মর্গের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মৃত শ্রমিকের পরিজন। (ডান দিকে) আগুনে পোড়া কারখানা। রবিবার দিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
বাইশ বছর আগে দিল্লির ‘উপহার’ সিনেমা হলে অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি ফিরে এল। ১৯৯৭ সালে ওই সিনেমা হলে আগুন লেগে মারা গিয়েছিলেন ৫৯ জন। আর আজ ভোরে মধ্য দিল্লির রানি ঝাঁসি রোডের আনাজ মান্ডি এলাকায় ব্যাগ, জুতো তৈরির একটি কারখানায় আগুন লেগে মারা গেলেন ৪৩ জন। এঁদের প্রায় সকলেই বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য থেকে কাজ করতে আসা শ্রমিক। মৃতের সংখ্যা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সন্ধেয় গ্রেফতার করা হয়েছে কারখানার মালিক রেহান ও ম্যানেজার ফুরকানকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, ফিল্মিস্তান এলাকায় চারতলা বাড়িটির তেতলায় ভোর পাঁচটা নাগাদ আগুন লাগে। পুলিশ ও দমকল বাহিনীর কর্তারা জানিয়েছেন, প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, কারখানার ভিতরে বিদ্যুতের লাইনে শর্ট সার্কিট থেকেই আগুন লেগে যায়। সেই সময়ে ওই কারখানার ভিতরে তেতলা ও চারতলায় ঘুমোচ্ছিলেন শ্রমিকেরা। বড় ঘরের ভিতরে রাখা ছিল স্কুলব্যাগ ও অন্য অনেক দাহ্য সামগ্রী। ফলে তেতলা থেকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যে ঘরগুলিতে শুয়ে ছিলেন শ্রমিকেরা, শীতের কারণে তার অধিকাংশেরই জানলা বন্ধ ছিল। বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড ভরে যায় বাড়িটির সর্বত্র। দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন অধিকাংশ শ্রমিক।
৩২ বছরের ফিরোজ খান ঘুমোচ্ছিলেন চারতলায়। কোনও মতে প্রাণে বেঁচেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আগুন লেগেছিল তেতলায়। চারতলায় শুয়ে ছিলাম। ঘুম ভাঙতেই দেখি, চারপাশে আগুনের শিখা। চার-পাঁচ জন দরজা দিয়ে কোনও ক্রমে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। দরজা থেকে দূরে যাঁরা শুয়েছিলেন, তাঁরা ভিতরেই আটকে পড়েন। জানি না, ওঁদের কী হল।’’ চারতলা বাড়ি থেকে বেরোনোর দরজা একটিই। যা মিশেছে সরু একটি গলিতে। যে-হেতু তেতলা থেকে আগুন ছড়িয়েছিল, তাই শ্রমিকদের বেরোনোর সেই রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায়। বিষাক্ত ধোঁয়া ও আগুনের শিখার জতুগৃহে আটকে মারা যান তাঁরা।
দিল্লিতে অগ্নিগ্রাস
• রবিবার ভোর ৫টায় চারতলা কারখানার তেতলায় আগুন লাগে, সম্ভবত শর্ট সার্কিট থেকে
• স্কুলব্যাগ, রেক্সিন, প্লাস্টিকের খেলনা, প্যাকেট থাকায় আগুন দ্রুত ছড়ায়
• বন্ধ ছিল অধিকাংশ জানলা
• তিন, চারতলায় শ্রমিকেরা ঘুমোচ্ছিলেন। বেরোনোর রাস্তা ছিল না
• দমকলের ১৫০ জন কর্মী, ৩৫টি গাড়ি নিয়ে পাঁচ ঘণ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে
• ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় উদ্ধারকাজে চূড়ান্ত অসুবিধা
• অধিকাংশেরই মৃত্যু দমবন্ধ হয়ে। বাড়ির ভিতরে মিলল বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড
• কারখানা নির্মাণ, দমকলের ছাড়পত্রই ছিল না। ছিল না অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা
• ধৃত কারখানার মালিক এবং ম্যানেজার
ভোর ৫টা ২২ নাগাদ খবর পৌঁছয় দমকলে। দমকলের ৩৫টি গাড়ি ও একের পর এক অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছনোর চেষ্টা করে ঘটনাস্থলে। পৌঁছয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীও। কিন্তু তাতেও বিপত্তি। কারখানাটি তস্য গলির ভিতরে। যেখানে ঠিক ভাবে যাতায়াতের উপায় নেই। কোথাও কোথাও দিনের বেলাতেও অন্ধকার। শেষ পর্যন্ত একটি বাড়ির জানলার গ্রিল কেটে অকুস্থলে পৌঁছন দমকল কর্মীরা। আগুনের সঙ্গে লড়াই করে গুরুতর আহত ও অচৈতন্য শ্রমিকদের পিঠে নিয়ে পিছনের বাড়ি দিয়ে বার করেন বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যেরা। চারটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ৬৩ জনকে। যাঁদের মধ্যে মারা যান ৪৩ জন। মৃতদের মধ্যে এক কিশোরও রয়েছে।
আরও পড়ুন: টানা ১২ ঘণ্টা খেটে ছাদেই ঘুমোচ্ছিলেন ওঁরা, ঘুম ভাঙল মৃত্যুর সামনে
রাজধানীতে অগ্নিকাণ্ড
উপহার অগ্নিকাণ্ড
১৩ জুন, ১৯৯৭। দিল্লির গ্রিন পার্কের উপহার প্রেক্ষাগৃহে বেলা ৩-৬ টার শো’য়ে চলছিল ‘বর্ডার’ ছবিটি। ছবি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন লাগে। ভিতরে দম আটকে মারা যান ৫৯ জন। বেরোতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হন ১০৩ জন। প্রেক্ষাগৃহের পার্কিং লটে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ২৭টি গাড়ি।
• ৩১ মে, ১৯৯৯: লালকুয়াঁর রাসায়নিক মার্কেট চত্বরে আগুন। মৃত ৫৭
• ২০ নভেম্বর, ২০১১: নন্দনগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে আগুন। মৃত ১৪।
• ২০ জানুয়ারি, ২০১৮: ববানায় বাজি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে মৃত ১৭
• ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯: করোল বাগের অর্পিত প্যালেস হোটেলে আগুন। মৃত ১৭
• ৬ অগস্ট, ২০১৯: জ়াকির নগর এলাকার পাঁচতলা আবাসনে আগুন। মৃত ৫
উপহার-অগ্নিকাণ্ডের পর যেমন ওই সিনেমা হলের অব্যবস্থা সামনে এসেছিল, এ ক্ষেত্রেও জানা গিয়েছে, ওই বাড়িটিতে কারখানা নির্মাণেরই অনুমতি ছিল না। ছাড়পত্র ছিল না দমকলেরও। বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ থাকা সত্ত্বেও অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। আর ঘিঞ্জি গলিতে ছড়িয়ে ছিল বিদ্যুতের তার। ফলে দুর্ঘটনা ছিল সময়ের অপেক্ষা।
আরও পড়ুন: বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিল পেশ আজ লোকসভায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy