Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Barack Obama

কোভিড নিয়ে রোজ ডায়েরিতে লিখতেন প্রণব

গত দু’দশকে যাঁকে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে দোর্দণ্ডপ্রতাপে দেখেছি, তাঁকে গত কয়েক বছর ধরেই নিঃসঙ্গ এবং নির্বাসিত বলে মনে হত ওই বিশাল বাংলোয়।

বারাক ওবামাকে স্বাগত জানাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব।

বারাক ওবামাকে স্বাগত জানাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৬:২৯
Share: Save:

কাজটা ফোনেই হয়ে যেত। কিন্তু কিছুটা অবাক করেই প্রণব মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘বাড়িতে চলে আয়। আলোচনা করেই লিখব।’’

শরীর-স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক ও সাবধানী প্রণববাবু। বললাম, ‘‘আমি বাইরে থেকে যাব, কোনও সমস্যা নেই তো?’’ ফোনের ও-পার থেকে একই উত্তর এল। ৬ অগস্ট, অর্থাৎ তাঁর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চার দিন আগে, ১০ রাজাজি মার্গে তাঁর বাংলোয় পৌঁছে গিয়েছিলাম এর পর। একটি লেখা ওঁকে দিয়ে লেখাতে। মূল কাজের পাশাপাশি কথা হয়েছিল কোভিড নিয়ে। বললেন, ‘‘আমি তো এখন রোজ ডায়েরিতে কোভিড নিয়ে লিখি। এর শেষ কবে কে জানে। হয়তো এই কোভিড থাকতে থাকতেই চলে যাব।’’

বুকটা এক বার ছ্যাঁৎ করে উঠল। কিন্তু তার মেয়াদ বেশি ক্ষণ নয়। কারণ তত ক্ষণে তিনি চলে গিয়েছেন উনিশ শতকের বাংলার ইতিহাসের একটি বিশেষ সময়ে। কাজ শেষে ওঠার সময়ে বললেন, ‘‘আগামী সপ্তাহে টেলিফোন করে (কখনও ফোন বলতে শুনিনি তাঁকে, সর্বদাই টেলিফোন) চলে আয়। চিন নিয়ে আলোচনা করব।’’

আরও পড়ুন: ভালবাসতেন, চোখের জলও ফেলিয়েছিলেন

ওঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায়ান্ধকার লাটিয়েনস দিল্লির রাস্তা দিয়ে অফিসে ফিরতে ফিরতে একটা অস্বস্তি কাজ করছিল। একেই কি ‘প্রিমনিশন’ বলে? গত দু’দশকে যাঁকে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে দোর্দণ্ডপ্রতাপে দেখেছি, তাঁকে গত কয়েক বছর ধরেই নিঃসঙ্গ এবং নির্বাসিত বলে মনে হত ওই বিশাল বাংলোয়। কিন্তু ছ’তারিখ রাতটা যেন আরও বেশি অন্ধকার। এক কালে পাইপ ছেড়েছিলেন। তার পর স্তূপাকৃত ফাইলে সই, দেশ-শাসন আর দিনের আঠারো ঘণ্টার কর্মব্যস্ততাকে ছুটি দিয়েছিলেন। এ বার কি অন্তিম অবসরের এত কাছে পৌঁছে গেলেন যে, চলে যাওয়ার কথা বলছেন?

আরও পড়ুন: গত ৫০ বছরে তাঁর জীবন দেশের গত ৫০ বছরের ইতিহাস, প্রণব কন্যাকে চিঠি সনিয়ার

ঠিক আঠারো বছর আগের এক গ্রীষ্ম-দুপুরে প্রথম বার ওঁর ১৩ তালকাটোরা রোডের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সঙ্গে এক ব্যাগ বেকুব প্রশ্ন। তখনও ওঁর মাথায় যথেষ্ট চুল, এবং টানটান স্বাস্থ্য। বুঝেছিলেন, দিল্লির রাজনীতি সম্পর্কে নিতান্তই অজ্ঞ একটি রিপোর্টার এসেছে। সামান্য প্রশ্রয় দিয়েছিলেন সে দিন, সে কারণেই হয়তো। এবং সেই শুরু এক অত্যাশ্চর্য যাত্রার, যা এখনও শেষ হয়েছে বলে আমার অন্তত বিশ্বাস হচ্ছে না।

তাঁর প্রথম দিনের সামান্য প্রশ্রয় পরবর্তী কালে দরাজ হয়েছে। আর আমার সুযোগ ঘটেছে একের পর এক স্কুপ চোখের সামনে ঘটতে দেখার। বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করা হয়েছে। দৌড়েছি সাউথ ব্লকে। প্রণববাবু পাকিস্তান পরিস্থিতি বোঝাচ্ছেন, দ্রুত নোট নিচ্ছি। হঠাৎ সামনে রাখা ল্যান্ডলাইনে ফোন এল। কান খাড়া করে অন্য দিকে উদাসীন ভাবে তাকিয়ে আমি। একতরফা কথাতেই বোঝা গেল কে এবং কেন ফোন করেছেন। সনিয়া গাঁধী যেতে চান পাকিস্তানে, তাঁর পারিবারিক বন্ধুর শেষকৃত্যে। তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ঝাড়া আধ ঘণ্টা বোঝালেন, কেন তা সম্ভব নয়। এত বড় নিরাপত্তার ঝুঁকি নেওয়া সরকারের পক্ষে অসম্ভব। গোটা বিষয়টির সাক্ষী থেকে কপি করলাম।

