দুই ভাই। মতিলাল দে এবং জামিনে মুক্ত রবি দে (ডান দিকে)। বরপেটার বাড়িতে। নিজস্ব চিত্র
জামিনে মুক্তি পেয়ে ৫৩ বছরের রবি দে প্রথমেই বললেন, ‘‘আজ না হয়, কাল বেরোতামই। ফাঁকতালে সরকারের টাকায় ছানি আর গলব্লাডারের অপারেশনটা হয়ে গেল!”
কৃষ্ণাইয়ের জাগ্রতপাড়া গ্রামের দে পরিবার অবশ্য বরাবরের সাহসী। কারণ, ডি-ভোটার আর বিদেশি তকমার সঙ্গে গত ১৯ বছর ধরে ঘর করছেন তাঁরা।
আশুডুবির সুব্রত দে-র জেলেই হার্ট অ্যাটাক হয়। আর বউ-ছেলে-মেয়েকে পথে বসিয়ে ঝুলে পড়েছিলেন ‘হঠাৎ কলোনির’ নিতাই দত্ত।
সপ্তাহখানেক আগে জামিন পাওয়া রবি দে কানে কম শোনেন। সেটাই কাল হল। ফরেনার্স ট্রাইবুনালে জেরায় ভুল উত্তর দেওয়ায় যেতে হল জেলে। তাঁর দাদা মতিলাল দের নামেও নোটিস আসে। কিন্তু হাইকোর্টে জিতে ভারতীয়ত্ব ছিনিয়ে এনেছেন তিনি। মতিলাল বলেন, ‘‘আমি ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রাম থেকে মালদহ এসেছিলাম। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে মা-বাবাকে মেরে ফেলার পরে দুই ভাই, এক বোনকেও নিয়ে আসি। অন্য ভাই এখনও ওখানে থাকে। বোনের বাড়ি মালদহে।’’ পরে বরপেটায় এসে থিতু হয়ে কাপড়ের দোকান দেন মতিলাল। অসম আন্দোলনের সময় তিনবার তাঁর দোকান পোড়ানো হয়। দমেননি। দমেননি ভাইয়ের বেলাতেও। মতিলাল ও রবিবাবুর কথায়, “হাইকোর্ট আছে, সুপ্রিম কোর্ট আছে। আমাদের বিদেশি সাজিয়ে জেলে আটকে রাখতে পারবে না।” মুক্তি দেওয়ার সময় পুলিশের তরফে সংবাদমাধ্যমকে অনুরোধ করা হয়, মুক্ত ‘বিদেশি’-দের সামাজিক নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ করবেন না। পাল্টা অনুরোধ করেছেন দে-ভাইয়েরা, ‘‘লিখবেন, নাম দিয়েই লিখবেন। মুখ পুড়বে বলেই পুলিশ কৃতকর্ম লুকোতে চাইছে।’’
কৃষ্ণাইয়ের সুব্রত দে-কেও এ ভাবেই সাহস জোগাতেন ডাকাবুকো রবিবাবু। সুব্রতের মা অণিমা আশুডুবির বাড়িতে বসে বলছিলেন, ‘‘কৃষ্ণাই জাতীয় সড়কে দোকান চালাত ছেলে। কিন্তু ভোটার কার্ড যখন এল, সুব্রতের নাম ছাপা হল সুবোধ দে। আর সুবোধ দে-র নামেই এল সন্দেহজনক নাগরিকের নোটিস।’’ সুব্রতবাবুর প্রাণের বন্ধু জাকির হুসেন বলেন, “উকিল ৭৫ হাজার টাকা নিয়েছে। অথচ ৮ বার শুনানিতে সুব্রতকে হাজির করায়নি। যখন বুঝল সুব্রত জেলে যাবেই, আমাদের পালিয়ে থাকতে বলল।”
২০১১ সালে বিদেশি ও নিখোঁজ ঘোষিত সুব্রতবাবুকে গত বছর ২৭ মার্চ গ্রেফতার করে জেলে পাঠায় পুলিশ। নিঃস্ব ও সন্ত্রস্ত সুব্রতবাবুকে সাহস দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেন রবি দে। লাভ হয়নি। সে বছরই ২৬ মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে জেলে মারা যান সুব্রতবাবু। স্ত্রী কামিনী জানান, ঘটনার পরে অনেকে প্রতিশ্রুতি দিলেও তেমন সাহায্য পাননি। বড় ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক দিতে পারেনি। চূড়ান্ত এনআরসিতে কারও নাম থাকবে, সেই আশাও কম। কিন্তু পরিবারের কাছে মামলা লড়ার টাকা আর নেই।
পাশের গ্রামের নিতাই দত্ত অবশ্য জেল পৌঁছনো পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি। নরম, ভীতু প্রকৃতির মানুষটা বাড়িতে পুলিশ হানা দেওয়ার পরেই কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। স্ত্রী শক্তি দত্ত বলেন, “মামলা লড়বে কি, কাজেইও যেত না ভয়ে।’’ ২০১৬ সালে বাড়ির কাছেই জঙ্গলে গাছে তাঁর ঝুলন্ত দেহ পাওয়া যায়। শক্তি চোখে ভাল দেখেন না। নবম শ্রেণিতে পড়া ছেড়ে দেওয়া মেয়ে পিয়া ব্যাগ সেলাই করে সংসার টানছে। ভাঙা ঘরে বসে এক ডজন ব্যাগ সেলাই করলে ৮ টাকা করে পায়।
কেঁদে ফেলে শক্তি বলেন, “দাদা, নিজের নামটাও মুখে আনতে লজ্জা হয়। বিশ্বাস করুন, এতটুকুও শক্তি আর বাকি নেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy