Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
National News

ঠাকুরের ভূত যেন ভর করেছে গোটা গ্রামে, কুটিয়ার চাষির ঘরে ঘরে ‘পঞ্জা’ ছাপ

মন্দসৌরের চাষিরা আগেই জানিয়েছিলেন, সয়াবিনের দাম নেই। সাগর জেলার চাষিরা বলছেন, ছোলার দাম নেই, উড়দ ডালের দাম নেই। মোহনলাল বলেন, ‘‘কমপক্ষে ৫০০০ টাকা দাম হওয়া উচিত এক ক্যুইন্টাল ছোলার। কিন্তু মিলছে ৩০০০।’’

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
জবলপুর শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৮ ১৫:৪৬
Share: Save:

ঠাকুর কল্যাণ সিংহের মৃত্যু আর পারলৌকিক ক্রিয়ার কথাটা মুখে মুখে ফিরছে কুটিয়ায়। ভোট যত কাছে আসছে, তত বেশি করে উঠে আসছে আখ্যানটা। অথচ তিনি সম্প্রতি মারা গিয়েছেন, এমন নয়। অসুস্থতা, মৃত্যু, শ্রাদ্ধশান্তি— সবই গত বছরের ঘটনা। কিন্তু কুটিয়ায় পা রাখলেই এখন তাঁর কথা শোনা যাচ্ছে আর উঠোনে উঠোনে ‘পঞ্জা ছাপ’ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

কুটিয়া শুধু গ্রাম নয়, তস্য গ্রাম। মধ্যপ্রদেশের রাজধানী থেকে কুটিয়ার দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটারের আশেপাশে। মাইলের পর মাইল জুড়ে জনশূন্যতা, পাহাড়-টিলা-জঙ্গল আর শীর্ণ রেখার মতো বয়ে চলা নদীগুলোকে নিয়ে ভারতের যে মধ্যভাগ, তার ঠিক মাঝ বরাবর কুটিয়ার অবস্থান। সুপ্রশস্ত, তেল মাখানো ভোপাল-বিদিশা হাইওয়ের গা থেকে পিচঢালা ফালি ঢুকে গিয়েছে ২ কিলোমিটার ভিতরে। শেষ হয়েছে কুটিয়ায়। প্রায় সবাই কৃষিজীবী। সুতরাং কৃষক অসন্তোষের মধ্যপ্রদেশে কুটিয়া যেন ক্ষোভে ফুটন্ত।

‘‘ঠাকুর কল্যাণ সিংহের বয়স হয়েছিল, তবে মরার বয়স হয়নি। হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসার জন্য ভোপাল নিয়ে যাওয়া জরুরি হয়ে পড়ল। তার জন্য অনেকটাই টাকার দরকার ছিল। কুটিয়ার মতো গ্রামে কার হাতেই বা খুব বেশি নগদ থাকে? তাই ঘরে মজুত করে রাখা আনাজ বেচতে গেলেন ছেলে নারায়ণ সিংহ...।’’ বাঁশের বেড়ার গায়ে কালো পলিথিন জড়িয়ে ঘিরে রাখা দাওয়ায় বসে গল্প বলার ঢঙে বকবক করে চলেন বালকৃষ্ণ কুর্মি পটেল। তার পরে? ‘‘তার পরেই তো আসল। প্রথমে গেলেন রাহতগড়, বিক্রি করতে পারলেন না। গেলেন সাগর, পারলেন না। চলে গেলেন ভোপাল। সেখানে গিয়ে আনাজ তো বিক্রি হয়ে গেল। কিন্তু নগদ হাতে পেলেন না। ব্যাপারি চেক ধরিয়ে দিলেন। নারায়ণ সিংহ বললেন, কিছু তো নগদ দিন। আমার হাতে কোনও পয়সা নেই। ট্রাক্টরে তেল ভরতে হবে। না হলে কুটিয়া ফিরতে পারব না। ব্যাপারি বললেন, কোনও নগদ দিতে পারব না। তেল ভরতে না পারলে ট্র্যাক্টর ফেলে রেখে যাও, না হলে ঠেলে নিয়ে যাও। যা খুশি কর, এখন এখান থেকে যাও।’’ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নারায়ণ সিংহ বাড়ি ফিরেছিলেন বলে শোনা যায়। ব্যাপারির দেওয়া চেক ব্যাঙ্কে জমাও করেছিলেন। ‘‘কিন্তু চেক ভাঙার আগেই কল্যাণ সিংহ শেষ, পারলৌকিক ক্রিয়াও সম্পন্ন।’’ কটাক্ষের হাসি নিয়ে বলেন বালকৃষ্ণ।

আরও পডু়ন: ২৬/১১-র হামলাকারীদের সম্পর্কে তথ্য দিলেই ৩৫ কোটি পুরস্কার, ঘোষণা আমেরিকার

মন্দসৌরের চাষিরা আগেই জানিয়েছিলেন, সয়াবিনের দাম নেই। সাগর জেলার চাষিরা বলছেন, ছোলার দাম নেই, উড়দ ডালের দাম নেই। মোহনলাল বলেন, ‘‘কমপক্ষে ৫০০০ টাকা দাম হওয়া উচিত এক ক্যুইন্টাল ছোলার। কিন্তু মিলছে ৩০০০।’’ আর বালকৃষ্ণ বলেন, ‘‘উড়দ ডাল ১২ হাজার টাকা কুইন্টালও বেচেছি। এখন কত জানেন? ছশো-সাতশো টাকা।’’

ফসলের দাম শুনলে সত্যিই চোখ কপালে ওঠার জোগাড় হয়। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চেকের ‘কারসাজি’। জানাচ্ছেন কৃষকরা। মন্ডিতে গিয়ে ফসল বেচে এলেও আর নগদ টাকা মেলে না। আড়তদার চেক ধরিয়ে দেন চাষিদের হাতে। কোনও চেক পোস্টডেটেড। কোনও চেক আবার অচল বলে অভিযোগ। ব্যাঙ্কে জমা দিলেও টাকা ঢোকে না। আবার ছুটতে হয় আড়তদারের দরজায়। ‘‘এত কষ্টের ফসল। সে ফসল বেচে ঠিকমতো দাম পাব না। যা পাব,সেটাও চোখে দেখার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে আড়তদার, আড়তদার থেকে ব্যাঙ্কের দরজায় ছোটাছুটি করব। এই ভাবে কি চাষি বাঁচে?’’ প্রশ্ন প্রবীণ রঘুবংশীর।

জব্বলপুরের কুটিয়া গ্রাম। —নিজস্ব চিত্র

কিন্তু আড়তদাররা এমন করছেন কেন? নগদে কেন মিটিয়ে দিচ্ছেন না দাম? এর জবাব দিলেন সিবনীর কংগ্রেস কর্মী রবীন্দ্র বাঘেল। বললেন, ‘‘আড়তদারই বা দেবেন কোথা থেকে? নোটবন্দিতে ব্যবসা-বাণিজ্য যে ধাক্কাটা খেয়েছে, তার প্রভাব এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি।আড়তদারদের হাতে সব সময় নগদের জোগান থাকে না। অথবা হয়তো থাকে কিন্তু তাঁরা পরিস্থিতির সুযোগ নেন। সরকারের তো উচিত সে সব দিকে লক্ষ্য রাখা। কিন্তু সরকার কিছুই করছে না।’’

বাঘেলের কথা সর্বৈব মিথ্যা নয়। চাষিদের যে সমস্যা রয়েছে, তা মধ্যপ্রদেশের বিজেপি নেতারাও সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারছেন না। ঠিক সেই দুর্বল জায়গাটায় ঘা দিয়েই বিজেপির দুর্গপ্রাকার ধসিয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কংগ্রেস। রাজ্যে কৃষিজীবীদের ভোট ২৫ শতাংশের কাছাকাছি। অসন্তোষ যে তাঁদের মধ্যে রয়েছে, তা মধ্যপ্রদেশের যে কোনও প্রান্তে স্পষ্ট। অতএব কৃষকের জন্য কংগ্রেসের স্লোগান— ‘‘কর্জা মাফ, বিজলি মাফ, ভাজপা সাফ।’’ অর্থাৎ, কংগ্রেস সরকারে এলেই কৃষিঋণ মকুব, কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতের বিল মকুব।

দাম নেই ফসলের। মাথায় হাত চাষির। —ফাইল চিত্র

আরও পড়ুন: গর্ভে সন্তান, স্বামী বন্দি সুদূর তানজানিয়ায়, হাঁড়ি চড়ছে না নীপার সংসারে

কংগ্রেসের এই স্লোগান কিন্তু নেহাৎ স্লোগানের পর্যায়ে নেই। চাষির ঘরে ঘরে কিন্তু বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছে যে, ঋণ এবং বিদ্যুতের বিল মাফ হয়ে যাবে। কারণ রীতিমতো তারিখ ঘোষণা করে দিয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। সরকার গঠনের ঠিক ১০ দিনের মধ্যে চাষির জন্য কী কী পদক্ষেপ করা হবে, বিশ্বাস করানোর মতো ভঙ্গিতেই তা সর্বত্র বলে চলেছেন কংগ্রেস নেতারা। অতএব ফসলের দাম না পেয়ে নাজেহাল চাষিদের অনেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন যে, ডিসেম্বর মাস শেষ হওয়ার আগেই ধারদেনার বোঝা নেমে যাবে ঘাড় থেকে। তাঁদের উঠোনে উঠোনে ‘পঞ্জা’ (হাত) আঁকা পতাকা পতপত করে উড়তে শুরু করে দিয়েছে। কৃষিজীবী গ্রামে একরত্তি শিশুর বুকেও পঞ্জা ছাপের ব্যাজ সেঁটে গিয়েছে।

কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে চাষির অবস্থা সত্যিই ফিরবে তো? ধারকর্জ সত্যিই মাফ হবে তো? মোহনলাল এহরওয়ার বলেন, ‘‘না হলে পাঁচ বছর পর আবার বদলে দেব। এদের (বিজেপি) তো ১৫ বছর হয়ে গেল। এ বার অন্যদের একটু দিয়ে দেখি।’’

কৃষি ঋণ মকুবের দাবিতে ফসল ছড়িয়ে বিক্ষোভ চাষিদের। —ফাইল চিত্র

এই বয়ানটাই বিজেপির অস্বস্তি সবচেয়ে বাড়াচ্ছে। উন্নয়ন নয়, সড়ক-বিজলি-পানির ‘বিপ্লব’ নয়, একের পর এক সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প নয়, ‘১৫ বছর তো হয়ে গেল বিজেপির, এ বার একটু অন্যদেরও দেখা যাক’— এই বাক্যবন্ধটার চারপাশেই ভোটের হাওয়াটাকে পাক খাইয়ে দিতে চাইছে কংগ্রেস। সে চেষ্টায় যদি সফল হন কমল নাথ, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, দিগ্বিজয় সিংহরা, তা হলে ঘোর বিপদ— বেশ বুঝতে পারছেন শিবরাজ সিংহ চৌহান।

(ভারতের রাজনীতি, ভারতের অর্থনীতি- সব গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy