Advertisement
E-Paper

লাদাখে রাতের সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় সেনা নিহত, হতাহত চিনের তরফেও

ভারতের দাবি, চিন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা না-মানার ফলেই লাদাখের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে।

নিহত তিন ভারতীয় সেনা কর্নেল বি সন্তোষ বাবু, হাবিলদার কে পাঝানি এবং কুন্দন ওঝা (ডান দিকে)।

নিহত তিন ভারতীয় সেনা কর্নেল বি সন্তোষ বাবু, হাবিলদার কে পাঝানি এবং কুন্দন ওঝা (ডান দিকে)।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২০ ০৪:৪৪
Share
Save

দীর্ঘ ৪৫ বছর পরে ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষে মৃত্যু হল ২০ জন ভারতীয় সেনার। সোমবার রাতে পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় ও চিনা সেনার মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। প্রাথমিক ভাবে এক কর্নেল-সহ তিন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর কথা বলা হলেও রাতে ভারতীয় সেনার বিবৃতিতে জানানো হয়, গুরুতর আহত আরও ১৭ জন সেনা প্রবল ঠান্ডার কারণে মারা গিয়েছেন।

সেনা সূত্রের দাবি, এই সংঘর্ষে চিনেরও একাধিক সেনার মৃত্যু হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে জানানো হয়েছিল সংখ্যাটা পাঁচ। কিন্তু রাতে সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ভারতীয় সেনার হিসেব মতো চিনের তরফে হতাহত ৪৩। চিনা বাহিনী হেলিকপ্টার এনে তাঁদের নিয়ন্ত্রণরেখার এ-পার থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।

চিন অবশ্য রাত পর্যন্ত সরকারি ভাবে তাদের কোনও সেনার মৃত্যুর কথা স্বীকার করেনি। তবে চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ‘ভারতীয় প্ররোচনায় হামলা’র কথা স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছেন। সে দেশের সরকারি সংবাদপত্র ‘গ্লোবাল টাইমস’-এর সম্পাদক টুইট করে প্রাণহানির কথাও জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন: চিনের দিক থেকে সমঝোতা লঙ্ঘন, সার্বভৌমত্বে আপস নয়, কড়া বার্তা ভারতের

গোড়ায় যে তিন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছিল তাঁরা হলেন, কর্নেল বি সন্তোষ বাবু, হাবিলদার কে পাঝানি ও কুন্দন ওঝা। ডিসেম্বর মাসেই লাদাখে কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন সন্তোষ। সেনা সূত্রের দাবি, কাল রাতের সংঘর্ষে কোনও গোলাগুলি চলেনি। রড, পাথর নিয়ে হাতাহাতিতে জড়িয়েছিলেন দু’দেশের সেনা। কিন্তু স্রেফ খণ্ডযুদ্ধে এত লোকের মৃত্যু হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

আরও পড়ুন: লাদাখ থেকে যা খবর পাচ্ছি... ।। লিখলেন কর্নেল সৌমিত্র রায়

ভারতের দাবি, চিন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা না-মানার ফলেই লাদাখের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। দিল্লিতে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব আজ বলেন, দু’দেশের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, চিন তা মেনে চললে দু’পক্ষের এই ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হত। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতের যাবতীয় তৎপরতার সবটাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার এ-পারে তার নিজের এলাকায়। আমরা চিনের কাছ থেকেও সেটাই প্রত্যাশা করি।’’ দু’পক্ষের আলোচনায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা মেনে চলার ব্যাপারে যে ঐকমত্য হয়েছিল, চিন তা লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের। ঘটনাচক্রে চলতি সংঘাতের আবহে এই প্রথম ভারতের তরফে সরকারি ভাবে চিনের নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘনের কথা স্বীকার করা হল।

লাদাখে অস্থায়ী শিবিরে যাওয়ার অপেক্ষায় ভারতীয় সেনারা। মঙ্গলবার দক্ষিণ-পূর্ব শ্রীনগরের বালতালে। ছবি: রয়টার্স।

চিনের অবশ্য পাল্টা দাবি, সোমবার রাতের গোটা ঘটনার পিছনে ভারতের প্ররোচনা রয়েছে। চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়াং বলেছেন, ‘‘১৫ জুন ভারতীয় সেনা দু’বার সীমান্ত পেরিয়ে বিনা প্ররোচনায় চিনা বাহিনীর উপর হামলা চালিয়েছে। এর ফলে দুই বাহিনীর ভিতর ভয়ঙ্কর হাতাহাতি হয়েছে। আমরা ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’’

বিকেলে ‘গ্লোবাল টাইমস’ চিনা সেনাকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ভারতীয় সেনা গালওয়ান উপত্যকায় ফের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা টপকে চিনা ভূখণ্ডে প্রবেশ করে বহু ক্ষয়ক্ষতি করেছে। এ দিন কার্যত হুমকির স্বরে ‘গ্লোবাল টাইমস’-এ বলা হয়েছে, ‘ভারতের ঔদ্ধত্য এবং বেপরোয়া মনোভাবই চিন-ভারত সীমান্তে লাগাতার উত্তেজনার জন্য দায়ী। চিন সংঘাত তৈরি করে না, করবেও না। কিন্তু তারা সংঘাতকে ভয়ও পায় না।’

লাদাখে ভারত ও চিনের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত মে মাসের গোড়ায়। দারবুক থেকে দৌলত বেগ ওল্ডি বায়ুসেনা ঘাঁটি পর্যন্ত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার সমান্তরালে যে রাস্তা ভারত তৈরি করছে, মূলত তা নিয়েই আপত্তি চিনের। পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৪-এ শাইয়োক নদীর উপরে সেতু তৈরি ঠেকাতে ওই সময়েই পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা, নাকু লা এবং প্যাংগং লেকের উত্তর প্রান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতীয় এলাকার কয়েক কিলোমিটার ভিতরে এসে তাঁবু গেড়ে বসে পড়ে চিনা ফৌজ। তার পর থেকে মাঝেমধ্যেই সংঘাত হচ্ছে দু’পক্ষের।

কেন লড়াই

• লে থেকে দারবুক, শাইয়োক হয়ে দৌলত বেগ ওল্ডি বায়ুসেনা ঘাঁটি (১৬,৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের সর্বোচ্চ এয়ারস্ট্রিপ) পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করছে ভারত। কারাকোরাম পাসের কাছে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত এই রাস্তা গিয়েছে গালওয়ান উপত্যকা হয়ে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লাগোয়া এই রাস্তা নিয়েই মূল আপত্তি চিনের।

• মে মাসের গোড়াতেই পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা, নাকু লা এবং প্যাংগং হ্রদের উত্তর প্রান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতীয় এলাকায় কয়েক কিলোমিটার অনুপ্রবেশ করে চিনা ফৌজ। তারা রীতিমতো তাঁবু খাটিয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসে।
• ৫ মে: প্যাংগং হ্রদের কাছে ভারতীয় ও চিনা সেনার ধস্তাধস্তি। তার পর থেকেই বেশ কয়েকটি এলাকায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল দু’দেশের সেনা। দারবুক-শাইয়োক-দৌলত বেগ ওল্ডি রোড নিয়ে আপত্তি আছে চিনের।
• ৫ জুন: বিদেশ মন্ত্রকের যুগ্মসচিব পর্যায়ে বৈঠক দু’দেশের।
• ৬ জুন: ভারতীয় ও চিনা সেনার কোর কমান্ডার স্তরে বৈঠক। তার পর থেকেই কিছু এলাকায় পিছিয়ে যায় দু’পক্ষের সেনা।
• ১০ জুন: ফের ডিভিশনাল কমান্ডার স্তরে দু’দেশের সেনার বৈঠক।

সূত্রের খবর, ওই এলাকায় উত্তেজনা কমানোর ব্যাপারে সোমবার রাতে চিনা সেনার সঙ্গে বৈঠক করেন কর্নেল সন্তোষ বাবু। প্রতিশ্রুতি মতো চিন পিছিয়ে গিয়েছে কি না, তা দেখতে বৈঠকের এক ঘণ্টা বাদে টহলে বেরোন তিনি। সঙ্গে ছিলেন জনা পঞ্চাশ জওয়ান। জানা গিয়েছে, এই সময়ে চিনা তাঁবুগুলো ভাঙতে শুরু করে ভারতীয় সেনা। সেগুলিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতের দিকে গালওয়ান নদীর দক্ষিণে চিনের একটি নজরদারি পোস্টও ভেঙে দেয় তারা।

এর পর চিনের প্রায় ২৫০ জন সেনা ফিরে এসে ভারতীয় সেনাদের উপরে হামলা চালায়। শুরু হয় সংঘর্ষ। সেনা সূত্রে বলা হচ্ছে, চিনা সেনাদের হাতে কাঁটা লাগানো লাঠি ছিল। তাই দিয়ে তারা ভারতীয় সেনাদের আক্রমণ করে। গালওয়ান নদীর বুকেও দু’পক্ষের সংঘর্ষ হয়। আহত কয়েক জন জওয়ান জলের স্রোতে ভেসে গিয়েছেন বলে আশঙ্কা। তবে গোটা ঘটনাটি পূর্ব-পরিকল্পিত নয় বলেই ওই সূত্রের দাবি।

সোমবারই সীমান্তে উত্তেজনা কমাতে দু’পক্ষের ব্রিগেডিয়ার পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয়েছিল। দু’তরফের সেনা যখন পিছিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে ঐকমত্য হয়, তখনই এই অপ্রত্যাশিত রক্তপাত এবং প্রাণহানির ঘটনা।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ এ দিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে পূর্ব লাদাখের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। তার আগে দুপুরে স্থল, নৌ ও বায়ুসেনার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন তিনি। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়ত এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। বিকালে ফের রাজনাথের বাসভবনে বৈঠকে বসেন সেনা কর্তারা। সন্ধ্যায় বিদেশমন্ত্রীও বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তার পর রাত পর্যন্ত বৈঠক হয় মোদী ও অমিত শাহের।

এই ঘটনায় মোদী সরকারের কূটনীতি ও সামরিক নীতি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। লাদাখে জট কাটাতে ভারত-চিন আলোচনাও ধাক্কা খেল বলে মনে করা হচ্ছে। রাতে সেনার বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘দু’পক্ষের সেনা মুখোমুখি সংঘর্ষের অবস্থান থেকে সরে গিয়েছে। (তবে) ভারতীয় সেনা দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বদ্ধপরিকর।’’

অন্য দিকে, চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়াংয়ের হুঁশিয়ারি, ‘আজকের ঘটনার পরে আমরা খুবই কড়া ভাবে জানাচ্ছি, ভারত যেন সংশ্লিষ্ট চুক্তিগুলি মেনে চলে। তাদের সেনাদের সংযত হতে বলে। তারা যেন সীমান্ত পার না-হয়।’ তাঁর দাবি, তাদের সেনা শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক করে গুরুত্বপূর্ণ ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। কিন্তু ১৫ জুন ভারতের সেনা সেই ঐকমত্য ভেঙে দু’-দু’বার সীমান্ত পেরিয়ে চিনা সেনাকে আক্রমণ করে।

সীমান্তে ভারত ও চিনের সেনাদের মধ্যে হাতাহাতি লেগে থাকলেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটল ৪৫ বছর পরে। ১৯৭৫ সালে অরুণাচল প্রদেশের টুলুং লা-য় অসম রাইফেলসের টহলদার বাহিনীর চার জওয়ানকে খুন করেছিল চিনা সেনা। ১৯৬৭ সালে সিকিমের নাথু লা এবং চো লা-য় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে অনুপ্রবেশকারী লাল ফৌজকে এলাকা ছাড়া করেছিল ভারতীয় সেনা। লাদাখ সীমান্তে হত্যার ঘটনা শেষ বার ঘটে ১৯৬২ সালে।

LAC India China Ladakh

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।