Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Chief of Defence Staff

বিরাট বদল সেনার কাঠামোয়, সংযুক্ত কম্যান্ড গড়ছে ভারতীয় বাহিনী

দায়িত্ব নেওয়ার পরে এই প্রথম বার পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে মুখ খুললেন জেনারেল রাওয়ত।

‘ইন্টিগ্রেটেড কম্যান্ড’ তৈরি হতে চলেছে দেশের প্রত্যেকটি প্রান্তের জন্য জানালেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) জেনারেল বিপিন রাওয়ত।—ফাইল চিত্র।

‘ইন্টিগ্রেটেড কম্যান্ড’ তৈরি হতে চলেছে দেশের প্রত্যেকটি প্রান্তের জন্য জানালেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) জেনারেল বিপিন রাওয়ত।—ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

বিরাট মাপের পরিবর্তনের মুখে ভারতীয় সামরিক বাহিনী। স্থল, নৌ এবং বিমান বাহিনীর আলাদা আলাদা কম্যান্ড আর নয়, ‘ইন্টিগ্রেটেড’ বা ‘সংযুক্ত কম্যান্ড’ তৈরি হতে চলেছে দেশের প্রত্যেকটি প্রান্তের জন্য। জানালেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) জেনারেল বিপিন রাওয়ত। যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলা বা যে কোনও মুহূর্তে অভিযানের জন্য বাহিনীকে সর্বক্ষণ প্রস্তুত রাখতেই কাঠামো এ ভাবে ঢেলে সাজানো হচ্ছে— খবর প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের। বাহিনীর ইতিহাসে বৃহত্তম কাঠামোগত পরিবর্তন— বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্থলবাহিনীর প্রধান পদ থেকে অবসর নেওয়ার পরে দেশের প্রথম সিডিএস পদে আসীন হয়েছেন জেনারেল বিপিন রাওয়ত। দায়িত্ব নেওয়ার পরে এই প্রথম বার পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে মুখ খুললেন জেনারেল রাওয়ত। যা জানালেন, তাতে স্পষ্ট যে, দেশের সশস্ত্র বাহিনী খুব বড় পরিবর্তনের সামনাসামনি হতে চলেছে। তিন বাহিনীকে ‘একটি অবিচ্ছিন্ন সশস্ত্র বাহিনী’তে পরিণত করা তাঁর লক্ষ্য— জানিয়েছেন রাওয়ত। নতুন যে ‘মিলিটারি কম্যান্ড’গুলি তৈরি হতে চলেছে, সেগুলিতে তিন বাহিনীর সব রকমের যুদ্ধক্ষমতা, পরিবহণ ব্যবস্থা এবং লোকবলকে একছাতার তলায় আনা হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

সমর বিশারদ তথা অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তা কর্নেল সৌমিত্র রায় বলছেন, ‘‘এখন ভারতের সশস্ত্র বাহিনী তিন ভাগে বিভক্ত একটি বাহিনী হিসেবে কাজ করে। বাহিনীকে বিভিন্ন কম্যান্ডে ভাগ করেই রাখা হয়েছে। কিন্তু দেশের সব অংশেই স্থলসেনা, বায়ুসেনা, নৌসেনার আলাদা আলাদা কম্যান্ড। কোনও অভিযান চালাতে হলে বা কোনও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হলে তিন বাহিনীর বিভিন্ন রকম সক্ষমতাকে প্রয়োজন অনুসারে এক ছাতার তলায় আনার কাজ শুরু হয়। কিন্তু এটা একটা প্রচীন পদ্ধতি। আধুনিক অভ্যাস অন্য রকম। সেই অভ্যাস রপ্ত করার প্রক্রিয়াটাই শুরু হচ্ছে।’’

আরও পড়ুন: ‘দেশ ভাগের ষড়যন্ত্র’, শাহিন বাগ উচ্ছেদই চান মোদী

পশ্চিমে অর্থাৎ পাকিস্তান সীমান্তে ওয়েস্টার্ন কম্যান্ড এবং সাউথ-ওয়েস্টার্ন কম্যান্ড, উত্তরে অর্থাৎ তিব্বত ও নেপাল সীমান্তে নর্দার্ন কম্যান্ড, পূর্বে অর্থাৎ চিন, ভুটান, বাংলাদেশ, মায়ানমার সীমান্তে ইস্টার্ন কম্যান্ড, দক্ষিণ ভারতের জন্য সাদার্ন কম্যান্ড— এমন নানা ভাগ রয়েছে ভারতের স্থলসেনা ও বায়ুসেনায়। নৌসেনায়ও ইস্টার্ন, ওয়েস্টার্ন এবং সাদার্ন কম্যান্ড রয়েছে। কিন্তু তিন বাহিনীর এই সব কম্যান্ড আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হলে বা কোনও প্রতিপক্ষের সামরিক সঙ্গে সঙ্ঘাতে যেতে হলে প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করে এই তিন বাহিনীর নানা অংশকে এক ছাতার তলায় আনতে হয়। তার পরেই পুরোদস্তুর অভিযান শুরু করা যায়। কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৌমিত্র রায়ের কথায়, ‘‘এই পদ্ধতি আমাদের শিখিয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটিশরা। এবং সেই পদ্ধতিই এত দিন ধরে অনুসরণ করে আসা হচ্ছিল। কিন্তু আজকের যুগে এটা অচল। কারণ এই পদ্ধতিতে বাহিনীর নানা ইউনিটকে একত্রিত করতেই বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়।।’’

সেনাপ্রধান জেনারেল মুকুন্দ নরবণে, নৌসেনাপ্রধান অ্যাডমিরাল কর্মবীর সিংহ, সিডিএস জেনারেল বিপিন রাওয়ত ও বায়ুসেনা প্রধান রাকেশ কুমার সিংহ ভাদৌরিয়া।—ফাইল চিত্র

আর এক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ তথা বিএসএফের অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি সমীর মিত্রও একই কথা বলছেন। তাঁর মতে, ‘‘অপারেশনাল রেডিনেস বা যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুত থাকার প্রশ্নে ইন্টিগ্রেটেড কম্যান্ড খুব জরুরি। সেই লক্ষ্যেই বাহিনীর কাঠামোয় এই বড়সড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে বলে আমার মনে হয়।’’

জেনারেল রাওয়াত অবশ্য শুধু ‘অপারেশনাল রেডিনেস’-এর কথা বলেননি। তিনি বরং বলেছেন, খরচ কমিয়ে আনতে, লোকবল সংহত করতে এবং তিন বাহিনীকে একটি সংযুক্ত বাহিনী হিসেবে কাজ করাতেই ‘ইন্টিগ্রেটেড মিলিটারি কম্যান্ড’ তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা প্রায় সকলেই বলছেন যে, এই সবের মাধ্যমে আসলে বাহিনীকে ‘অপারেশনাল রেডিনেস’-এ পৌঁছে দেওয়ার পথেই এগোচ্ছেন রাওয়ত।

আরও পড়ুন: সারা দেশে এনআরসি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি, সংসদে জানাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক

এক একটা ইন্টিগ্রেটে় কম্যান্ডের চেহারা কেমন হবে? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন— দেশের যে সীমান্ত বা যে অঞ্চলের জন্য বাহিনীর যে রকম সক্ষমতা প্রয়োজন, সেই অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কম্যান্ডের অধীনে সেই সব রকমের সক্ষমতাই সমন্বিত করা হবে। অর্থাৎ নতুন করে তৈরি করা কম্যান্ডগুলিতে স্থলসেনার সঙ্গে বায়ুসেনার ইউনিটকে জুড়ে দেওয়া হবে। কোথাও নৌসেনার সঙ্গে বায়ুসেনা বা স্থলসেনাকে জোড়া হবে।

কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) রায়ের কথায়, ‘‘ধরা যাক পাকিস্তানের সঙ্গে সঙ্ঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হল। তখন শুধু স্থলসেনা বা শুধু বায়ুসেনা তো লড়বে না। স্থলসেনার ইনফ্যান্ট্রি বাহিনী, আর্টিলারি বাহিনী, আর্মার্ড বাহিনীকে যেমন কাজে লাগবে, তেমনই অ্যাটাক হেলিকপ্টার বা ফাইটার জেটেরও প্রয়োজন পড়বে। প্রয়োজন পড়বে অস্ত্রশস্ত্র, পণ্য ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা মজবুত রাখার। প্রয়োজন পড়বে ক্ষেপণাস্ত্রের। নতুন যে ইন্টিগ্রেটেড থিয়েটার কম্যান্ড’ তৈরি করা হবে, সেই কম্যান্ডের অধীনে এই সবই থাকবে। অর্থাৎ স্থলসেনা, বায়ুসেনা, নৌসেনা বি‌ভিন্ন থিয়েটার কম্যান্ডের অধীনে একসঙ্গে কাজ করবে।’’

এই ‘থিয়েটার কম্যান্ড’ শব্দবন্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— বলছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। আমেরিকা বা চিনের মতো বৃহৎ সামরিক শক্তি, এমনকী ইজরায়েলও এই ‘থিয়েটার কম্যান্ড’-এর ব্যবস্থা করে ফেলেছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন। স্থলসেনা বা বায়ুসেনার আলাদা আলাদা কম্যান্ড নয়, তিন বাহিনীর সব রকম সক্ষমতাকে এক ছাতার তলায় এনে স্বয়ংসম্পূর্ণ কম্যান্ড তৈরি রাখা— আধুনিক কৌশল এই রকমই। এত দিন পরে ভারতীয় বাহিনীও সেই পথেই এগোচ্ছে, তা সিডিএস-এর ঘোষণায় স্পষ্ট।

ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর কাঠামোয় এই বিরাট পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়া কত দিনে শেষ হবে? কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) রায়ের কথায়, ‘‘এটা ছোটখাট বিষয় নয়। কাগজে-কলমে লিখে দিলাম আর ইন্টিগ্রেটেড থিয়েটার কম্যান্ড তৈরি হয়ে গেল, বিষয়টা এমন নয়। ওয়েস্টার্ন থিয়েটারের প্রয়োজনীয়তা এক রকম। ইস্টার্ন থিয়েটারে আর এক রকম। এই সব প্রয়োজনীয়তা বুঝে এবং চিহ্নিত করে নিয়ে তিন বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে একে একে বি‌ভিন্ন কম্যান্ড হেড কোয়ার্টারে পাঠাতে হবে। সেখানে নানা রকমের প্রশিক্ষণ হবে। এক ছাতার তলায় এসে তিন বাহিনী কী ভাবে একসঙ্গে কাজ করবে, কী ভাবে একে অপরের পরিপূরক হবে এবং কী প্রক্রিয়ায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে, তা নিয়ে বার বার এক্সারসাইজ বা যুদ্ধাভ্যাস হবে। তবে গিয়ে থিয়েটার কম্যান্ড তার পূর্ণ কার্যকারিতায় পৌঁছবে।’’

প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের খবর, সিডিএস জেনারেল বিপিন রাওয়াত ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেছেন তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে। সেনা সূত্রে জানা গিয়েছে, অভিন্ন বাহিনী হিসেবে কাজ করার প্রক্রিয়া তিন বাহিনীর সামনেই স্পষ্ট করেত তুলতে কয়েকটি ‘এক্সারসাইজ’-ও ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। গোটা প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে বছর তিনেক সময় লাগবে বলে ওয়াকিবহাল মহল সূত্রের খবর। কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর ইতিহাসে এই বৃহত্তম কাঠামোগত পরিবর্তনকে অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন সমর বিশারদরা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy