তাঁর কথাটা আজও মনে আছে— গ্যাস ভরতে গ্যয়া... ওহ্ তো একদিন ফাটনা হি থা।
কিছু একটা যে ঘটতে চলেছে, স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল আগের দিনই। ৫ ডিসেম্বর ১৯৯২ লখনউয়ের ঝাণ্ডেওয়ালা ময়দানে। গোটা ময়দানে করসেবক আর রামভক্তেরা যেন ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ি। টগবগিয়ে ফুটছেন। সেই ফোটানোর কাজটা শুরু হয়েছিল বারাণসী থেকে দ্বিতীয় দফার রামরথ যাত্রায়।
প্রথম দফার রথযাত্রায় লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গী ছিলাম বিহারের ধানবাদ (এখন ঝাড়খণ্ড রাজ্যে) থেকে সমস্তিপুর পর্যন্ত। সেই সমস্তিপুর! ১৯৯০ সালের ২৩ অক্টোবর বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব যেখানে রামরথের গতিরোধ করে দিয়েছিলেন। গ্রেফতার করেছিলেন আডবাণীকে। সে বারের রথযাত্রায় উৎসাহ ছিল প্রবল। স্বতঃস্ফূর্ত কোলাহলও। তবে তেমন সংগঠিত চেহারা ছিল না। দ্বিতীয় দফার রথযাত্রায় কিন্তু শুরু থেকেই অনেক বেশি সংগঠিত চেহারা চোখে পড়েছিল। করসেবক ও রামভক্তদের ধীরে ধীরে ধীরে তাতিয়ে তোলার কাজটাও চলছিল সুকৌশলে। আডবাণী অবশ্য গোড়া থেকেই ঋষিসুলভ আচরণ করছিলেন। গোটা পথে ছোট-বড় সভায় একই সুরে এবং মোটামুটি একই বয়ানে বক্তৃতা করছিলেন তিনি।
রথ যত এগিয়েছে, ততই তেতে উঠেছেন করসেবক আর রামভক্তেরা। যে রামভক্তেরা আজমগড়ে বন্ধ চিনিকলের শ্রমিকদের মারতে মারতে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন। পুলিশের চোখের সামনেই! পুলিশ কোনও বাধাই দেয়নি! শ্রমিকদের ‘অপরাধ’— তাঁরা পোস্টার নিয়ে পথের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। যে পোস্টারে লেখা— ‘পহলে মিল খোলো, ফির মন্দির বনাও’। পরদিন সকালে ওই ঘটনা সম্পর্কে যখন আডবাণীকে প্রশ্ন করি, তিনি খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গেই বলেন, ‘‘কই শুনিনি তো!’’
অযোধ্যায় ঢোকার মুখে লালকৃষ্ণ আডবাণীর রামরথ। ফাইল চিত্র।
আসলে আডবাণী তাঁর শান্ত ভাবমূর্তি বজায় রেখেছিলেন। রামভক্তদের চাঙ্গা করার কাজ করছিলেন অন্য নেতারা। রামভক্তদের মিছিলের মধ্যে মিশে ছিলেন অনেক সংগঠক। সেই দলে নাকি ছিলেন বাছাই-করা স্বয়ংসেবক আর প্রচারকেরা। রামরথ যখন লখনউ পৌঁছল, রামভক্তদের নিনাদে আকাশ-বাতাস কাঁপছে। গোটা লখনউ শহরে অদ্ভুত এক স্তব্ধতা। মানুষের মনে কী হয়-কী হয় ভাব। সর্বত্র এক আলোচনা— ৬ ডিসেম্বর কী হবে।
‘কী হবে’ তা খানিক স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ৫ তারিখে হিন্দি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ছবিতে— করসেবকেরা অযোধ্যায় গাঁইতি-শাবল জড়ো করছেন।
আরও পড়ুন: এত দিনে বাবরি ধ্বংসের রায়! অক্ষমের উল্লাস ছাড়া আর কী?
আর ঝাণ্ডেওয়ালা ময়দানে? বাংলায় যাকে বলে ‘রাবড়ি পাক’। তলায় আগুন আর হাঁড়ির উপর হাওয়া দেওয়া। অনেক নেতাই তপ্ত বক্তৃতা করলেন। গোটা ময়দান উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। আর পাখার বাতাস দিলেন আডবাণী। যথারীতি শান্ত ভঙ্গিতে। যা ‘রাবড়ি পাকে’ একান্ত প্রয়োজনীয়।
৬ ডিসেম্বর সকালে অযোধ্যায় সাজ-সাজ রব। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। প্রশাসন ঘোষণা করল, করসেবকদের বাবরি মসজিদের কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হবে না। যথারীতি মসজিদ ঘিরে রেখেছিল অসংখ্য পুলিশ। হিন্দি বলয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় জানা ছিল, উত্তরপ্রদেশের পুলিশ ও ‘প্রভিন্সিয়াল আর্মড কনস্টেবুলারি’ (সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী)-র মধ্যে জাতপাত ও সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ যথেষ্ট। ফলে প্রশাসনের গোপন বরাভয়ে পুলিশ একটা লোকদেখানো ভূমিকাই পালন করেছিল। অচিরেই হাজার হাজার করসেবক বাবরি মসজিদে চড়ে বসলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেল ষোড়শ শতকের প্রাচীন মসজিদ।
আরও পড়ুন: শেষ গম্বুজটাও ভেঙে পড়তে দেখলাম ৪টে ৪৯ মিনিটে
সে দিন দু’টি প্রশ্ন মনে জেগেছিল। প্রথমত, এত বড় একটা কাঠামো কয়েক ঘণ্টায় মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হল অথচ তেমন কোনও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটল না কেন? সংগঠিত পরিকল্পনা এবং নিপুণ দক্ষতা ছাড়া এটা কি সম্ভব? দ্বিতীয়ত, সত্যিই কি আডবাণী কিছুই জানতেন না? না কি তাঁর বিষণ্ণতা ছিল সামগ্রিক পরিকল্পনারই অঙ্গ? উত্তর খুঁজে পাইনি। এখনও পাইনি।
ঘটনার পর লখনউ শহর। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২। —ফাইল চিত্র।
৬ ডিসেম্বর সন্ধে থেকেই লখনউ শহরে ফিরতে শুরু করেছিলেন করসেবকদের অনেকে। বিশেষ করে নারী করসেবকেরা। অনেকেই উল্লাসে ফেটে পড়েছেন। আবার অনেকের চোখেমুখ সন্ত্রস্ত। যেন বুঝে উঠতে পারছেন না কাজটা ঠিক হল কি না। শহরে অনেক জায়গাতেই চলছিল লাড্ডু বিতরণ। সংখ্যালঘু এলাকাগুলি ভয়ে জড়োসড়ো। রাতে শুরু হয়েছিল গোলমাল। আমার গাড়ির চালক ছিলেন মুসলিম। তিনি সে রাতে বাড়ি ফিরতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তাঁকে আমার সঙ্গেই রেখে দিয়েছিলাম।
পরদিন সাতসকালে পৌঁছেছিলাম উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহের সরকারি বাসভবনে। তত ক্ষণে অবশ্য তিনি ‘প্রাক্তন’ হয়ে গিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশ-সহ চার বিজেপি শাসিত রাজ্যে জারি হয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসন। গেরুয়া পাঞ্জাবি ও ধুতি পরিহিত কল্যাণ স্বাগত জানালেন হাসিমুখে। তাঁর নির্দেশে টেবিলে রাখা হল লাড্ডুর থালি। কিন্তু সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় হোঁচট খাচ্ছিলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে মাঝেমধ্যেই একটা চিরকুট বার করে দেখছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল, কোন প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন আগে থেকে ঠিক করে লিখে রেখেছেন। তবে তাঁর একটা কথা আজও মনে আছে— ‘‘গ্যাস ভরতে গ্যয়া....গ্যাস ভরতে গ্যয়া। ওহ্ তো একদিন ফাটনা হি থা।’’
কল্যাণ বলেননি, ‘গ্যাস’টা ভরেছিল কারা। সেই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনও মেলেনি। বুধবার মিলবে?
(লেখক প্রবীণ সাংবাদিক। ১৯৯২ সালে ৬ ডিসেম্বর হাজির ছিলেন অযোধ্যা ও লখনউয়ে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy