ফাঁসির দড়ি তৈরি হচ্ছে বকসর জেলে। ছবি: শাটার স্টক।
২৩ বছরের ভগৎ সিংহকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হবে। একই সঙ্গে ফাঁসি দেওয়া হবে সুখদেব এবং রাজগুরুকেও। দড়ি তৈরির জন্য নির্দেশ এল বিহারের বকসর জেলে। দড়ি লাগবে তিনটি। নির্দেশ মতো কাজ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু যে কয়েদিদের হাতে দড়ি তৈরির ভার, বেঁকে বসলেন তাঁরাই। গোরা সাহেবদের ‘আবদার’ রাখতে মাটির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা! কক্ষণও না! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। হাত গুটিয়ে বসে রইলেন সকলে।
বেজায় চটলেন জেলের সুপার রবিনসন সাহেব। হুকুম এল, ‘‘এত স্পর্ধা! দাও দেখি ঘা কতক। বাপ বাপ বলে কাজ করবে।’’ হুকুম তামিল হতে সময় লাগল না। কিন্তু, কোথায় কী! বরং কালশিটে পড়ে যাওয়া চোখগুলো তখন আরও স্থির। সাহেব বুঝে গেলেন, এ কম্মো হওয়ার নয়। পরে ফাঁসির দড়ি কোত্থেকে এসেছিল তা যদিও জানা নেই, তবে টুকটাক কাজের বরাত পাওয়া কাঠের মিস্ত্রিই হন বা চুলে পাক ধরা কনস্টেবল— এক বার ভাব জমিয়ে ফেলতে পারলেই দেশের অন্যতম প্রাচীন জেলখানা সম্পর্কে এ রকম অজস্র মণিমুক্ত উঠে আসবে।
কেন্দ্রীয় কারাগার বকসর–এর পরতে পরতে এমন অনেক গল্প জড়িয়ে। ১৮৫৬-য় এই জেলখানা তৈরি হয়। সেখানে সুতোর কারখানা গড়ে ওঠে ১৮৮০-তে। মেশিনের সাহায্যে তুলো থেকে সুতো তৈরির সঙ্গে তখন সবে পরিচিত হচ্ছে ভারত।
তবে আজ যে কারণে এই জেল পরিচিত, তা হল, ফাঁসির দড়ি। বকসরই একমাত্র জেল, আজও যেখান থেকে দেশের সর্বত্র ফাঁসির দড়ি সরবরাহ করা হয়। তিহাড় বা ইয়েরওয়াড়ার মতো ‘নামডাক’ যদিও নেই বকসরের। দ্বিতীয় শ্রেণির জেল এটি। তবে, খুনের মামলায় জড়িত কুখ্যাত আসামি বা অপরাধীদের রাখা হয় সেখানে। তাদের দিয়েই দড়ি তৈরি করানো হয়। তবে কী জন্য দড়ি তৈরি হচ্ছে, তা গোপনই রাখা হয়। দড়ি তৈরির বরাত দেওয়ার সময় জেল কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠি আসে। তাতে অপরাধীর উচ্চতা এবং ওজনের উল্লেখ থাকে। তাই দড়ি যে ফাঁসির জন্যই তৈরি করতে হবে, তা বুঝে যায় ওরা।
বকসর কেন্দ্রীয় কারাগার। ছবি: পিটিআই।
কিন্তু, এই কাজের জন্য বকসর জেলকেই কেন বেছে নেওয়া হল? জবাবে জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট বিজয় কুমার অরোরা বলছেন, ‘‘জোর দিয়ে তো কিছু বলতে পারব না। তবে এখানে আসার পর যা শুনেছি এবং নিজে যেটুকু বুঝেছি, তা হল— এর পিছনে আবহাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বকসর জেল গঙ্গার তীরে অবস্থিত, যার ফলে এখানকার বাতাসে আর্দ্রতা বেশি। ফাঁসির দড়ি তৈরি করার জন্য যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ আর্দ্র আবহাওয়ায় সুতোয় পাক পড়লে দড়ি যেমন মোলায়েম হয়, তেমনই পোক্ত। তবে, এখন এ সবের দরকার হয় না। কারণ, আজকাল রেডিমেড সুতোই এসে পৌঁছয় আমাদের কাছে।’’
আরও পড়ুন: কিছু মানুষ যারা আসলে মানুষই না, রাষ্ট্রকে তাদের ঝেড়ে ফেলতে হবেই
ফিলিপিন্সে কলাগাছ প্রজাতির একটি গাছের আঁশ থেকে তৈরি মোলায়েম দড়িকে ম্যানিলা রোপ বলা হয়। নোনা জলেরও কোনও প্রভাব পড়ে না বলে মাছ ধরার জাল তৈরি বা নৌকার কাঠামো বাঁধতে ওই দড়ি ব্যবহার করা হয়। তবে বকসর জেলে তৈরি ফাঁসির দড়ি এর থেকে আলাদা। বিশেষ ধরনের তুলো দিয়ে এই সুতো তৈরি হয়, যার পোশাকি নাম জে–৩৪। তুলোকে মোটা সুতোর প্যাঁচে জড়িয়ে, তার উপর মোম ঘষে আগে মোলায়েম দড়ি তৈরি করা হত। পঞ্জাবের ভাতিন্ডার ‘কটন কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া’ থেকে তার তুলো আসত। আজকাল রেডিমেড সুতো সরাবরাহ করা হয়। মেশিনে তা জড়িয়ে তৈরি হয় ফাঁসির দড়ি।
ফাঁসির দড়ি তৈরি। এ বার পরীক্ষা হবে, বকসর জেলে। ছবি: আই স্টক।
বিজয় কুমার অরোরা জানিয়েছেন, একগাছা দড়ির জন্য সাধারণত পাঁচ–ছ’জন লোক লাগে। ১৫৪-স্ট্র্যান্ডের সরু সুতো পাকিয়ে চাহিদা মতো দৈর্ঘ্য-ব্যাসের দড়ি বানানো হয়। প্রতিটি দড়িতে ৭ হাজারের মতো এই রকম সুতোর দরকার পড়ে। অপরাধীর উচ্চতার অনুপাতে দড়ির দৈর্ঘ ১.৬ গুণ রাখা হয়। দড়ি মজবুত বানানো হয়, যাতে ওজন ধরে রাখতে পারে। তাই অপরাধীকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর আগে, সমান ওজনের বস্তা ঝুলিয়ে দড়ি পরীক্ষা করে নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: মৃত্যুদণ্ড হত্যার শৃঙ্খলকেই বাড়িয়ে চলে, অপরাধ কমায় না
জেলার সতীশকুমার সিংহের কথায়, ‘‘দড়ি তৈরির শেষ ধাপটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সুতোয় পাক দিয়ে আমরা এখান থেকে দড়ি তৈরি করে পাঠিয়ে দিই। তার পর হয় ফিনিশিং। মোম ঘষে দড়িকে নরম ও মোলায়েম করতে হয়। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী, দড়ির চাপে অপরাধীর মৃত্যু হলেও, তার গলায় আঘাতের চিহ্ন থাকা চলবে না।’’ তবে মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের দিয়ে তাঁরা দড়ি তৈরি করান না বলে জানিয়েছেন সতীশ। যারা যাবজ্জীবন বা কয়েক বছরের সাজা খাটছে, তাদেরকেই এই কাজে লাগানো হয়। সব মিলিয়ে ১০–১৫ দিন লাগে একটা ফাঁসির দড়ি তৈরি করতে।
তিহাড় জেল। এখানেই ফাঁসি হল নির্ভয়া-কাণ্ডের চার অপরাধীর—ফাইল চিত্র।
স্বাধীন ভারতে প্রথম মৃত্যুদণ্ড হয় মহাত্মা গাঁধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের। সেই ফাঁসির দড়ি তৈরি হয়েছিল বকসরেই। হেতাল পারেখ ধর্ষণ-খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়, ২০০১ সালের সংসদ ভবন হামলায় দোষী সাব্যস্ত আফজল গুরু, ১৯৯৩–এর মুম্বই ধারাবাহিক বিস্ফোরণে জড়িত ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির দড়িও এখানে তৈরি হয়। ২৬/১১ মুম্বই হামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আজমল কসাবের সময় নাকি আর নতুন করে দড়ি তৈরির বরাত দেওয়া হয়নি। আফজলের দড়িতেই তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয় বলে জানা যায়। নির্ভয়া-কাণ্ডে যে চার অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হল, তাদের ফাঁসির দড়িও তৈরি হয়েছে এখানেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy