মুশকিল অপেক্ষা করে আছে বেশি নম্বর পাওয়াদের কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভারতবর্ষে পড়াশোনার জায়গায় প্রবল প্রতিযোগিতা। খুব সহজ অঙ্কে দু’কোটির মত ছাত্রছাত্রী প্রতি বছর এক একটি স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। একটি স্তরের উদাহরণ দিতে ধরা যাক উচ্চমাধ্যমিক। এটি সম্ভবত সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়। স্কুল থেকে কলেজে পৌঁছনো। উচ্চশিক্ষার প্রবেশদ্বার। প্রতিযোগিতা ঠিক কতটা তীব্র? মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং মিলিয়ে দেশে খুব বেশি হলে সরকারি কিংবা নামী বেসরকারি জায়গায় এক লক্ষ আসন। প্রতিযোগী প্রায় ত্রিশ লক্ষ মেধাবী পড়ুয়া।
এরা যে কেউ এই এক লক্ষ আসনে পড়ার সুযোগ পেলে নিশ্চিন্তে স্নাতকস্তরের ডিগ্রি বাগিয়ে নিত। কিন্তু সেটা যে হচ্ছে না, তার কারণ আসনের অপ্রতুলতা। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আমাদের বাজেটের ঠিক কতটা খরচ হয়, সে প্রশ্ন তুলে এই আলোচনাকে বিপথগামী করার কোনও কারণ নেই। তবে বাকি উনত্রিশ লক্ষ পড়ুয়ার অনেককেই বেশি টাকার বিনিময়ে অনেক নিম্নমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে হচ্ছে, বিশেষ করে ডাক্তারি কিংবা প্রযুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে।
প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে, এ দিকে পরীক্ষার্থী প্রচুর। খাতা দেখতে সময় লাগবে বলে টিক মারা পরীক্ষা। সেটাও বদলে গেল। তার বদলে চলে এল অনলাইন। অর্থাৎ বসতে হবে কম্পিউটারের সামনে। আদতে এর কোনও প্রয়োজনীয়তাই ছিল না। কিন্তু সম্ভবত কর্তৃপক্ষের কাজ কমাতে এই সিদ্ধান্ত।
এ দিকে দেশে অনলাইন পরীক্ষা নেওয়ার সময় একসঙ্গে দশ-বারো লক্ষ পরীক্ষার্থীর বসার জায়গা নেই। তাই সর্বভারতীয় প্রযুক্তিবিদ্যার প্রবেশিকায় ছ’টি ভিন্ন প্রশ্নপত্র। অর্থাৎ গড়ে দু’লক্ষ করে পরীক্ষার্থী একই দিনে একটি প্রশ্নমালায় পরীক্ষা দেবে। পরের দিনে আবার অন্য প্রশ্নপত্র। এ বার দুটি আলাদা দিনে পরীক্ষা দেওয়া দু’জন পরীক্ষার্থীর স্থান নম্বর দিয়ে বিচার হবে না। হবে সে দিনের পরীক্ষায় একজন কততম স্থান পেল তার নিরিখে। অর্থাৎ এমন হতেই পারে যে— ৩০০ নম্বরের পরীক্ষায় ২৮০ পেয়ে একজনে স্থান হল ২০০, আর অন্য দিনের পরীক্ষায় ২৭০ পেয়ে আর একজনের স্থান ১৫০। এখানেই শেষ নয়। একই দিনের পরীক্ষায় একই নম্বর পেয়েও স্থান আলাদা হয় দুজন পরীক্ষার্থীর। এই জটিল অঙ্কে আর বেশি ঢুকে প্রয়োজন নেই। তবে বিপুল জনসংখ্যার দেশে এমনটা ঘটবেই। আর এই ধরণের বিষয়ে পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলার জন্যে গাদা গাদা লোক পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন: সচিনদের আবেদন আদালতের বিচার্য নয়, দাবি সিঙ্ঘভির
এই গোলমেলে এবং জটিল অঙ্ক আর রাশিবিজ্ঞানের প্রসঙ্গেই আসছে ডাকওয়ার্থ-লুইস এর কথা। আরও একজন অধ্যাপক যোগ হয়ে এখন তার নাম ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন মেথড। অত্যন্ত জটিল সূত্রের সমাহার এই অঙ্ক। বেশ কয়েক বার পরিবর্তন হয়েছে এই নিয়মের। মুল কথা হল বৃষ্টি হয়ে ওভার নষ্ট হলে, কী ভাবে পরিবর্তন হবে রানের। খেলোয়াড়দের পক্ষে এই অঙ্ক বোঝা সম্ভব নয়, তাই তাদের হাতে থাকবে ওভার, রান আর উইকেটের সারণি। সেই হযবরল বুঝে হাতে পেনসিল নিয়ে খেলতে হবে।
শুরুতে ডাকওয়ার্থ-লুইস পূর্ববর্তী সময়ের কথায় আসা যাক। সেই আগের নিয়মের গলদ যে কী ভীষণ সে কথা আর মনে করিয়ে দিতে হবে না। ২২ মার্চ, ১৯৯২ — ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। সিডনিতে খেলা হচ্ছে ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার। ইংল্যান্ড করেছে ৪৫ ওভারে ২৫৩। দক্ষিণ আফ্রিকা ৪২.৫ ওভারে ৬ উইকেটে ২৩১। জেতার সম্ভাবনা বেশ কিছুটা ছিল। এই সময় এল বৃষ্টি। তা থামল কিছু ক্ষণ পরেই। খেলা চলার মত আলো ছিল যথেষ্ট। কিন্তু তদানীন্তন সূত্রে জানা গেল দক্ষিণ আফ্রিকাকে করতে হবে ১ বলে ২২। এ সব সমস্যা সামলাতেই নাকি এল ডাকওয়ার্থ-লুইস, যা প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৯৭ সালের পয়লা জানুয়ারি জিম্বাবোয়ে বনাম ইংল্যান্ডের এক দিনের ম্যাচে। আইসিসি তা পুরোপুরি চালু করে ১৯৯৯-এ। এর পরেও নিয়মের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বদলে যাওয়া যে নিয়ম ২০০৬তে লাগু ছিল, সেটা বলছে যে ১৯৯২ সালের সেই খেলায় পাঁচ ওভার কমার জন্যে শুরুতেই নাকি দক্ষিণ আফ্রিকার হিসেব দাঁড়াত পঁয়তাল্লিশ ওভারে ২৭৩। আর পরে হলে ৪৩ ওভারে ২৫৭। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এই সমস্ত নিয়মের জটিলতা অন্তহীন।
দোষ রাশিবিজ্ঞানীদের নয়, যারা ক্রিকেটের হর্তাকর্তা তাঁদের। প্রথমে ধরা যাক এখানে খুব বেশি অসততার প্রশ্ন নেই। কারণ এমন নিয়ম বানিয়ে কোনও ক্রিকেট কর্তা প্রচুর টাকা কামিয়েছেন এমনটা হয়ত নয়। সে ক্ষেত্রে এ হল ভিমরতি। ক্ষমতাশালী মানুষের অবিমৃশ্যকারিতা ন্যায় অন্যায়ের হিসেব গুলিয়ে দেয়। আর অন্য দিকে অসততার প্রশ্ন তুলতে গেলে অবশ্যই মনে করিয়ে দিতে হবে ব্যবসায়িক চাপের প্রসঙ্গ। ঠিক কখন কতটা সময় ধরে খেলা হবে, বিজ্ঞাপনের বিরতি কতটুকু, এই সব হিসেব তাই ক্রিকেটের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কুড়ি কুড়ি ক্রিকেট তো আর খেলা বাঁচানোর নয়, খেলার ব্যবসা বাঁচানোর।
ঠিক সেই রকমই পড়াশোনা আমাদের দেশে একটা বড় ব্যবসা। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলোতে কোচিং-এর রমরমার কথা সকলেই জানেন। অর্থাৎ আমাদের দেশে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটাই যে সব গোলমালের মূল এমনটা নাও হতে পারে। পরীক্ষায় ন্যায়বিচার বজায় রাখতে গেলে যে সবসময় তা সর্বভারতীয় হতেই হবে এ যুক্তি কে দিয়েছে? আমাদের দেশের বিভিন্ন অংশে পোশাক ভিন্ন, খাবার ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন, এ দিকে ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারিতে ভর্তি হতে গেলে পরীক্ষা এক। কী এমন ক্ষতি হত যদি বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিভিন্ন রাজ্য নিজেদের মত পরীক্ষা নিত? এমনটাই তো আগে ছিল। তাতে কি আগের সব ডাক্তার গাদা গাদা রোগী মেরেছে, না সব ইঞ্জিনিয়ারের বানানো ব্রিজ ভেঙে গিয়েছে? অর্থাৎ যে ন্যায়ের কথা বলে যুগ্ম তালিকায় থাকা শিক্ষায় কেন্দ্রের খবরদারি বাড়ছে, তাতে এই সমস্ত ঝামেলা এবং জটিলতা ঢুকে পড়বেই। এতে মুশকিলে পড়বে সাধারণ কিন্তু মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা, আর সুবিধে পাবে যাদের হাতে পয়সা বেশি তারা। সিস্টেমে জটিলতা বাড়ানো মানেই সেখানে ন্যায়বিচারের মোড়কে অল্পসংখ্যক মানুষকে সুবিধে দেওয়ার চেষ্টা। সাধারণ মানুষ যত কম বুঝবে, শাসকের তত সুবিধে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে এই শাসক মানে বিজেপি কিংবা কংগ্রেস নয়। এখানে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কিছু ক্ষমতালোভী মানুষ, যারা বিভিন্ন রাজত্বেই শিক্ষাব্যবস্থার দখল নেন। রাজনীতি বদলালে তাদের গায়ের পোশাক এবং মনের রঙ বদলায়। আর এ দেশে যেহেতু বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ পড়াশোনায় তেমন ভাল নন, তাই শিক্ষার অলিন্দে তাঁদের প্রয়োজন ক্ষমতালোভী শিক্ষাবিদ। যাঁরা ক্ষমতা পান, তাঁদের আবার রাজ্যপাট চালাতে গিয়ে পড়াশোনার সময় কমে যায়। সময় কমে যুক্তিপূর্ণ ভাবনার। তার পর শুধু অবোধ্য সূত্ররাশির দাপাদাপি। পড়াশোনা করে ভাল নম্বর পেয়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার গল্প তাই শেষ। এখন খেলার নিয়ম জানতে হবে ভাল করে।
এই গোদের ওপর বিষফোঁড়া কোভিড অতিমারি। অর্ধেক পরীক্ষাই বানচাল। আজকের দিনে সত্যিই সংক্রমণের বাড়াবাড়ি। কিন্তু শুরুর সময়টায় পরিস্থিতি এমনটা ছিল না। সেই সময় সঠিক পরিকল্পনা করে হয়ত পরীক্ষা নেওয়াই যেত। সে কথা থাক। পরীক্ষা যখন হলই না, তখন সেই বিষয়গুলিতে নম্বর ঠিক করার দায় বর্তাল ক্ষমতাশালীদের উপর। এ ক্ষেত্রে শুরুতে বলতেই হবে যে, প্রচুর নম্বর দিয়েছেন বিভিন্ন বোর্ডের আধিকারিকরা। ছাত্রছাত্রীরা যে বিষয়গুলিতে পরীক্ষা দিয়েছে তার মধ্যে এক বা একাধিক বিষয়ে পাওয়া সর্বোচ্চ নম্বরের গড় কষে বাকি বিষয়গুলিতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন পরীক্ষার্থীর হয়ত তাতেও খুব লাভ হয়নি, তবে সে সংখ্যা নগন্য। মাধ্যমিক স্তরে পড়ুয়াদের খুব অসুবিধে হবে না এ ক্ষেত্রে। কারণ তারা বেশিরভাগই হয়ত কোনও না কোনও ইস্কুলে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পড়ার সুযোগ পেয়ে যাবে। কিন্তু মূল মুশকিল সেই উচ্চমাধ্যমিক স্তরে। আমাদের রাজ্যের উচ্চমাধ্যমিকের কথাই ধরা যাক। যে বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে পরীক্ষার্থী, সেটাই বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বাকি বিষয়গুলিতে। একেবারে বাস্তব একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। অঙ্কে একশো পেয়েছে এক ছাত্র। তার ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর স্ট্যাটিস্টিক্সের নম্বর যথাক্রমে ৯৯, ১০০ এবং ১০০। ফিজিক্সে ১ কমেছে প্র্যাক্টিক্যালে নম্বর কাটা যাওয়ায়। এটা বোঝা যাচ্ছে যে এ বারের উচ্চমাধ্যমিকে অঙ্কে যারা একশো পেয়েছে, বিজ্ঞানের বাকি বিষয়গুলোয় তাদের নম্বর একশোর কাছাকাছিই থাকবে। কারণ প্র্যাক্টিক্যালে স্কুল সাধারণত বেশি নম্বরই দেয়।
নম্বর তো না হয় ভালই জুটল, কিন্তু তার পর? যথেষ্ট মুশকিল অপেক্ষা করে আছে এই বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের নম্বরের ভিত্তিতে কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়। কোভিড পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়া শক্ত। এ দিকে একই নম্বরে গাদা গাদা পড়ুয়া। এখন প্রশ্ন হল এখানেও কি হঠাৎ করে কোনও বিদ্বজ্জনকে ডেকে আবার জটিল সূত্র বানানো হবে— যেখানে পড়ুয়ার নম্বরের সঙ্গে সূত্রে ব্যবহার করা হবে তার ঠিকানা, বাবার নাম, জন্মদিন, উচ্চতা, চশমার পাওয়ার, গায়ের রঙ?
আজকের দিনে অন্য সমাধান নেই, তার কারণ এই দেশের রাজনীতির কারবারিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শিক্ষাবিদেরাও সর্বনাশ করেছেন গোটা শিক্ষাব্যবস্থার। রাজ্যস্তরে ইংরেজি উৎপাটন থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় স্তরে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোকে টিক চিহ্নের দিকে নিয়ে যাওয়া, শিক্ষায় বাজেট কমিয়ে উদ্যোগপতিদের মুনাফার ব্যবস্থা করা, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর হাঁড়ির হাল হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে সরকারি সিলমোহর দেওয়া, সব মিলিয়ে গোটা ব্যবস্থাটাই ঘেঁটে ছিল। সরকারি শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রশাসনের অবিমৃশ্যকারিতায় বেশিরভাগ কলেজের অবস্থা তথৈবচ। সেই জন্যেই মফস্বলের কলেজে পড়তে চাইবে না অঙ্কে একশো পাওয়া কোনও মেধাবী পড়ুয়া।
আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় ৪০ হাজার! দেশে মোট আক্রান্ত ১১ লক্ষ ছাড়াল
এ দিকে সবাইকে তো আর যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি করা যাবে না। তাই কোভিডাক্রান্ত শিক্ষাব্যবস্থায় খুঁজে ফিরতে হবে আত্মনির্ভর ভারতের ডাকওয়ার্থ-লুইস। দরকারে সেই সব সূত্রে ধার করা হবে ছাতির মাপ, অন্যকে ভয় দেখানোর ক্ষমতা, টাকার জোর, নেতাদের সুপারিশ। তবেই তো শুরুর দিকে স্থানাধিকার করবে শিক্ষার্থী। বিপদটা এখানেই। অঙ্কে একশোর সঙ্গে পেশীশক্তি মিলিয়ে বাঁচতে হবে কোভিডের কালবেলায়। বিবর্তনই বলুন বা অভিযোজন, নব্য স্বাভাবিকতায় এই সূত্রহীনতাই একমাত্র সূত্র।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy