গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
আত্মসমর্পণ করছেন শীর্ষ মাওবাদী নেতা মুপ্পালা লক্ষ্মণ রাও ওরফে গণপতি? মঙ্গলবার থেকেই ছত্তীসগঢ় এবং তেলঙ্গানা পুলিশের শীর্ষ স্তরে এমনটাই জল্পনা। দুই রাজ্যের শীর্ষ পুলিশকর্তারা এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য না করলেও, পুলিশেরই বিভিন্ন স্তর থেকে দাবি করা হচ্ছে, কয়েক দিনের মধ্যেই দীর্ঘ তিন দশকের গেরিলা জীবন ছেড়ে মূলস্রোতে ফিরতে চলেছেন সিপিআই মাওবাদী সংগঠনের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক গণপতি।
ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানা এবং মহারাষ্ট্র পুলিশের বিভিন্ন মহল থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, খারাপ স্বাস্থ্যের কারণেই আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠিয়েছেন দেশের অন্যতম মোস্ট ওয়ান্টেড গেরিলা নেতা, যাঁর নাগাল গত তিরিশ বছরে এক বারের জন্যও পাননি বিভিন্ন রাজ্যের প্রশিক্ষিত বাহিনী থেকে শুরু করে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র গোয়েন্দারা। তেলঙ্গানা এবং ছত্তীসগঢ় পুলিশের একটি অংশের দাবি, দীর্ঘ দিন ধরেই ডায়াবেটিস, বাতের ব্যথা-সহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন ৭৪ বছরের এই নেতা। জীবনের বড় সময়টাই তিনি কাটিয়েছেন অবুঝমাঢ়ের গহীন জঙ্গলে। সেখানে চিকিৎসার সুযোগও যেমন নেই, তেমনি সম্প্রতি সংগঠনেও গুরুত্ব হারিয়েছেন। তেলঙ্গানা পুলিশের একাংশের দাবি, গণপতি তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রশেখর রাওয়ের কাছেই দূত মারফত বার্তা পাঠিয়েছিলেন। কিছু শর্তও দিয়েছিলেন। তার ভিত্তিতেই আশা করা হচ্ছে তিনি খুব তাড়াতাড়ি বন্দুক ফেলে ফিরে আসবেন প্রকাশ্য জীবনে।
যদিও এ বিষয়ে এই সমস্ত অগ্রগতির বিষয়ে অন্ধকারে রয়েছেন বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। নয়াদিল্লিতে এ নিয়ে কোনও খবর নেই বলে মন্তব্য করেছেন শীর্ষ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। তাঁদের দাবি, গোটা বিষয় নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন দণ্ডকারণ্যের শীর্ষ মাওবাদীরাও। গেরিলাদের কথোপকথন থেকে শুরু করে গতিবিধির উপর নজর রাখা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, সোমবার থেকে গুঞ্জন তৈরি হয়েছে, অবুঝমাঢ়ের গভীরেও। মাওবাদী গেরিলাদের রেডিও বার্তায় আড়ি পেতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, অবুঝমাঢ় থেকে মহারাষ্ট্রের গঢ়চিরৌলিতে যোগাযোগ করে জানতে চাওয়া হচ্ছে, গণপতির খবরটা কতটা ঠিক? সেই কথোপকথন থেকে স্পষ্ট, মাওবাদীরাও গোটা বিষয় নিয়ে অথৈ জলে। কেউ সন্দেহ করছেন যে গণপতি গ্রেফতার হয়েছেন।
এই আড়িপাতার পর থেকেই জল্পনা আরও বেড়েছে গণপতিকে ঘিরে। ছত্তীসগঢ় পুলিশের এক কর্তা সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, তাঁদের কাছেও খবর, ২৮ বা ২৯ অগস্ট অবুঝমাঢ় থেকে বেরিয়ে তেলঙ্গানা সীমান্তের দিকে গিয়েছেন গণপতি।
আরও পড়ুন: পাবজি-সহ আরও ১১৮টি চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করল ভারত
আশির দশকে সিপিআই এমএল (পিপলস ওয়ার) গ্রুপ-এর প্রতিষ্ঠাতা কোড্ডাপল্লি সিতারামাইয়ার হাতে তৈরি এই গেরিলা নেতার বাড়ি ছিল অবিভক্ত করিমনগর জেলায়। সম্পন্ন কৃষক পরিবারের ছেলে মুপ্পালা লক্ষ্মণ রাও বিজ্ঞানের স্নাতক। প্রথম জীবনে শিক্ষকতাও করেন। পরে জড়িয়ে পড়েন অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষক আন্দোলনে। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে প্রবেশ গেরিলা জীবনে। ২০০৪ সালে পিপলস ওয়ার এবং মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার ঐক্যবদ্ধ হয়ে সিপিআই-মাওবাদী সংগঠন তৈরির পর থেকে তিনিই সংগঠনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। সংগঠনের তাত্ত্বিক নেতা হিসাবে পরিচিত গণপতি সংগঠনের বিস্তারে এবং শক্তিবৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে দাবি গোয়েন্দাদের। ২০০৭ সালে নেপালের মাওবাদী সংগঠনকে সংশোধনবাদী আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্তের পিছনেও গণপতির বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন গোয়েন্দারা।
আরও পড়ুন: লাদাখ সঙ্ঘাতের জের, অরুণাচলে বাড়ানো হচ্ছে নিরাপত্তা
গণপতির আত্মসমর্পণের জল্পনাকে ঘিরে গোয়েন্দাদের দাবি, সম্প্রতি অসুস্থতার কারণে তিনি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। তার জায়গায় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন নাম্বালা কেশব রাও ওরফে বাসবরাজ। গণপতির মতো তিনি তাত্ত্বিক নেতা নন, বরং অনেক বেশি সমর কুশলী। সংগঠনের কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের প্রধান ছিলেন তিনি। গোয়েন্দাদের দাবি, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরই গোটা সংগঠনের খোলনলচে অনেকটাই বদলেছে। গুরুত্ব বেড়েছে অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং সমর কুশলী নেতাদের। সামরিক দিক থেকে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে মাওবাদী সংগঠন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, রাজনৈতিক সংগঠনের থেকে সামরিক সংগঠনের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া নিয়ে গণপতির সঙ্গে বর্তমান নেতৃত্বের বিরোধ তাঁর আত্মসমর্পণের অন্যতম কারণ হতে পারে।
তবে সে কথা মানতে নারাজ গোয়েন্দাদের অন্য একটি অংশ। তাঁরা বলেন, গণপতির মাথার উপর প্রায় আড়াই কোটি টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে বিভিন্ন রাজ্য সরকার। ১০০টিরও বেশি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি আত্মসমর্পণ করলেও বাকি জীবন কাটাতে হবে জেলে। সে ক্ষেত্রে তিনি আদৌ আত্মসমর্পণ করছেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মাওবাদীদের কথোপকথনে আড়িপাতা গোয়েন্দাদের কথায়, ‘‘দণ্ডকারণ্যের মাওবাদী নেতৃত্বের বড় অংশেরই অনুমান, পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন গণপতি। তাঁর আত্মসমর্পণের গল্প সাজানো হচ্ছে সংগঠনের সদস্যদের মনোবলে চিড় ধরাতে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy