Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus Lockdown

ছেলে কাঁধে ৩০০ মাইল হেঁটে গ্রামে ফিরেও ‘ঘর’ পেলেন না দয়ারাম

গ্রামের লোকেদের মধ্যেও দায়রামকে নিয়ে কানাঘুষো শুরু হয়ে গিয়েছে। একজন তো আতঙ্ক প্রকাশই করে ফেললেন।

ছেলে শিবমকে কাঁধে নিয়ে রাস্তায় নামেন দয়ারাম কুশওয়াহা। ছবি: রয়টার্স।

ছেলে শিবমকে কাঁধে নিয়ে রাস্তায় নামেন দয়ারাম কুশওয়াহা। ছবি: রয়টার্স।

সংবাদ সংস্থা
জুগইয়া শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২০ ২০:১৫
Share: Save:

লকডাউনের যে সব ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে আসছে, তার একটা বড় অংশ জুড়েই রয়েছেন মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্তরা। অধিকাংশেরই খাবারের নিশ্চয়তা রয়েছে। ফলে লকডাউন হয়ে দাঁড়িয়েছে এক বিরক্তিকর ছুটি। বিরক্তি কাটাতে কেউ ভিডিয়ো চ্যাট করছেন, কেউ বা ফেসবুক লাইভে গান গাইছেন। কিন্তু এর পাশে আর একটা ছবিও রয়েছে। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে চাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের মিছিল। সেখানে গান নেই, 'ছুটি' নেই, রয়েছে আগুপিছুহীন উৎকণ্ঠা।

এই উৎকণ্ঠার তাড়নাতেই স্ত্রী-পুত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন দয়ারাম। ভেবেছিলেন, না খেতে পেয়ে যদি মরতেই হয়, তাহলে নিজের বাড়িতে গিয়ে মরাই ভাল। শেষমেশ যদিও বেঁচেই ফিরেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর এই ফেরাটাই এখন গোটা গ্রামের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময় যে জ্ঞাতি-প্রতিবেশীদের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব ছিল, তাঁরাই এখন শহরফেরত দয়ারামকে বাঁকা চোখে দেখছেন। একটা পরিবারের জন্য গোটা গ্রামে মড়ক লেগে যাবে না তো-- এই আতঙ্কই এখন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সকলকে।

অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বছর কয়েক আগে দিল্লিতে পাথরের খাদানে যখন প্রথম কাজ করতে আসেন বুন্দেলখণ্ডের এক গ্রামের যুবক দয়ারাম কুশওয়াহা, তখন আশেপাশের সকলেই তাঁকে সাহস জুগিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন, বিয়ে-থা করে সংসারী হতে গেলে রোজগার তাঁকে করতেই হবে। সেই মতো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন দয়ারাম। তার কিছু দিন পরই তাঁর জীবনে আসেন জ্ঞানবতী। বোনপোর জন্য স্বজাতের জ্ঞানবতীকে পছন্দ করেছিলেন দয়ারামের মাসি। বিয়ের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জ্ঞানবতীর কোলে আসে প্রথম ছেলে মঙ্গল।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আরও পড়ুন: টানা তিন দিন হাঁটা, খিদে-তেষ্টায় বালিকার মৃত্যু গ্রামে পৌঁছনোর মুখেই​

কচি ছেলে আর জ্ঞানবতীকে রেখেই প্রথমে দিল্লি চলে আসেন দয়ারাম। ছেলের বয়স বছর দেড়েক হতে দিল্লি চলে আসেন জ্ঞানবতীও। স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতেন তিনিও। কিন্তু ফের গর্ভবতী হয়ে পড়েন জ্ঞানবতী। জন্ম হয় ছোট ছেলে শিবমের। দুই ছেলেকে নিয়ে কী ভাবে কাজ সামলাবেন, তা নিয়ে ফাঁপরে পড়েন দয়ারাম ও জ্ঞানবতী। ভেবেচিন্তে ঠিক করেন, মঙ্গলকে গ্রামে বাবা-মায়ের কাছে রেখে আসবেন। শিবম থাকবে তাঁদের কাছে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। তার পর খাদানের পাশে ত্রিপল খাটানো একটি ঘরে ১২ জনের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর কেটে গিয়েছে। মঙ্গলের বয়স এখন ৭। শিবমের ৫।

দু’জনে খেটে এত দিন মাসে মাসে বাড়িতে ৮ হাজার টাকা করে পাঠাচ্ছিলেন দয়ারাম ও জ্ঞানবতী। স্কুলে ভর্তি করতে না পারলেও, ধুলোবালিতে খেলতে খেলতে তাঁদের পাশে পাশেই বড় হচ্ছিল শিবম। কিন্তু এক লহমায় সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যাবে তা বুঝে উঠতে পারেননি দয়ারাম ও জ্ঞানবতী। কী একটা রোগ রাজধানীর অলিগলিতে ঢুকে পড়েছে বলে গত মাসের মাঝামাঝি থেকেই কানে আসছিল তাঁদের। তার পর এক দিন রাতারাতি কীসব যেন ঘোষণা করল সরকার, পর দিন থেকেই কাজ বন্ধ খাদানে।

পাথর ভাঙা, হাতে হাতে তা কড়াইয়ে তোলা এবং গিয়ে গাড়িতে ঢালার আওয়াজে উত্তর দিল্লির যে এলাকা একসময় গমগম করত, এক লহমায় দুনিয়ার নিস্তব্ধতা নেমে এল সেখানে। কাজ শেষ করে দিনের শেষে মোটামুটি ৪৬০ টাকার মতো হাতে আসত দয়ারাম ও জ্ঞানবতীর। কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, যেটুকু টাকা জমানো ছিল, তাতেই হাত বসাতে হল তাঁদের। আবার হাতে যে’কটি টাকা ছিল, দোকান-বাজার বন্ধ থাকায়, তা দিয়ে কিছু কিনে খাওয়ার উপায়ও ছিল না। তাই বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেবেন বলেই ঠিক করলেন দয়ারাম। কিন্তু বেরব বললেই তো আর বেরনো হয় না! চারিদিকে বাস-ট্রেন বন্ধ। দিল্লি থেকে মধ্যপ্রদেশে নিজের গ্রাম জুগইয়ায় পৌঁছবেন কী করে, তা ভেবেই মাথায় হাত পড়ে দয়ারামের। কিন্তু তাঁদের ভরসা জোগান ঝুপড়িতে থাকা আরও জনা পঞ্চাশ দিনমজুর। প্রত্যেকেই অন্য রাজ্য থেকে এসেছেন। প্রত্যেকেই বাড়ি ফিরতে উদগ্রীব।

জুগইয়ায় দয়ারামের বাড়ি।

সেই ভরসাতেই বাকিদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়েন দয়ারাম ও জ্ঞানবতী। ছেলেকে কাঁধে নিয়ে আগে আগে হেঁটে চলেন দয়ারাম। সম্বলটুকু বস্তায় ভরে মাথায় তুলে পিছু পিছু জ্ঞানবতী। ক্লান্ত হয়ে পথের ধারে জিরিয়ে নিতে গেলে লাঠি হাতে তেড়ে আসে পুলিশ। তাই কখনও পাকা আবার কখনও কাঁচা রাস্তা দিয়ে শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে যেতেই হয়। হাত দেখালে কখনও সখনও লরি বা ট্রাক তুলে নেয় তাঁদের। কিছুটা এগিয়ে আবার নামিয়ে দেয়। এ ভাবেই চারদিন ধরে কখনও হেঁটে, কখনও বা লরির পিছনে উঠে দিল্লি থেকে ৫০২ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বাড়ি পৌঁছন দয়ারাম ও জ্ঞানবতী।

পৌঁছেই বাড়ির ফসল রাখার ঘরের একপাশে শরীরটা এলিয়ে দেন দয়ারাম। উপায় থাকলে কখনও ঘর ছেড়ে দিল্লি ফিরে যেতেন না বলতে শোনা যায় দয়ারামকে। ছেলের কথা শুনে গলা চড়ান ৫৩ বছরের কেশরা। তাঁর কথায়, ‘‘পরিবার যেখানে থাকে, সেটাই ঘর। দিল্লিতে অন্তত টাকা তো আছে। যা দিয়ে কিছু মুখে তোলা যায়।’’ পরিবার দয়ারামের সঙ্গেই ছিল দিল্লিতে। কিন্তু দয়ারামের কাছে দিল্লি ছিল শুধুমাত্র অর্থোপার্জনের জায়গা। সে ফিরতে চেয়েছিল। আর পাঁচজন বিপন্নের মতো 'ঘর'-এ ফিরতে চেয়েছিল। মা বা অন্য আত্মীয়দের কাছ থেকে ক্রমেই বিপরীত ব্যবহার পেতে শুরু করে দয়ারাম। কারণ একটাই, সে বয়ে আনেনি তো মহামারির বীজ?

মধ্যপ্রদেশে নিজের গ্রামে পৌঁছনোর পরে স্বস্তির হাসি দয়ারামের। ছবি: পিটিআই।

গ্রামের লোকেদের মধ্যেও দায়রামকে নিয়ে কানাঘুষো শুরু হয়ে গিয়েছে। একজন তো আতঙ্ক প্রকাশই করে ফেললেন। গ্রামেই সয়াবিন তেলের কারখানায় কাজ করা সইরাম লাল তো বলেই ফেললেন, ‘‘আমার তো ভয় করছে। দিল্লিতে রোগ ছড়িয়েছে। এখানেও ওরা তা বয়ে এনেছে কি না কে জানে। আমরা তো ধারেকাছে ঘেঁষছি না। আগের মতো তেমন কথাও বলি না।’’

তাঁকে নিয়ে যে এমন কথা হচ্ছে, আচমকাই তিনি যে 'বহিরাগত' হয়ে গিয়েছেন, সে কথা দয়ারাম নিজেও বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু পরিবারের পেট ভরাবেন কী করে, তা ভেবেই এখন কুল পাচ্ছেন না তিনি। কারণ হাতে যেটুকু জমি রয়েছে, তাতে যে চাষবাস করবেন সেই উপায়ও নেই। কারণ গত দশক পর্যন্ত বুন্দেলখণ্ডে যেখানে বছরে ৩৫ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃষ্টি হতো, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে বর্তমানে তা অর্ধেকে এসে ঠেকেছে। তাই এত দিন কৃষিকাজই যাঁদের প্রধান জীবিকা ছিল, রোজগারের সন্ধানে তাঁরাও দলে দলে শহরে যেতে শুরু করেছেন।

আরও পড়ুন: স্থানীয় বাসিন্দাদের বিক্ষোভ, করোনা আক্রান্ত চিকিৎসকের দেহ সমাধি দিলেন সহকর্মীই​

দুই ছেলের সঙ্গে দয়ারাম।

জুগইয়ার অনতিদূরে ছুয়ারা গ্রাম থেকে দয়ারামের সঙ্গে দিল্লির খাদানে কাজ করতে গিয়েছিলেন অনেকে। বাড়ি ফিরে মাথায় হাত পড়েছে তাঁদেরও। রেশন কার্ড থাকলে সরকার থেকে প্রতিমাসে মাথাপিছু ৫ কিলো খাদ্যশস্য পাওয়ার কথা তাঁদের। কিন্তু যেহেতু ভিন্ রাজ্যে থাকেন, গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা নন, তাই রেশনের সেই বরাদ্দটুকুও জুটছে না তাঁদের। কেউ তাঁদের কথা ভাবে না, কারও কাছে তাঁদের জীবনের মূল্য নেই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দয়ারামের এক বন্ধু।

একরকম পায়ে হেঁটে প্রায় তিনশো মাইল পার হয়ে এসে 'ঘর'-এ পৌঁছে দয়ারাম টের পেলেন, তা কখন 'বেঘর' হয়ে গিয়েছে। পরিচিত পরিবেশকে আর খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। অতিমারি আর তা থেকে জন্মানো আতঙ্ক এভাবেই বিপন্নতা বাড়িয়ে চলেছে অসংখ্য দয়ারামের। পরিযায়ী শ্রমিকের 'ঘরে ফেরা' আজ এক অলীক বস্তু। জানা নেই, আর কখনও 'ঘর' ফিরে পাবেন কি না দয়ারামরা।

ছবি: রয়টার্স।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE