সূর্যের সেই সূচ। ইনসেটে, তন্ময় সামন্ত।
হুগলির পশ্চিমপাড়া থেকে সূর্যটা অনেক দূর! আলুর খেত থেকে সূর্যের পিঠে গিয়ে পড়াটাও তো কম দুরূহ নয়!
তবু এক কৃষক-সন্তানই কি না শেষমেশ ভেদ করলেন সূর্যের খুব জটিল একটা রহস্য! ১৪২ বছর ধরে যার জট খোলা সম্ভব হয়নি।
বলা নেই কওয়া নেই সূর্যের পিঠ থেকে কেন আচমকা তাপমাত্রা প্রায় দশ লক্ষ গুণ বেড়ে যায় তার বায়ুমণ্ডলের (করোনা), তা নিয়ে কৌতূহল, প্রশ্ন, খোঁজতল্লাশ তো চলছে কয়েক শতাব্দী ধরে। সূর্যের মনের কথা জানতে।
কে জানত, একেবারে টেলিস্কোপে (সোলার অবজারভেটরি) চোখ লাগিয়ে সূর্যের সেই গোপন কলাকৌশলটা চাক্ষুষ করে ফেলবে হুগলির এক কৃষিক-সন্তান? যা এর আগে হাতকলমে কেউই দেখাতে পারেননি।
সূর্যের সূচ ও তন্ময়
হ্যাঁ, তন্ময় সামন্তের কথা বলছি। আরামবাগের কাছে হুগলির পশ্চিমপাড়ার ছেলে। হ্যাঁ, সূর্যের রহস্যময় এক ধরনের ‘সূচ’-এর কথাও বলছি। যার নাম- ‘স্পিকিউল্স’। প্রচণ্ড গতিবেগে যে সূচগুলি সূর্যের পিঠের কিছুটা উপর থেকে বেরিয়ে হুশ্ করে উপরে উঠে গিয়ে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা একলাফে কয়েক লক্ষ গুণ বাড়িয়ে দেয়। তার বায়ুমণ্ডলকে করে তোলে ভয়ঙ্কর। অসহনীয়।
গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স’-এর নভেম্বরের সংখ্যায়।
গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়?
তন্ময়ের কৃতিত্ব, তিনিই প্রথম দেখাতে পারলেন, সূচগুলির আদত ভূমিকা কী। দেখাতে পেরেছেন ওই সূচগুলির জন্ম নেওয়ার ফলে কী ভাবে সূর্যের পিঠ থেকে তার উপরের স্তরে তাপমাত্রা হঠাৎই অতটা বেড়ে যায়। এও দেখিয়েছেন, সেখান থেকে কী ভাবে দুম করে করোনার তাপমাত্রা বেড়ে যায় কয়েক লক্ষ গুণ। ‘‘তন্ময়ের আগে এটা আর কেউ দেখাতে পারেননি। ২০১১-য় একটা পেপারে অবশ্য ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল, করোনার তাপমাত্রা একলাফে অতটা বাড়ানোয় ভূমিকা থাকতে পারে সূচগুলির। কিন্তু তা চাক্ষুষ করা সম্ভব হয়নি’’, বলছেন বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী, মোহনপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার-কলকাতা)-এর অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী।
সূচ এত ক্ষমতাশালী হতে পারে!
নেহাতই সূচ বলে হেলাফেলা করবেন না। সূর্যের এই সূচগুলির ক্ষমতা জানলে অবাক হয়ে যাবেন।
সূর্যের একেবারে অন্দরে যেখানে পরমাণু চুল্লিটা আছে, সেখানকার তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি কেলভিন। সেখান থেকে সূর্যের পিঠ বা ফোটোস্ফিয়ারের দূরত্বটা ৭ লক্ষ কিলোমিটার। যেখানকার তাপমাত্রা ৫ হাজার ৭০০ থেকে ৬ হাজার ডিগ্রি কেলভিন বড়জোর।
কিন্তু তার পরেই যেন হঠাৎ ক্ষেপে উঠল সূর্য! পিঠ থেকে ২ হাজার কিলোমিটার উপরে থাকা তার বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে নীচের স্তরটিকে তাতিয়ে তুলল রীতিমতো গনগনে ১০ হাজার বা তারও কিছু বেশি ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায়। ওই স্তরের নাম ‘ক্রোমোস্ফিয়ার’।
চমকের শেষ নয় এখানেই। ক্রোমোস্ফিয়ার থেকে শুরু হল সূর্যের বায়ুমণ্ডল। ফোটোস্ফিয়ার থেকে যার শেষ প্রান্তটার দূরত্ব প্রায় ৭০ লক্ষ কিলোমিটার।
আরও পড়ুন- মঙ্গল মরে যায়নি? বাতাসে মিলল অক্সিজেন, বসন্তে বাড়ে, কমে যায় শীতে, গরমে
আরও পড়ুন- ধুলোর উঁচু উঁচু স্তম্ভই কি উড়িয়ে দিয়েছে মঙ্গলের সবটুকু জল!
কেন পিঠের চেয়ে ১০ লক্ষ গুণ বেশি তাপমাত্রা করোনার?
রহস্যের জন্ম হল। সূর্যের অন্দরে থাকা পরমাণু চুল্লির তুলনামূলক ভাবে কাছে থাকা সত্ত্বেও ফোটোস্ফিয়ারের তাপমাত্রা যেখানে মাত্র ৬ হাজার ডিগ্রি কেলভিন, সেখানে পরমাণু চুল্লি থেকে তার প্রায় ১০ গুণ দূরত্বে থাকা করোনার তাপমাত্রা কী ভাবে একলাফে বেড়ে হয়ে যায় ১০ লক্ষ ডিগ্রি কেলভিন?
কয়েক শতাব্দী ধরে এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন তত্ত্বের জন্ম হয়েছে। দেখা গিয়েছে, এর কারণ মূলত তিনটি।
ক্রোমোস্ফিয়ার থেকে কী ভাবে ছিটকে বেরিয়ে আসে সূর্যের সূচ? দেখুন ভিডিয়ো
এক, করোনায় সূর্যের বিপরীতধর্মী (ধনাত্মক ও ঋণাত্মক) দু’ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি এক অন্যের কাছে এসে নিজেদের ধ্বংস করে ফেললে বিপুল পরিমাণে চৌম্বক শক্তি জন্ম হয়। যা পরিবর্তিত হয় তাপশক্তি ও গতিশক্তিতে। করোনার প্রচণ্ড তাপমাত্রার অন্যতম কারণ এটি, মনে করেন বিজ্ঞানীদের একাংশ।
দুই, সূর্যের পিঠ বা ফোটোস্ফিয়ারে যেখানে চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি রয়েছে, সেখান থেকে এক ধরনের তরঙ্গ (অ্যালফ্ভেন ওয়েভ) বেরিয়ে আসে। ওই তরঙ্গের জন্ম হয় ফোটোস্ফিয়ারের নীচে ঢুকে যাওয়া চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির নীচের অংশগুলির মধ্যে সব সময় কাঁপাকাঁপি চলে বলে। একটা তারকে এক জনের হাতে ধরিয়ে তারের অন্য প্রান্তটি আপনার হাতে নিয়ে ঝাঁকালে যেমন তরঙ্গের জন্ম হয়, ঠিক তেমনই। ওই তরঙ্গ করোনায় পৌঁছে তার তাপমাত্রা কয়েক লক্ষ গুণ বাড়িয়ে দেয়। সেই তরঙ্গগুলি যদি লম্বায় খুব বড় হয়, তা হলে তা সূর্যের বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে বাইরের মহাকাশেও ছড়িয়ে পড়ে। তরঙ্গ খুব শক্তিশালী হলে তা সৌরবায়ুর (সোলার উইন্ড) গতিবেগ অসম্ভব বাড়িয়ে দিতে পারে।
তিন, ফোটোস্ফিয়ারের কিছুটা উপরে থাকা ক্রোমোস্ফিয়ারেও বিপরীতধর্মী চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি কাছে এসে একে অন্যকে ধ্বংস করে দেওয়ার ফলে তৈরি হওয়া প্রচণ্ড চৌম্বক শক্তি তাপ ও গতিশক্তিতে বদলে যায়। তখনই ক্রোমোস্ফিয়ার থেকে ওই সূচগুলির জন্ম হয়। যারা অসম্ভব জোরে ছুটে গিয়ে করোনায় পৌঁছে তার তাপমাত্রা অতটা বাড়িয়ে দেয়। আবার সেই সূচগুলি খুব বেশি ক্ষণ টিঁকে থাকে না। ১০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিটের মধ্যে সূচগুলি মিলিয়ে যায়। তাদের আর দেখা যায় না।
অধ্যাপক দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (বাঁ দিক থেকে) আর তাঁর ছাত্র তন্ময় সামন্ত (উপরে সৌর সূচ সংক্রান্ত গবেষণাপত্র)
এক-একটা সূচ লম্বায় যেন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী!
এই সূচগুলি লম্বায় হয় ৩ থেকে ৫ হাজার কিলোমিটার। মানে, প্রায় কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর দূরত্ব। আর সূচগুলি চওড়ায় হয় মেরেকেটে ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার। ফলে, অত লম্বা সূচগুলি হয় যেন অনেকটা চুলের মতোই সরু। লিকলিকে। সূচগুলি ক্রোমোস্ফিয়ার থেকে বেরিয়ে এসে করোনার দিকে ছুটে যায় অসম্ভব জোরে। সেকেন্ডে ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার গতিবেগে। এই গতিবেগই করোনার তাপমাত্রা একলাফে কয়েক লক্ষ গুণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
তন্ময় বলছেন, ‘‘সূর্যের ক্রোমোস্ফিয়ারের প্রতি ১০ হাজার কিলোমিটার এলাকা থেকে অন্তত ৫০ বা ১০০টি সূচ বেরিয়ে আসে।’’
আরও পড়ুন- চেন্নাইয়ের এই ইঞ্জিনিয়ারই খুঁজে দিলেন বিক্রম-এর ধ্বংসাবশেষ, কৃতিত্ব দিল নাসা
আরও পড়ুন- বাতাসের বিষ এ বার ঝাড়ানো যাবে সস্তায়, নতুন পথের হদিশ মিলল
ক্লাসের ‘সি’ সেকশনের ছাত্র যে ভাবে হয়ে উঠলেন সূর্য-মুখী
সূর্যের ওই ‘নগণ্য’ সূচের মতোই শুরু হয়েছিল তন্ময়ের জীবন! হুগলির অজ পাড়াগাঁয়ে এক কৃষকের ঘরে তাঁর জন্ম। বাবা জমিতে আলু চাষ করেই সংসার চালাতেন। স্কুলের সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ‘সি’ সেকশনের ছাত্র। পরীক্ষায় নম্বর তেমন ভাল পেতেন না যে! কিন্তু ওই যে সূর্যের সূচের কথা বললাম। যত উপরে উঠছে ততই তার উপস্থিতি টের পাচ্ছে করোনা। তা অসম্ভব গরম হয়ে উঠছে। তন্ময়ের জীবনটাও যেন তেমনই। মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসলেন স্কুল থেকে তৃতীয় হয়ে। উচ্চমাধ্যমিক পশ্চিমপাড়ারই একটি স্কুল থেকে। জঙ্গলপাড়া হাইস্কুল।
আরামবাগের একটি কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করে পিএইচি করতে গেলেন বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে’। সেখানেই পরিচয় সৌরপদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ভারতের প্রথম সৌর অভিযান (যা হওয়ার কথা ২০২১/’২২-এ) ‘আদিত্য এল-ওয়ান’-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে দীপঙ্করের। সেই দীপঙ্করই কৃষক-সন্তান তন্ময়কে করে তুললেন সূর্য-মুখী। ‘আদিত্য’-এর স্বপ্ন দেখিয়ে। চিনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল করার সময়েই তন্ময়ের এই গবেষণা। সহযোগী হিসেবে ছিলেন দীপঙ্করও।
যেখানে ধরা পড়ল সূর্যের সূচ! আমেরিকার সেই বিগ বেয়ার সোলার অবজারভেটরি
সূচ প্রথম ধরা পড়ে ১৪২ বছর আগে
সূর্যের ক্রোমোস্ফিয়ারে এই সূচগুলির অস্তিত্বের কথা প্রথম জানা যায় ১৮৭৭ সালে। কিন্তু সেগুলির ভূমিকা কী, তা নিয়ে কারও তেমন স্পষ্ট ধারণা ছিল না।
২০১১ সালে প্রথম একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, করোনার তাপমাত্রা কয়েক লক্ষ গুণ বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে সূচগুলির। কিন্তু সেটা শুধুই একটা ইঙ্গিত ছিল। কিছুটা অনুমানের ভিত্তিতে। শক্তিশালী সোলার অবজারভেটরির অভাবে যা চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়নি কারও।
তন্ময়ের সৌভাগ্য, তিনি আমেরিকার ‘বিগ বেয়ার সোলার অবজারভেটরি’তে সূর্যের অন্দরে সূচগুলিকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। যেখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সৌর টেলিস্কোপ।
সহযোগী গবেষক তন্ময়ের ‘দীপঙ্করদা’ বললেন, ‘‘আমরা দেখেছি, ক্রোমোস্ফিয়ারে দু’টি বিপরীতধর্মী চৌম্বক ক্ষেত্র কাছাকাছি এসে ধ্বংস হয়ে গিয়ে যে বিপুল পরিমাণে চৌম্বক শক্তিতে পরিবর্তিত হয়, তা ওই সূচগুলি তৈরি করার পক্ষে যথেষ্ট।’’
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
ছবি সৌজন্যে: তন্ময় সামন্ত
ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy