Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Science News

ছত্রাক দিয়ে বাড়ি বানানো হবে চাঁদ-মঙ্গলে, কাজ জোরকদমে, জানাল নাসা

ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে নাসার এমস রিসার্চ সেন্টারে ‘মাইকো-আর্কিটেকচার প্রজেক্টে’র প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর লিন রথ্‌সচাইল্ড ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে রবিবার ই-মেলে এ কথা জানিয়েছেন।

সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২০ ১৩:৫২
Share: Save:

চাঁদ, মঙ্গলে ঘরবাড়ি বানানোর তোড়জোড়-প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে জোরকদমে। ইট, সিমেন্ট, বালি, চুনসুরকি দিয়ে নয়। সেই সব ঘরবাড়ি বানানো হবে মূলত ছত্রাক দিয়ে। বলা ভাল, ছত্রাকের যে অংশটিকে আমরা দেখতে পাই না সাধারণত, মূলত সেই ‘মাইসেলিয়া’ দিয়ে। আদতে যেটা ছত্রাকের মূল অংশ।

ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে নাসার এমস রিসার্চ সেন্টারে ‘মাইকো-আর্কিটেকচার প্রজেক্টে’র প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর লিন রথ্‌সচাইল্ড ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে রবিবার ই-মেলে এ কথা জানিয়েছেন।

এও জানিয়েছেন, চাঁদ আর মঙ্গলে আমাদের নতুন বসতির সেই সব ঘরবাড়িতে আমরা একাই থাকব না। থাকবে অন্য জীবও। এখন যেমন ফ্ল্যাটে, বাড়িতে মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম থাকে, চাঁদ-মঙ্গলে আমাদের ঘরবাড়িতেও তেমনই রাখা থাকবে নানা ধরনের অণুজীব।

কী না পারে ছত্রাকের মাইসেলিয়া! দু’সপ্তাহের মধ্যেই বানিয়ে ফেলেছে বসার ছোট টুল

যারা বাঁচার প্রয়োজনে শুষে নেয় সৌরশক্তি। আর তা দিয়ে জল ও বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে বদলে দেয় অক্সিজেনে। কার্যত বায়ুমণ্ডলহীন চাঁদ, মঙ্গলে আমাদের শ্বাসের বাতাস হয়ে উঠবে সেই অক্সিজেনই।

জল ও বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে ভেঙে সেই অণুজীবরা বানাতে পারে আরও কিছু পদার্থ। যা খেয়েদেয়ে তারা বেঁচে থাকবে। তাই এদের ‘সায়ানোব্যাকটেরিয়া’ও বলা হয়।

ছত্রাকের মাইসেলিয়া (উপরে), কাঠের গুঁড়ো, মাইসেলিয়া দিয়ে বানানো ইট (নীচে)

কল্পবিজ্ঞানের ছবির ধাঁচে হবে না বাড়িগুলি

চাঁদ, মঙ্গলে আমাদের সভ্যতার নতুন বসতি কেমন হবে, তা নিয়ে কল্পবিজ্ঞান ও তার ভিত্তিতে বানানো ফিল্মগুলিতে যে ছবি আঁকা হয়, সেখানকার ‘শহর’গুলি মোটেই তেমন ধাতব হবে না। একটি বালির পাহাড় থেকে অন্য বালির পাহাড়ে পাখির মতো উড়ে যাবে না গাড়িঘোড়াও।

পৃথিবীতে ধাতুর ব্যবহারই সভ্যতার রথের চাকাকে তড়তড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর বাইরে আমাদের বসতি বানাতে ধাতুর ব্যবহার যতটা কম করা যায়, সে কথা মাথায় রেখেই কাজ শুরু করে দিয়েছে নাসা। আর তার জন্যই শুরু হয়েছে ছত্রাক নিয়ে কাজ। যা চাঁদ, মঙ্গলকেও করে তুলবে ‘সবুজ থেকে সবুজতর’!

বাড়িগুলির যেখানে থাকবে ছত্রাক, যেখানে থাকবে মাইসেলিয়া

কল্পবিজ্ঞানের ছবির সঙ্গে মিলবে না কেন?

‘মাইকো-আর্কিটেকচার প্রজেক্টে’র অন্যতম বিজ্ঞানী, নাসার সদর দফতরে ‘পাথফাইন্ডার মিশন’-এর সদস্য অমিতাভ ঘোষ বলেছেন, ‘‘সভ্যতার ওই নতুন বসতি বানাতে আমাদের গবেষণা একেবারেই অভিনব পথে এগচ্ছে। এর আগে চাঁদে, মঙ্গলে আমাদের বসতি বানানোর কথা অন্য ভাবে ভাবা হয়েছিল। কচ্ছপের মতো। কচ্ছপ যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পিঠে করে নিয়ে যায় তার আস্তানা গড়ার মালমশলা, এমনকী, খোদ আস্তানাটাকেই নিয়ে যায় পিঠে চাপিয়ে, এত দিন আমরা তেমন ভাবেই ভেবেছিলাম চাঁদে আর মঙ্গলে আমাদের বসতি বানানোর জন্য। কিন্তু মুড়ে নিলেও সেই ভারী বসতিকে পিঠে চাপিয়ে চাঁদ বা মঙ্গলে পৌঁছনোর জন্য অতটা দূরত্ব পাড়ি দিতে হলে বিপুল পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন। তাতে জ্বালানির খরচ তো বাড়েই, বাড়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও। জ্বালানি যতটা সম্ভব কম খরচ করাটাই তো এখন সকলের লক্ষ্য।’’

চাঁদ, মঙ্গলের ঘরবাড়ির নকশা (উপরে), মঙ্গলের বাড়ির আর একটি নকশা (নীচে)

যেতে হবে কচ্ছপের মতো, তবে ছত্রাক পিঠে চাপিয়ে!

রথ্‌সচাইল্ড ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে জানিয়েছেন, কচ্ছপের মতোই যেতে হবে। তবে ভারী আস্তানা বা সে সব তৈরির মালমশলা পিঠে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভার বইতে হবে না। তার পরিবর্তে নিয়ে যাওয়া হবে ছত্রাক। যা অসম্ভব হাল্কা। যেন পালকের মতো। ছত্রাকের ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি সুবিধা রয়েছে। পৃথিবীর বাইরে যেতে সুদীর্ঘ পথ পেরনোর সময় ছত্রাকের কোনও ক্লান্তি আসবে না! ছত্রাক মরে যাবে না। সেগুলি নিস্তেজও হয়ে পড়বে না। এমনকী, চাঁদ বা মঙ্গলের মাটিতে পা ছোঁয়ানোর পর আমরা সুযোগসুবিধা মতো ছত্রাকের মাইসেলিয়াকে বাড়িয়ে নিতে পারব। যাতে আমরা নামার পর সেই ছত্রাক সেখানে আমাদের আস্তানা বানিয়ে দিতে পারে। দেখা গিয়েছে, মঙ্গলের অসম্ভব রুখুসুখু পরিবেশে দিব্য বেঁচে থাকতে পারে সেই ছত্রাক। বেঁচে থাকতে পারে চাঁদেও, বায়ুমণ্ডলের অভাবে যেখানে প্রতি মুহূর্তেই আছড়ে পড়ছে সূর্য থেকে ছুটে আসা বিষাক্ত কণা, রশ্মি, মহাজাগতিক রশ্মিও। শুধু তাই নয় ছত্রাকের বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন হয় না, সেই অক্সিজেন আমরা টেনে নিতে পারব। আর বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস টেনে নেবে ছত্রাক। এমনকী, আমাদের জৈব বর্জ্য বস্তুগুলিও খেয়ে নিতে পারবে ছত্রাক। বা সেই আস্তানায় থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলি। ফলে, চাঁদ, মঙ্গলের পরিবেশ দূষিতও হবে না।

মঙ্গলের বাড়ির আরও একটি নকশা

রেফ্রিজারেটরে রাখা অনেক দিনের খাবারদাবারেও ছত্রাক জন্মায়। আমরা বলি ‘ছাতা পড়েছে’। যে জৈব যৌগগুলি থেকে পেনিসিলিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক বানানো হয়, অনেক দিন রাখা থাকলে সেই যৌগগুলির উপরেও জন্মায় ছত্রাক।

চাঁদ, মঙ্গলের ঘরবাড়ি রক্ষা করবে বাস্তুতন্ত্রকেও

অমিতাভ জানিয়েছেন, এমস রিসার্চ সেন্টারের এই গবেষণা এগচ্ছে নাসার ইনোভেটিভ অ্যা়ডভান্সড কনসেপ্টস (এনআইএসি) কর্মসূচি প্রকল্পের অর্থানুকুল্যে।

রথ্‌সচাইল্ডের কথায়, ‘‘ছত্রাকের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার মাইসেলিয়া অংশটি। এই অংশটিই পরে মাশরুম তৈরি করে। ঠিক মতো তাপমাত্রা, পরিবেশ পেলে তারা আরও বড় কাঠামোও তৈরি করতে পারে। চাঁদ আর মঙ্গলে এই মাইসেলিয়া দিয়ে আমরা যে নতুন বসতি বানানোর পথে এগচ্ছি, তার ঘরবাড়িগুলি শুধুই যে চার দেওয়ালের হবে, তা নয়; সেগুলি একই সঙ্গে রক্ষা করবে বাস্তুতন্ত্রকেও।’’

চাঁদ, মঙ্গলের ঘরবাড়িগুলি হবে কত তলার?

চাঁদের বাড়ির আরও একটি নকশা

রথ্‌সচাইল্ড ও অমিতাভ জানাচ্ছেন, একেবারে গম্বুজের মতো। বলা যায়, তার তিনটি তলা বা স্তর থাকবে। গম্বুজের মাথাটা দেখা যাবে চাঁদ বা মঙ্গলের পিঠে। জমাট বাঁধা ওয়াটার আইস দিয়ে। যা সেই মুলুকের অন্দরে লুকনো (‘ট্র্যাপ্‌ড’) রয়েছে। সেই ওয়াটার আইস অসম্ভব ক্ষতিকারক তীব্র বিকিরণের হাত থেকে আমাদের বসতিগুলিকে বাঁচাবে। আর সেই জলই নীচে গড়িয়ে পড়ে পৌঁছে যাবে আমাদের বসতির দ্বিতীয় তলা বা স্তরে থাকা ছত্রাক ও অণুজীবগুলির কাছে। যাতে সৌরশক্তি দিয়ে সেই জলকে ভেঙে তারা তাদের প্রয়োজনীয় খাবারদাবার পেতে পারে। আবার আমাদের বেঁচে থাকার জন্য ছাড়তে পারবে অক্সিজেনও। পরিবশকে বিষমুক্ত করতে ওই জলের সাহায্যেই কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে ভেঙে দিতে পারবে। পারবে তারও নীচের স্তর বা তলায় থাকা ছত্রাকের মাইসেলিয়াকে টিঁকে থাকার রসদ জোগাতে।

ছবি ও গ্রাফিক সৌজন্যে: ‘এমস রিসার্চ সেন্টার’, নাসা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy