Advertisement
E-Paper

ওদের ঠাম্মির রেখে যাওয়া লাইব্রেরিই লকডাউনে নাতনিদের আশ্রয়

বন্দনা সেন তাঁর সারা জীবন ধরে ছোটদের জন্য লাইব্রেরি তৈরি করেছেন। তাঁর শেষ কাজটি ছিল তাঁর দুই নাতনি দেবিকা আর যামিনীর জন্য লাইব্রেরি গড়ে তোলা। বন্দনা সেন তাঁর সারা জীবন ধরে ছোটদের জন্য লাইব্রেরি তৈরি করেছেন। তাঁর শেষ কাজটি ছিল তাঁর দুই নাতনি দেবিকা আর যামিনীর জন্য লাইব্রেরি গড়ে তোলা।

খেলা আর পড়া যখন একাকার। ছবি সৌজন্য: স্ক্রোল.ইন।

খেলা আর পড়া যখন একাকার। ছবি সৌজন্য: স্ক্রোল.ইন।

হিমানি ডালমিয়া

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৩১
Share
Save

“মা, আমরা চাই না আমাদের সন্তানের জন্য কোনও সোনা-দানা বা টাকা-পয়সা তুমি ইনভেস্ট করো।’’ আমার স্বামী এক বিকেলে তাঁর মাকে বলেছিলেন। তখন আমার শাশুড়ি গুরুগ্রামের একটি আন্তর্জাতিক স্কুলের সঙ্গে যুক্ত। স্কুল ছুটির পর আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমার গর্ভে তখন সন্তান। সবে মধ্যদেশ খানিকটা স্ফীত হয়ে উঠছে। তখনই আমার শাশুড়ি জানতে চেয়েছিলেন, আমাদের অনাগত সন্তানের জন্য কী করতে পারেন।

উপহার নিয়ে ভাবতে বসলেই শাশুড়ি বরাবর চাপের মধ্যে পড়তেন। আমাদের জন্মদিনের অন্তত এক মাস আগে থেকে তিনি কী উপহার দেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করতেন। কেনাকাটার জন্য দিন স্থির করতেন। অতএব আমাদের যৌথ জীবনের এক অন্যতম সন্ধিক্ষণে তাঁর ভূমিকা কী দাঁড়াবে— তা নিয়ে তিনি রীতিমতো বিচলিত ছিলেন। কী উপহার দেওয়া যায়— এই ভাবনায় তিনি অস্থির। আবার চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে তিনি মোটেও খুব সনাতনপন্থী নন। বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর আলোচনা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, ঠাকুমা-ঠাকুর্দার তরফে দীর্ঘমেয়াদি এবং অর্থকরী উপহারের ব্যাপারটা নিয়ে তিনি সবিশেষ চিন্তিত।

ঠাম্মি আর দেবিকা। তখন থেকেই বইয়ের সঙ্গে বোঝাপড়া। ছবি সৌজন্য: স্ক্রোল.ইন।

আমি ওটা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাইনি। তখন সেই অবস্থাও ছিল না। বরং আমার চিন্তা জুড়ে ছিল সর্বক্ষণ বমি-ভাব, সন্তান প্রসব সংক্রান্ত বিষয়, বাচ্চার দেখাশোনা, সেই সংক্রান্ত কেনাকাটা এবং অবশ্যই মাতৃত্বকালীন ছুটি। সময় এলে উপহার নিয়ে ভাবা যাবে— এটাই কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে নিজেকে বলছিলাম।

আমার স্বামী ও তাঁর মায়ের কথোপকথনের দিকে মন দিতে গিয়ে খেয়াল করি, আমার শাশুড়ি আরও বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। এমন সময়েই আমার স্বামী আকাশ যেন একটা আইডিয়া পেয়েছেন, এমন স্বরে বলে ওঠেন, “মা, তুমি কী বলতে চাও?” তার পর স্বর নামিয়ে শান্ত ভাবে বলেন, “তোমার নাতি বা নাতনির জন্য তুমি তোমার সারাজীবনের কাজের স্বাক্ষরকেই উপহার হিসবে দিতে পারো— একটা লাইব্রেরি, যা তার একান্ত নিজের হবে।”

বাড়ির নিজস্ব লাইব্রেরিয়ান

আমার শাশুড়ি বন্দনা সেন পেশায় ছিলেন ছোটদের লাইব্রেরিয়ান। ১৯৯৯ সালে যখন আমি আকাশের সঙ্গে ডেট করা শুরু করি, আমরা দু’জনেই তখন হাইস্কুলে পড়তাম, সেই সময় আমি খুব ভাল বুঝতাম না তিনি ঠিক কী কাজ করেন। ভারতের অধিকাংশ স্কুলেই লাইব্রেরি মানে নিরস পাঠকক্ষ আর লাইব্রেরিয়ান মানে, যিনি বই ইস্যু করেন আর ক্যাটালগ বানান— এমনটাই ছিল আমার ধারণা। স্কুলের চৌহদ্দির বাইরেও এখানে লাইব্রেরি কালচার বলতে তেমন একটা কিছু যে নেই, তা স্বীকার করতেই হবে।

আরও পড়ুন: আগামী সপ্তাহে চালু ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোও

একদিন আকাশের মায়ের সঙ্গে আমেরিকান এম্ব্যাসি স্কুলে যেতেই আমার ভুল ভাঙল। তিনি যে জায়গাটিকে তাঁর ‘ওয়ার্ক স্পেস’ বলেন, তা যেন ডিজনিল্যান্ডের আর এক সংস্করণ। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বইয়ের তাকগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে, সেই ঘরের বর্ণ-বৈচিত্র দেখে, দেওয়ালে মন ভাল করা ছবি দেখে, রং-বেরঙের রিডিং কর্নার দেখে আমার বই-প্রেমী সত্তা নেচে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, বই হাতে নিয়ে ঘুরে বেরানো বাচ্চারা সত্যিই ভাগ্যবান।

এই হল আমাদের 'হোম লাইব্রেরি'। ছবি সৌজন্য: স্ক্রোল.ইন।

আমার মনে হয়েছিল, এটা কোনও লাইব্রেরি নয়। মনে হয়েছিল, এটা একটা শিল্পকর্ম, একটা অন্য অভিজ্ঞতা, একটা আন্দোলন। যিনিই এটা তৈরি করে থাকুন না, তিনি একজন শিল্পী, একই সঙ্গে তিনি এক চমকপ্রদ নাটকের পরিচালক, বিহ্বল করে দেওয়া কোনও অপেরার কন্ডাক্টর। এবং সেই ব্যক্তিটি আর কেউ নন, তিনি আকাশের মা। এগারো বছর পরে যিনি আমার শাশুড়ি হবেন, ষোলো বছর পরে যিনি আমার বাচ্চাদের ‘ঠাম্মি’ হবেন।

আমাদের প্রথম কন্যা দেবিকা জন্মায় ২০১৫-য়। তখন ঠাম্মি ৭০-এর কোঠায়। “প্রেমে পড়ার বয়স আর নেই”, তিনি বলেছিলেন, “আর তখনই আমি ঠাকুমা হলাম।” আকাশের বাবা মারা যান ২০০৬-এ। তার পর থেকে তিনি একাই থাকেন। তিনি বরাবরই স্বাধীনচেতা। গুরুগ্রাম ও নয়ডার পাথওয়ে স্কুলে তাঁর কর্মজীবন আর তাঁর চরকিপাক জীবনযাত্রা তাঁকে তুমুল ব্যস্ত রাখত। আকাশ মাঝে মাঝে মজা করে বলত, ভারতের রাষ্ট্রপতির অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া সহজ, কিন্তু তার মায়ের সঙ্গে দেখা করা অত সহজ নয়।

আরও পড়ুন: সংক্রমিত পুলিশ কমিশনার, মৃত এক অফিসার

কিন্তু দেবিকার জন্মের পরে ছবিটা বদলে গেল। ঠাম্মি একেবারেই আটকা পড়লেন। প্রতিদিনই কাজের পরে তিনি তাঁর ‘সোনামনা’-র সঙ্গ করতে চলে আসতেন। এমনিতেই তিনি যথেষ্ট টেকনো-ফোবিক। তবু ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টল করে নিলেন শুধু আমাদের শেয়ার করা দেবিকার ছবি আর ভিডিয়ো দেখতে। তাঁর গাড়িচালক জানিয়েছিলেন, লং ড্রাইভের সময় তিনি একমনে নাতনির ভিডিয়োই দেখে যেতেন। যামিনীর জন্মের পরেও তা-ই। ২০১৮ সালে তাঁর স্মরণসভায় বন্ধু ও সহকর্মীরা জানিয়েছিলেন নাতনিদের নিয়ে তিনি কতটা আপ্লুত ছিলেন। বেশির ভাগ সময় তাদের কথাই বলতেন।

শাশুড়ির মৃত্যু ছিল আকস্মিক, অভাবিত। আকাশ আর আমি স্রেফ বিমূঢ় হয়ে যাই। আমাদের আড়াই আর চার মাসের মেয়ে তাদের সব থেকে ভালবাসার মানুষকে হারায়। তাঁর সঙ্গে আরও কিছু বেশি সময় কাটানোর সুযোগই পেল না। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতির সব থেকে বড় স্মরণিকাটি হল, আমাদের নার্সারিতে তাঁর রেখে যাওয়া লাইব্রেরি। বইয়ের এক বিপুল ও বিস্ময়কর সংগ্রহ, যা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।

আমাদের বাড়ির দেওয়ালের অর্ধেকেরও বেশি জায়গা জুড়ে বুকশেল্‌ফ। তাতে হাজারেরও বেশি বই। ঘরের কানাচেও রাখা বইয়ের স্তূপ। কিন্তু আমরা জানি, ওই কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই তিনি চলে গিয়েছেন। আমাদের উপরেই ছেড়ে দিয়ে গিয়েছেন সেটা শেষ করার ভার। কিন্তু এটাও ঠিক যে, নাতনিদের জন্য তিনি এক আশ্চর্য সম্পদ উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গিয়েছেন।

পাথওয়েজ স্কুলের লাইব্রেরি। ছবি সৌজন্য: স্ক্রোল.ইন।

আমার শাশুড়ি তাঁর প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে উঠে দেবিকার জন্য লাইব্রেরি গড়ার কাজকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। মহা উৎসাহে তিনি বই সংগ্রহ শুরু করেন। যখনই তিনি আমাদের বাড়ি আসতেন, ব্যাগে অথবা বাক্সে বই বোঝাই করে আনতেন। আমার গর্ভ যত পূর্ণতা পাচ্ছিল, তত দ্রুত আমাদের বইয়ের তাকগুলো ভরে উঠছিল। বইগুলোর লেবেল ও ক্যাটালগ তৈরির জন্য তিনি এক তরুণ সহায়ককেও নিয়ে আসতেন। যিনি আবার এক্সেল শিটে বইয়ের তালিকা তুলে দিতেন।

শুধু বই নয়, তিনি প্রায়শই নিয়ে আসতেন পুতুল। ছোটদের প্রিয় ‘বেরেনস্টেইন বিয়ার’ অথবা ‘হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড থিংস আর’ নামের ফ্যান্টাসি ছবির চরিত্রদের স্টাফড ভার্সন। তাঁর পছন্দের সমস্ত কিছু তিনি ভাগ করে নিতে চাইতেন। নতুন কিছু এনেই আমাকে দেখিয়ে আনন্দ পেতেন। সঙ্গে আনা ঝকঝকে বইগুলো আমার সামনে ছড়িয়ে রেখে দিতেন। স্কটিশ শিশু সাহিত্যিক ডেবি গ্লিওরের কোনও বই বা আইরিশ চিত্রকর-লেখক অলিভার জেফার্সের কোনও উদ্ভট রসিকতা মেলে ধরতেন।

দেবিকার জন্মের পর যখনই আমাকে ঠাম্মি কাউচ-বন্দি হয়ে সন্তানকে দুধ খাওয়াতে দেখতেন, তিনি আমার পাশটিতে বসে তাঁরা আনা বইগুলো গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখাতে শুরু করতেন। সেই সব বইয়ের ছবি আর লেখা— দুই-ই আমরা উপভোগ করতাম।

একদিক থেকে দেখলে, আমার মেয়েরা গর্ভে থাকাকালীনই আমরা তাদের বই পড়ে শোনাতে শুরু করি। আকাশ বা আমাদের বাবা-মা’দের মধ্যে কেউ আমার পেটের দিকে তাকিয়ে গল্প বলতে শুরু করত। আমার কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হত। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার দিন থেকেই আমরা ওদের গল্প পড়ে শোনাতে শুরু করি। মার্কিন লেখিকা-ফোটোগ্রাফার টানা হোবানের বিখ্যাত সাদা-কালো অলঙ্করণের বই থেকে শুরু করে জন বাটলারের আঁকা জন্তু-জানোয়ারের ছবি অথবা ইংরেজ শিশু সাহিত্যিক জেজ আলবরোর চমকপ্রদ ছড়া— আমাদের বাচ্চারা বইয়ের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছে। বই আমাদের গোটা পরিবারকেই বেঁধে রেখেছে।

এতে ঠাম্মিরও সুখের অন্ত ছিল না। সে হিসেবে দেখলে আকাশের আইডিয়া ছিল ব্রিলিয়ান্ট! শুধু আমাদের সন্তানদের জন্য নয়। ওর মায়ের জন্যও। তিনি তাঁর জীবনের সব থেকে ভাল লাগার জায়গাটাকেই অনন্য ভাবে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

বই-প্রেম গড়ে ওঠার গল্প

বন্দনা সেনের জন্ম ১৯৪৩ সালে দার্জিলিঙে। তাঁরা তিন ভাই-বোন। দার্জিলিঙেই লরেটো কনভেন্ট আর লরেটো কলেজে তাঁর পড়াশোনা। কলেজে পড়েছিলেন ইতিহাস নিয়ে। এক হিসেবে তাঁর লাইব্রেরিয়ান হয়ে ওঠাটা আকস্মিকই বলতে হবে। ভুবনেশ্বরে একটা স্কুলে কিছুদিন পড়ানোর পর তিনি এয়ার ইন্ডিয়ায় স্টুয়ার্ডেসের চাকরির আবেদন করেন। কিন্তু উচ্চতা কম থাকায় সে চাকরি তাঁর হয়নি। সেই সময় কলকাতার ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিস (ইউএসআইএস)-এ তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরিয়ানের চাকরি পান। তাঁর বয়স তখন ২৩। সেই সময় চাকরিটা তাঁর একান্ত প্রয়োজনও ছিল। কারণ, তাঁর বাবা তখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত। জামাইবাবু হঠাৎ মারা যাওয়ায় বিধবা দিদি এবং তাঁর দুই সন্তানের দেখাশোনার ভারও তাঁকেই নিতে হয়েছিল। তাঁর বয়স তখন ২৫।

কলকাতার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে কিছুদিন হেড লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করার পরেই তিনি নয়াদিল্লির আমেরিকান এম্ব্যাসি স্কুল (এইএস)-এর লাইব্রেরিতে চাকরির প্রস্তাব পেলেন। সেখানেই তাঁর মেটামরফোসিস ঘটে গেল। এক সাধারণ গ্রন্থাগারিক থেকে তিনি হয়ে উঠলেন এক অ-সাধারণ লাইব্রেরিয়ান। ওই স্কুলেই আমার শাশুড়ি তাঁর মুক্ত, অনুসন্ধিৎসু আর সৃজনশীল মনের প্রকৃত পরিসর খুঁজে পেলেন। এই প্রতিষ্ঠানই তাঁর ভিতরের এক ম্যাজিশিয়ানকে বের করে আনল। যিনি তাঁর চৌহদ্দিকে বইয়ের প্রতি ভালবাসার চাইতেও খানিক বেশি কিছুর সঙ্গে পরিচয় করাতে সমর্থ।

দেবিকা আর যামিনীর পাঠ-পর্ব। ছবি সৌজন্য: স্ক্রোল.ইন।

তিনি এইএস-এ যোগ দেওয়ার আগে ওই স্কুলের লাইব্রেরিটি ছিল একটি ‘সিঙ্গল স্কুল লাইব্রেরি’। যার সিনিয়র সেকশনটা ছিল কিছু নীরস ডেস্ক আর চেয়ারের সমাবেশ। তিনি সেখানে এক বর্ণময় চিল্ড্রেন্স কর্নার তৈরি করেছিলেন। যেখানে একটি পৃথক এলিমেন্টারি স্কুল লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয়। সেখানে তিনি তাঁর অভিরুচি মতো এক পরিমণ্ডল গড়ে তোলেন। নিচু বুক শেলফ, একটা অ্যাম্ফিথিয়েটার, স্টেজ, রং-বেরঙের কুশন, চোখ ধাঁধানো দেওয়াল-ছবির সঙ্গ দিতে শুরু করে জীবজন্তুর পুতুল, মুখোশ, দেশবিদেশের খেলনা আর শিল্পবস্তু।

তাঁর গড়ে তোলা লাইব্রেরিগুলি নিছক পাঠকক্ষ ছিল না। এক হিসেবে দেখলে সেগুলি ছিল একেকটি সাংস্কৃতিক পরিসর। বইকে তিনি শিল্পবস্তু হিসেবে দেখতেই ভালবাসতেন। যাদের বোঝার জন্য এক বিস্তৃত প্রেক্ষিত প্রয়োজন। তাঁর বহুকালের সহকর্মী পেগি সুদ (এইএস-এর প্রাক্তন শিক্ষিকা এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রিন্সিপাল) তাঁর লাইব্রেরিকে ‘চ্যাপেল’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, লাইব্রেরিতে ঢুকলেই একটা বিস্ময় আর শ্রদ্ধা তৈরি হত।

আমার শাশুড়ি ক্লাসরুম আর লাইব্রেরির মধ্যে কোনও প্রভেদ দেখতেন না। তিনি লাইব্রেরিকে একটি প্রাণবন্ত পাবলিক স্পেস হিসেবেও দেখতেন। স্কুল আওয়ারে অনেক সময় সেখানেই স্টাফ মিটিং হত। সেখানে একটা ছোট কিচেনও ছিল। যেখানে চা-কফি বা ছোটখাটো স্ন্যাক্স তৈরির ব্যবস্থা থাকত। তিনি নতুন লাইব্রেরির লাগোয়া শৌচাগারের উপরেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর আইডিয়াটা ছিল এমন যে, কিছুতেই যেন বাচ্চাদের এই স্বয়ংসম্পূর্ণ জগৎ ছেড়ে বাইরে যেতে না হয়। লাইব্রেরির প্রতিটি সেশনেই তিনি কোনও টেক্সট পড়ে শোনাতেন। তাতে চরিত্র অনুযায়ী কণ্ঠস্বর বদলাতেন। এমনকি, অনেক সময়ে তাতে সাউন্ড এফেক্টও সংযোজিত হতো। লাইব্রেরির জন্য আলাদা কর্মচারীরা ছিলেন। অভিভাবকদের মধ্য থেকে স্বেচ্ছাসেবীরাও ছিলেন। পেগি সুদ তাঁর স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন, “সব মিলিয়ে ওটা ছিল তাঁর নিজস্ব এক খুদে বাহিনী। যারা তাঁর প্রতি একান্ত অনুগত ছিল।”

ছোটদের সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে তিনি লাইব্রেরিকে একটা ফিজিক্যাল স্পেসের বাইরে নিয়ে গিয়ে বেশ কিছু অভিনব পরিকল্পনা করেছিলেন। পেগি সুদ জানিয়েছেন, একবার মিডল স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য বই লেখা ও চিত্রণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সে সব বই তিনি জয়পুরী কাপড়ে বাঁধিয়ে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের উপহার দেন। একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বিবিধ বিষয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক বই পড়ে শেষ করে ফেলার জন্য তিনি ‘রিড্যাথন’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। ওই প্রতিযোগিতা পড়ুয়াদের এমন সব বই পড়ে ফেলতে উৎসাহিত করত, যাতে তারা আগে কখনও হাতই দেয়নি! কবিতা, ফ্যান্টাসি, কল্পবিজ্ঞান জাতীয় সাহিত্য ধারাগুলির সঙ্গে এ ভাবেই তাদের পরিচয় ঘটে যেত।

বই সংগ্রহের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। বিভিন্ন প্রকাশনার গ্রন্থতালিকা খুঁটিয়ে পড়তেন। লাইব্রেরির বাজেট বরাদ্দ ঠিক কোথায় খরচ করতে হবে, সে বিষয়েও সজাগ থাকতেন। তহবিল যে সর্বদাই অঢেল আর সহজলভ্য ছিল, তা নয়। বিদেশের সেমিনার বা কনফারেন্সগুলিতে যাওয়ার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হত। এগুলির মধ্যে আমেরিকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক কনফারেন্সও ছিল। যতগুলিতে পারতেন যেতেন। নিজের দক্ষতা বাড়ানো, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, শিশু সাহিত্যিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা ছিল তাঁর লক্ষ্য। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিশু সাহিত্যিকদের অনেককেই তিনি স্কুলে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অ্যালিকি, রুথ হেলার, প্যাট্রিসিয়া লারকিন, মোডেসিয়া গারস্টেইন, পলা ড্যানজিগার, স্টিফেন কোল, স্টুয়ার্ট জে মারফি এবং অ্যালিসা সাটিন কাপুচিলির মতো ব্যক্তিত্বও ছিলেন। এই সব কর্মকাণ্ড নির্বাহের জন্য তিনি তহবিল সংগ্রহের অভিনব কিছু পন্থাও আবিষ্কার করেছিলেন। স্কুলে বাৎসরিক প্যানকেক ব্রেকফাস্ট ইভেন্টের মতো অনুষ্ঠান তিনি সেই উদ্দেশ্যে চালু করেছিলেন।

পড়া যখন বেঁধে রাখে সম্পর্ককে। অঙ্কন: তিয়াসা দাস।

ছত্রিশ বছর এইএস-এ চাকরি করার পর তিনি অবসর নেন। তাঁর কর্মকান্ডের ফলে অন্য অনেক স্কুলেই তাঁকে পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। তাঁর সুদূরপ্রসারী ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। এনসিআর-এর পাথওয়েজ স্কুলে তিনি ১২ বছর কাজ করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের স্কুল, লাইব্রেরি, রিডিং প্রোগ্রামে তাঁকে উপদেষ্টা হিসেবে নেওয়া হতো। ভারতের অধিকাংশ স্কুলের লাইব্রেরির অবস্থা তাঁকে হতাশ করত। তিনি লাইব্রেরি সংক্রান্ত ধারণাটাকেই বদলাতে চাইতেন। লাইব্রেরিয়ানদের শুধুমাত্র বইয়ের তালিকা-নির্মাতা অথবা মাছিমারা কেরানির খোলস থেকে বার করে এনে তাঁদেরও শিক্ষক বা পড়াশোনার তত্ত্বাবধায়কের স্তরে উন্নীত করতে চাইতেন।

পাথওয়েজ স্কুলে তরুণ লাইব্রেরিয়ানদের এক বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন তিনি। আড়াই বছর আগে তাঁর স্মরণসভায় আমরা বেশ কিছু তরুণীকে আক্ষরিক অর্থেই চোখের জল ফেলতে দেখেছিলাম। তিনি চলে যাওয়ার পরেই আমরা উপলব্ধি করি, তাঁর নিজস্ব কাজের ক্ষেত্রে তিনি কী বিপুল প্রভাব রেখে গিয়েছেন! ২০১৯ সালে যখন দিল্লিতে ওয়ান আপ চিল্ড্রেন্স লাইব্রেরি পুরস্কার বিজেতা দলবীর কাউর মদন ঘোষণা করলেন, জাতীয় লাইব্রেরি সংগঠনের জন্য লাইব্রেরিয়ান এবং স্কুল-প্রধানদের ‘বন্দনা সেন মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হবে, তখন আমরা বুঝতে পেরেছিলাম ঠিক কোন ধরনের উত্তরাধিকার তিনি রেখে গিয়েছেন।

লকডাউন লাইব্রেরি আর বাচ্চারা

আকাশ আর আমি ইদানীং মাঝে মাঝেই ভাবি, ঠাম্মি এই কোভিড-১৯ অতিমারির ব্যাপারটাকে কী ভাবে নিতেন। ভাবি, এমন পরিস্থিতিতে তিনি বেঁচে থাকলে আমরা তাঁকে আমাদের সঙ্গেই থাকতে বলতাম। জানি, প্রথমে দোনামনা করলেও তিনি পরে রাজি হতেনই। তাঁর প্রিয় শিশুরা তাঁকে ঘিরে থাকত এবং তিনিও নিশ্চিত ভাবে মেনে নিতেন, সেটাই তাঁর জন্য সব থেকে ভাল ব্যবস্থা।

কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে তাঁর উদ্যম জিইয়ে রাখলেও তিনি খানিকটা দমেও যেতেন। দীর্ঘকাল বিচ্ছিন্ন থাকার মানুষ তিনি ছিলেন না। সিনেমা, থিয়েটার, সঙ্গীত, শিল্পকলা আর সুখাদ্যের প্রতি তাঁর তীব্র ভাললাগাকে তিনি কী ভাবে দমিয়ে রাখতেন? নিয়মিত সিনেমা, কনসার্ট, প্রদর্শনী, সেমিনার আর রেস্তরাঁয় না গেলে যাঁর চলত না, তিনি এই সময়ে কী করতেন?

ঠাম্মির প্রিয়তম ভ্রমণের জায়গা ছিল বইয়ের দোকান। সেই সব দোকানের মালিকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও ছিল নিবিড়। আমাদের বাড়ির লাইব্রেরির জন্য তিনি দিল্লির জোড়বাগের বইয়ের দোকানের অংশীদার সোনাল নারেইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করেছিলেন। প্রতি বৃহস্পতিবার তিনি তাঁর স্কুল লাইব্রেরির জন্য সেখানে বই কিনতে যেতেন আর সেই সঙ্গে নাতনিদের জন্যেও পরের কিস্তিটি হস্তগত করতেন।

সোনাল নারেইন বলেন, ‘২০১৩ সালে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আমার শাশুড়ি বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি আর খুব বেশি বাইরে বেরোতে পারবেন না। তাই একটু বড় বাচ্চাদের জন্য লেখা বই যেমন ই বি হোয়াইটের ‘শার্লট’স ওয়েব’-এর মতো উপন্যাস সংগ্রহ করতে শুরু করেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, কেন তিনি ওই ধরনের বই কিনছেন। তিনি জানান, তিনি তাঁর লাইব্রেরিকে এমন করেই গড়ে যেতে চান যে, দশ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চারা তা ব্যবহার করতে পারবে।”

বইয়ের ভিতরে ডুব দিয়ে অরূপরতনের সন্ধান। অঙ্কন: তিয়াসা দাস।

দূর ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি হয়তো খুবই ভাবিত ছিলেন। কিন্তু এ কথা তিনি ভাবতেও পারেননি যে, তাঁর চলে যাওয়ার দু’বছর পরেই এক অতিমারির পরিস্থিতিতে তাঁর গড়ে যাওয়া লাইব্রেরিটি আশ্চর্য ভূমিকা পালন করবে। প্রি-স্কুলগুলো বন্ধ, খেলার সময়ও উধাও, পার্ক আর খেলার জায়গাগুলোও ধরাছোঁওয়ার বাইরে। বাইরে বেরিয়ে যেতে উদগ্রীব দুই শিশুকে নিয়ে ঘরবন্দি অবস্থায় আমরা এই অনভ্যস্ত নতুন জীবনে বাঁচার ছন্দ খুঁজছিলাম । মাসের পর মাস কাটিয়ে একটা ব্যবস্থায় এসে পড়া গেল শেষ পর্যন্ত। বড় মেয়ের জন্য ভার্চুয়াল ক্লাস, ছবি আঁকা, ক্রাফট তৈরি, নাচ-গান, ধাঁধা ইত্যাদি এবং নিয়ম করে আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করা— এ ভাবেই আমরা নতুন রুটিনকে ছকে নিয়েছি। আর যেটা আমাদের দৈনিক কাজের মধ্যে রয়েছে, সেটা হল বই পড়া। এমনিতেই আমরা রোজ বই পড়ি। এখন সেই মাত্রাটা দ্বিগুণ। লাইব্রেরিতে কাটানোর সময় অনেকখানি বেড়ে গেল। না-পড়া বইগুলোকে ঘেঁটে দেখা শুরু হল আরও বেশি করে। বাড়ির লাইব্রেরিটাই হয়ে দাঁড়াল আমাদের আনন্দ আর স্বস্তি পাওয়ার আশ্রয়। অন্তর দিয়ে বুঝলাম, ঠাম্মির ওই ‘হোম লাইব্রেরি’ না থাকলে এ ভাবে প্রতিদিন বইয়ের সাহচর্য পাওয়া সম্ভব ছিল না।

ছোটদের জীবনে ছ’মাস সময় বড় কম নয়। আমাদের ছোট মেয়ের আড়াই বছরের জীবনের পাঁচ ভাগই ঘরবন্দি হয়ে কাটল। লকডাউন শুরু হওয়ার মুহূর্তটা যেন গত জন্মের ঘটনা বলে মনে হতে লাগল। আমাদের সম্তানদের উপর এই দশার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। মার্চ মাসে ওরা যেন অন্য মানুষ ছিল। এই অদ্ভুত সময়ে বহু কিছুই যেন হারিয়ে গেল জীবন থেকে। খানিক স্বস্তির শ্বাস ফেলার জন্য পাঁচ বছরের কমবয়সি দুই বাচ্চা নিয়ে যখন হাঁসফাঁস করছি, তখন অনুভব করলাম, এই পর্বে লাভও তো কম হল না!

পরে যখন আমরা এই সময়টার দিকে ফিরে দেখব, তার মধ্যে কিছু ভাল লাগা অবশ্যই থাকবে। যখন এই সময়জনিত ক্লান্তি আর উদ্বেগ আমরা ভুলে যাব, তখন স্মৃতিতে থেকে যাবে যে, এই সময়ে আমাদের সম্তানদের শৈশবের একটা বড় অংশের মুহূর্তগুলোকে আমরা উপভোগ করেছিলাম। ওরাও মনে রাখবে, বেড়ে ওঠার একটা বিশেষ সময় তারা তাদের বাবা-মায়ের অবাধ সাহচর্য পেয়েছিল। তাদের অনুভবের ভাঁড়ার পূর্ণ হয়েছিল এবং বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতাটা ছিল দ্রুত।

সর্বোপরি, বইয়ের সঙ্গে তাদের বন্ধন গড়ে ওঠার সময় ছিল এটা। প্রতিদিনই, প্রায় সারাদিন ওরা বই পড়েছে। বিছানায় শুয়ে বই পড়েছে, ভোর ছ’টায় ঘুম থেকে উঠে বই পড়েছে। ওদের খেলার সঙ্গীও হয়ে উঠেছে বই। ভার্চুয়াল স্কুল শুরু হওয়ার আগেও ওরা বই-ই পড়েছে। ওদের নানা-নানির বাড়িতে যখনই দেখা করতে গিয়েছি, তাঁরাও তাদের বই পড়েই শুনিয়েছেন। ওরা খাওয়ার সময়ে বই পড়েছে, বাথরুমে বসেও বই পড়েছে, রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগেও বই পড়েছে।

বই সময় কাটানোর সব থেকে ভাল মাধ্যম। ক্লান্তি দূর করার জন্যও অতুলনীয়। বাচ্চাদের শান্ত রাখতেও সব থেকে ভাল উপায়। আমরা রোজ কেক তৈরি করে আর খেলনা কেল্লা বানিয়ে ওদের ভুলিয়ে রাখতে পারি না। কিন্তু রোজ কিছু না কিছু পড়ে শোনাতে পারি।

অতিমারি শুরুর সময় যামিনীর বয়স দুই। তখন থেকেই ও বইপ্রেমী হয়ে উঠল। নিজে নিজেই বই বাছে, নিজে থেকেই সেই বই থেকে পড়ে শোনাতে আব্দার করে। ওর প্রিয় কোনও বই, যেমন অশোক রাজাগোপালনের লেখা মিষ্টি বই ‘গজপতি কুলপতি’ পড়ে শোনাতে শোনাতে যদি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি, চেঁচিয়ে ওঠে, “পড়ো! পড়ো! পড়ো!” বলে। েকই বই বার বার ওকে আর ওর খেলান জীবজন্তুদের পড়ে শোনাতে হয়। এই ভাবেই ওর মনে শব্দের ভাঁড়ার বাড়তে থাকে। ও কথা বলতে শেখে। একই বই আমরা দুই বয়সের দু’জনকে একসঙ্গে পড়ে শোনাই।

এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, ছোটদের এই ছবির বইগুলোর মধ্যে বহুস্তরীয় একটা ব্যাপার রয়েছে। এক এক বয়সের শিশু সেগুলো একেকরকম ভাবে উপভোগ করে। আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গিয়েছে ডেভিড ম্যাককি-র ‘এলমার’ বা নিক ব্ল্যান্ডের ‘দ্য ভেরি ক্র্যাঙ্কি বিয়ার’ অথবা শার্লি হিউজের ‘অ্যালাইফ’ সিরিজের বিভিন্ন বই পড়ে শোনাতে শোনাতে।

লকডাউনের দিনগুলোয় ঘরের চৌহদ্দিতেই তাঁবু খাটিয়ে পড়া-খেলা-পড়া। ছবি সৌজন্য: স্ক্রোল.ইন।

আমাদের ছোট মেয়ের এই সিরিজ-প্রেমের ব্যাপারটা গত কয়েক মাসের মধ্যেই গড়ে উঠেছে। ওর চাপে আমাদের আরও বেশি বই খুঁজে বের করতে হয়। কাহিনির জগতে আরও বেশি করে ডুব দিতে হয়। বড় মেয়ের বিরাট পছন্দের বই হয়ে ওঠে জুডিথ কারের লেখা ভুলোমন বিড়াল ‘মোগ’-এর সিরিজ। অতিমারির সময় আমাদের দুনিয়া আবর্তিত হতে থাকে পরিবার অথবা পোষ্যদের ঘিরে। সুতরাং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ‘মোগ’ অথবা এমা চিচেস্টার ক্লার্কের ‘ব্লু ক্যাঙ্গারু’-র কাহিনি ওর মনে গভীর রেখাপাত করবে। পাঁচ বছরের দেবিকা একটু জটিল গল্পের ভক্ত। ওর পছন্দ ডিটেল ইলাস্ট্রেশন, সাধারণ বইয়ের চাইতেও ঘনবদ্ধ কোনও কাহিনি। একটি বিরল বইয়ের দোকান থেকে আমি কিনেছিলাম মাইরি হেডারউইকের ‘কেটি মোরাগ’। ওর ঠাম্মির লাইব্রেরিতেই ছিল আর্নলড লোবেলের ‘ফ্রগ অ্যান্ড টোড’। এ সব ওর পছন্দের। ডিন হাল এবং শ্যানন হালের লেখা ‘প্রিন্সেস ইন ব্ল্যাক’ ওর খুবই প্রিয় বই। এতটাই যে, ‘ভার্চুয়াল স্কুল ড্রেস আপ’-এর দিনও রাক্ষসজয়ী সেই প্রিন্সেসের সাজে অবতীর্ণ হয়েছিল।

দেবিকা এখন এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যে, নিজে নিজে খুব একটা পড়তে পারে না। কিন্তু ওর পড়ার খিদে সাংঘাতিক। বিশেষ করে দীর্ঘ, ঘটনা-জটিল কাহিনিওয়ালা বই ওর খুব পছন্দের। শোনার ধৈর্য্যও বেশি। আতিমারির সময়েই আমরা অডিও বুকের মহিমা বুঝতে পারি। বহু বইপ্রেমী পরিবারেই সেটি বিপুল ভূমিকা নিয়েছে। ছবিহীন সেই বইয়ের রাজ্য দেবিকাকে কতটা আকর্ষণ করবে, তা নিয়ে আমাদের সংশয় ছিল। কিন্তু দেখা গেল, ও কেট উইন্সলেটের পড়া ‘দ্য ম্যাজিক ফারঅ্যাওয়ে’ এবং ‘দ্য উইশিং চেয়ার’ সিরিজে দিব্যি মন দিচ্ছে। লেখক পোপ ওসবোর্নের ‘দ্য ম্যাজিক ট্রি হাউস’ তার একান্ত প্রিয় হয়ে উঠেছে।

এই দিনগুলোয় ঠাম্মির কথা বার বার মনে পড়ে। তাঁর চলে যাওয়ার পর আমরা যে গভীর বেদনা মাসের পর মাস বহন করেছিলাম, তখন বার বার মনে হত আমাদের সন্তানদের যেসব ভাললাগা আর খুনসুটি ঠাম্মির সঙ্গে ভাগাভাগি করার কথা ছিল, সে সব অপূর্ণই থেকে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, ঠাম্মি তো চলে যাননি! আমাদের প্রতি মুহূর্তের জীবন যাপনে তিনি খুব বেশি করে বেঁচে রয়েছেন।

যখন দেবিকা একটা চোখ জুড়োন ছবি আঁকে, তখন টের পাই ঠাম্মি রয়েছেন। যখন যামিনী তার আধো আধো বুলিতে একটা পুরো বাক্য বলে আমাদের চমকে দেয়, তখনও টের পাই ঠাম্মি রয়েছেন। যখন আকাশ আর আমি মেয়েদের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কথা বলি, তখনও মনে হয় তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন। যখনই কোনও বই টেনে নিয়ে বাচ্চাদের পড়ে শোনাতে বসি, মনে হয়, ঠাম্মি থাকলে হয়তো এখন এই বইটাই টেনে নিতেন ওদের শোনানোর জন্য। নাতনিদের লাইব্রেরির জন্য কোনও বইয়ের দোকানে গিয়ে তাঁর বই ঘাঁটার আর নিজের মনে মৃদু হেসে ওঠার দৃশ্য মনে পড়ে।

বার বার মনে হয়, ঠাম্মি যদি তাঁর নাতনিদের প্রতিক্রিয়া দেখতে পেতেন। গত কয়েক মাসে বই কী ভাবে তাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের জীবনের কতখানি জায়গা অধিকার করে ফেলেছে, সেটা দেখলে তিনি কী খুশিই না হতেন! এমন একটা সময় যখন অভিজ্ঞতার বৃত্ত সীমিত হয়ে এসেছে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশাও বন্ধ, তখন দেবিকা আর যামিনী গুহামানবের বাচ্চাদের সঙ্গ করছে, হাইওয়ের ইঁদুরবাহিনী, নীল ক্যাঙ্গারু , জোড়াতালি দেওয়া হাতি, দুষ্টু রাজহাঁস, দয়ালু ড্রাগন, টুপি পরা বেড়াল, পাজামা পরা ইয়ামার সঙ্গে তাদের নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।

ঠাম্মি হয়তো তাঁর লাইব্রেরি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁর নাতনিদের জন্য রেখে গিয়েছেন দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার। তা হল— বইয়ের প্রতি, যা কিছু সুন্দর, সে সবের প্রতি অফুরান ভালবাসা।

(আর্টিকল সৌজন্য: স্ক্রোল.ইন)

Education Lockdown Library Bandana Sen

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।