প্রথম বার বারাক ওবামা দিল্লি এসে রাষ্ট্রপতি ভবনে ডিনার করেছেন। সেখানে অনেক অফ দ্য রেকর্ড আড্ডাও হয়েছে। রাতে সটান প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি (যত দিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ভবনে যাননি, তাঁর তালকাটোরা রোডের বাড়িতে রাত বারোটা পর্যন্ত ছিল অবাধ দ্বার)। জানলাম, খাবার টেবিলে ওবামা কৌতূহলী হয়ে প্রণবের কাছে সবিস্তার জানতে চেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্টদের হাল হকিকত। তাদের সরানোর জন্য তাঁর দল, অর্থাৎ কংগ্রেস কী ভাবে চেষ্টা করছে! মনে আছে, ঊর্ধ্বশ্বাসে এর পর অফিস দৌড়েছিলাম এই স্কুপ ধরানোর জন্য।

এমন সব ঘটনা বলতে শুরু করলে, আর শেষ হবে না। সম্ভবত ২০০৮ সালে সার্ক সম্মেলন বসেছিল শ্রীলঙ্কায়। বিদেশমন্ত্রী হিসেবে প্রণববাবু গিয়েছেন দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে, সঙ্গে আমিও। শেষ রাতে সমুদ্রের ধারে চলছে সে দেশের সরকারের খানাপিনার উৎসব। সমস্ত দেশের মন্ত্রী-অফিসাররা সেখানে ঢিলে মেজাজে। শুধু প্রণববাবু নেই। বিদেশ মন্ত্রকের তৎকালীন মুখপাত্র নভতেজ সারনা জানালেন, উনি তাজ সমুদ্র হোটেলে নিজের সুইটেই রয়েছেন। তখন নিরাপত্তার প্রবল কড়াকড়ি টাইগার অধ্যুষিত লঙ্কায়। কোনও ভাবে পৌঁছে গিয়েছিলাম ওঁর কাছে। দেখি বিরাট পাঁচতারা সুইট যেমন, তেমনই পড়ে রয়েছে। উনি ভিতরের অন্ধকার ঘরের একটি কোণায় টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বসে বাংলা উপন্যাস পড়ছেন! পরনে ফতুয়া ও লুঙ্গি (আমেরিকাতে যান বা রাশিয়া, এটিই বরাবর ছিল তাঁর রাতের পোশাক)। আমি যাওয়াতে পাঠে ব্যাঘাত হল বটে, কিন্তু বাংলায় কথা বলার সুযোগ পেয়ে একটু খুশিই হয়েই টাটকা খবর দিয়েছিলেন, যা পরের দিন আনন্দবাজারে এক্সক্লুসিভ হয়।

এক বার আমেরিকা সফরে যাচ্ছেন প্রণববাবু। সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। উনি তো উঠেই এয়ার ইন্ডিয়ার নির্ধারিত ভিআইপি কেবিনে। ঘটনাচক্রে আমার পাশের সিটেই দেখি, বিষেণ সিংহ বেদী। উড়ানের এক ঘণ্টার মধ্যেই ভারতের এই প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়কের চার পেগ নেমে গিয়েছে! এবং বায়না, প্রণববাবুর সঙ্গে এক বার দেখা করিয়ে দিতে হবে। কী করে বোঝাব এই অবস্থায় সেটা মুশকিলই নয়, না মুমকিন! যাই হোক নিউ ইয়র্কে পৌঁছনোর কিছু আগে অফিসারদের বলে সাক্ষাৎকার হল। ‘‘দাদা আপনি একসঙ্গে এত কাজ করেন কী করে!’’ বলেছিলেন লেগ স্পিনার!

সকালের নিত্যপুজো এবং অন্তত পাঁচটি কাগজ পড়ার সময়টুকুই শুধু ছিল ব্যক্তিগত। তাঁর বাকি সময়টা ছিল রাষ্ট্রের দখলে! মন্ত্রকের স্তূপাকার ফাইলের মধ্যে ডুবে থাকা, মন্ত্রিসভার আলোচ্যসূচিতে চোখ বোলানো, সংসদ চলাকালীন নিত্যনতুন সঙ্কটমোচনের সূত্র সন্ধান, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে বৈঠকের পর বৈঠক— সব সেরে রাতে যখন ১৩ তালকাটোরা রোডের বাড়িতে পৌঁছতেন, তত ক্ষণে বাইরের ঘরে অপেক্ষমাণ মিনি ভারতবর্ষ! বিভিন্ন রাজ্যের ছোট-বড় নেতা, প্রার্থী, মুখ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যকর্তা, শিল্পপতি, অধ্যাপক, সাংবাদিক, গায়ক— কে নেই সেই তালিকায়! কংগ্রেসের আদি রেওয়াজ মেনে সেটি এক নেতার দরবারই যেন বা। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রয়োজন ও ওজন বুঝে সময় দিতেন। আর সব সেরে রাত ১২টার পর বিখ্যাত লাল ডায়েরিতে প্রিয় শেফার্স কলমে লিখতে বসতেন দিনলিপি।

আবার এই মানুষটাকেই দেখেছি নিজের ছোটবেলার গ্রামের গল্পে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে যেতে, কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করতে, হালফিলের বাংলা কবিতা সম্পর্কে খোঁজ নিতে।

‘‘আগামী সপ্তাহে টেলিফোন করে চলে আসিস…।’’

মাথার ভিতর ঘুরছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Barack Obama Pranab Mukherjee Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy