও, তার একটা রেশ তো থাকবেই। ধাক্কাধাক্কির ফলে জন্মানো নতুন ব্ল্যাক হোলটি কাঁপতে থাকে। সেটা খুব কম সময়ের জন্য। এক সেকেন্ডের পাঁচ ভাগের এক ভাগ সময়। সেই কাঁপার সময় তার মধ্যে কোন কোন কম্পাঙ্ক দেখা যেতে পারে, তার একটা ধারণা ছিল বিজ্ঞানীদের। কাছে ছুটে আসা দু’টি ব্ল্যাক হোলের ভর ও ঘূর্ণির মান থেকে যে কম্পাঙ্কগুলির হিসাব কষে ফেলা যায়। গবেষকরা দেখেছেন, ধাক্কাধাক্কির ফলে জন্মানো নতুন ব্ল্যাক হোলের ওই স্বল্প সময়ের কম্পনের সময় ছোট, বড় যতগুলি কম্পন হয়েছে, তাদের মান, ওঠা-নামা যেমনটা হিসাব কষা হয়েছিল, ঠিক তেমনটাই।

আরও পড়ুন- একটা সাফল্যের পিছনে অজস্র ব্যর্থতা! বিজ্ঞানের ইতিহাসই তো ইসরোর সম্বল​

নতুন ব্ল্যাক হোলটির ওই কম্পন না হলে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গেরও সৃষ্টি হত না। তাই সেই কম্পন যখন থেমে যায়, তখন সেই ব্ল্যাক হোলটি থেকে আর কোনও মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জন্ম হয় না।

দু’টি ব্ল্যাক হোলের ধাক্কাধাক্কিতে জন্মানো ব্ল্যাক হোলের কম্পন

সোমকের কথায়, ‘‘ভর আর ঘূর্ণি ছাড়া যদি ব্ল্যাক হোলদের ‘চুল’ও থাকত, তা হলে সেটা কখনই সম্ভব হত না। ফলে, ব্ল্যাক হোলের ‘নো হেয়ার থিয়োরেম’কেই সমর্থন করেছে এই পর্যবেক্ষণ। এটা একটা বড় সাফল্য।’’

প্রয়াত কিংবদন্তি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ও তাঁর এক সময়ের অধ্যাপক রজার পেনরোজেরও একই বিশ্বাস ছিল গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে।

ব্ল্যাক হোলে ঢোকা পদার্থ, তথ্য কি হারিয়ে যায় চিরতরেই?

কিন্তু ব্ল্যাক হোলে ঢুকে যাওয়ার পর পদার্থ, তথ্যাদির কী অবস্থা হয়? তারা কি হারিয়ে যায় চিরতরে? নাকি থেকে যায় অন্য কোনও ভাবে? অন্য কোথাও?

ওই সব প্রশ্নের গোলকধাঁধায় ঢুকে শেষ জীবনে হকিংয়ের মনে অবশ্য এই সংশয় দেখা দিয়েছিল, সত্যি-সত্যিই ‘চুল’ নেই তো ব্ল্যাক হোলের? ভর ও ঘূর্ণি ছাড়া আর কোনও মাপকাঠি কি সত্যিই নেই একটি ব্ল্যাক হোল থেকে অন্যটিকে আলাদা ভাবে চেনার জন্য? হকিং সেই সময় এও বলেছিলেন, ‘‘সামান্য চুল (সফ্‌ট হেয়ার) থাকলেও থাকতে পারে ব্ল্যাক হোলের।’’ যদিও সেটা শুধুই ছিল তাঁর সংশয়। কোনও সিদ্ধান্তে তিনি পৌঁছতে পারেননি। সংশয়টাকে বাতিল করার সুযোগও পাননি তাই।

সংশয়টা অমূলকই ছিল হকিংয়ের?

সে কথাও মানতে রাজি নন সোমক। তাঁর বক্তব্য, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ থেকে অঙ্ক কষে ভবিষ্যতে তো এটাও কেউ দেখাতে পারেন, ভর ও ঘূর্ণি ছাড়াও অন্য কোনও মাপকাঠিতে (যেমন, ‘চুল’) দু’টি ব্ল্যাক হোলকে একে অন্যের চেয়ে আলাদা করা যায়। সেটা হলে হকিংয়ের শেষ বয়সের সংশয়কে অমূলক বলা যাবে না। তবে এখনও পর্যন্ত ব্ল্যাক হোলের কোনও ‘চুল’-এর হদিশ মেলেনি।’’

ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE