শহরে ডেঙ্গি মোকাবিলায় বৈঠকে উত্তরবঙ্গ উন্নয় মন্ত্রী গৌতম দেব।
এনসেফ্যালাইটিসের পরে ডেঙ্গি নিয়েও তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠল শিলিগুড়িতে। বৃহস্পতিবার শিলিগুড়িতে একই পরিবারের ৭ জনের রক্তে ডেঙ্গির জীবাণু মেলা নিয়ে হইচই হলেও শহরে ডেঙ্গির প্রকোপ মানতে চায়নি পুরসভা ও স্বাস্থ্য দফতর। সে দিন ডেঙ্গি সংক্রান্ত কোনও তথ্য তাঁর জানা নেই বলে দাবি করেছিলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবও। তবে স্বাস্থ্য দফতর, প্রশাসন ও পুরসভার কর্তাদের নিয়ে ‘জরুরি বৈঠক’ ডাকার কথা ঘোষণা করেন। তার ২৪ ঘণ্টার মাথায় শুক্রবার সকাল ১১টায় গৌতমবাবু সেই বৈঠকের পরে মানলেন শহরে ডেঙ্গি ছড়িয়েছে। তিনি জানান, গত এক মাসে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পরীক্ষায় ১৮ জনের রক্তে ডেঙ্গির জীবাণু ধরা পড়েছে। যদিও নার্সিংহোম ও হাসপাতাল সূত্র বলছে, আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি।
নার্সিংহোমগুলির দাবি মানতে চাননি মন্ত্রী। কিন্তু, মন্ত্রী এটাও স্বীকার করেছেন, প্রায় ১০ মাস ধরেই ডেঙ্গির প্রকোপ অল্পবিস্তর রয়েছে। তাঁর কথায়, “উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, দার্জিলিং ও শিলিগুড়ির সরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ডেঙ্গি সন্দেহে গত ১০ মাসে ১৬২ জনের রক্ত পরীক্ষা করানো হয়েছে। ৩৪ জনের ডেঙ্গি ধরা পড়েছে।” তবে স্বাস্থ্য দফতরের দাবি, চিকিত্সায় সব রোগীই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আক্রান্তরা অধিকাংশই নার্সিংহোমে চিকিত্সা করাচ্ছেন। অনেকে বাড়িতে রয়েছেন।
মাত্র তিন মাস আগে উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিসের প্রকোপ নিয়ে ব্যাপক হইচই হয়। অন্তত ১৫০ জনের মৃত্যু হয়। রোগ সংক্রান্ত তথ্য গোপনের অভিযোগে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সাসপেন্ড হন। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ, সুপার দু’জনকেই সাসপেন্ড করা হয়। কয়েকজন চিকিত্সককে বদলি করা হয়। তারপরে এনসেফ্যালাইটিস পরিস্থিতি আয়ত্তে আসে। এই অবস্থায়, ডেঙ্গি নিয়েও ফের তথ্য গোপনের অভিযোগ তুলেছেন সিপিএমের দার্জিলিং জেলার কার্যকরী সম্পাদক জীবেশ সরকার। তিনি বলেন, “আমরা কখনও বলি না যে, তৃণমূলের জন্য রোগ হচ্ছে। তা হলে কেন তথ্য গোপনের প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না?”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, প্রায় এক মাস ধরেই শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ির একাধিক নার্সিংহোম থেকে ডেঙ্গির প্রকোপ ছড়াচ্ছে বলে আশঙ্কা জানানো হয়। কয়েকজন রোগীর নাম, রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টও নার্সিংহোমের তরফে স্বাস্থ্য দফতরে পাঠানো হয়। তা নিয়ে অবশ্য প্রশাসনের কোনও হেলদোল দেখা যায়নি। সরকারি তরফে কোনও সচেতনতা কিংবা প্রচারের কর্মসূচিও শহরবাসী দেখেননি। সম্প্রতি শিলিগুড়ির খালপাড়ায় পবন অগ্রবাল বলে এক ব্যক্তির পরিবারের ৭ জনের রক্তে ডেঙ্গির জীবাণু ধরা পড়ে। ওই বাড়ির লোকেরা জানান, গোড়া থেকেই সরকারি হাসপাতালের ‘দুশ্চিন্তার কিছু হয়নি’ বলে তাঁদের সান্ত্বনা জানানো হয়। অভিযোগ, পবনবাবুর পরিজনদের ডেঙ্গি নিয়ে হইচই না-করার ‘পরামর্শ’ও দিয়েছেন সরকারি কর্তারা। প্রশাসন অবশ্য তা মানতে চায়নি।
বৃহস্পতিবার ডেঙ্গি নিয়ে প্রশাসন উদাসীন বলে দাবি করে বিজেপি। বিজেপি-র দার্জিলিং জেলা সভাপতি রথীন বসুর কথায়, রোগ লুকানোর প্রবণতা যে মারাত্মক সেটা চিকিত্সা শাস্ত্রেই রয়েছে। তিনি বলেন, “অথচ এখন ডেঙ্গি হলেও চিকিত্সকেরা মুখ খুলতে চান না। এমন আতঙ্কের পরিবেশ থাকলে রোগ প্রতিরোধে সমস্যা হবে।” তাঁর কথায়, খোলামেলা ভাবে সকলকে রোগের কথা জানিয়ে প্রতিরোধে সামিল করতে হবে।
একটি নার্সিংহোমে ডেঙ্গি আক্রান্তরা।
প্রশাসনের কী বক্তব্য? স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানান, এ দিনের বৈঠকেই সব বিভাগ পরিসংখ্যানগুলি জানানোর পরে শহরে ডেঙ্গির প্রকোপ সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া গিয়েছে। অনেক রোগী নার্সিংহোমেই চিকিত্সা করিয়েছেন। সেক্ষেত্রে নার্সিংহোমগুলি কী সরকারকে জানিয়েছিল যে, তাদের কাছে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত রোগীরা চিকিত্সাধীন? নার্সিংহোম মালিকদের সংগঠনের তরফে একাধিক সদস্য জানান, সরকারি নিয়ম মেনে সব তথ্যই পুরসভা ও মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে বলা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে পুরসভা ও স্বাস্থ্য দফতর কী করেছে?
দার্জিলিং জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অসিত বিশ্বাস বলেন, “এনএসওয়ান রক্ত পরীক্ষায় যাঁদের ডেঙ্গি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, তাঁদের ম্যাক অ্যালাইজা পরীক্ষা করানো হয়েছে। সেই পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরেই বোঝা গিয়েছে, ঠিক কত জন এখন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত।”
সম্প্রতি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন প্রাক্তন সিপিএমের কাউন্সিলর তথা বরো চেয়ারম্যান বলরাম নাথ। গত মঙ্গলবার তিনি মারা যান। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে তিনি ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েই মারা গিয়েছেন। তাঁর ছেলে সঞ্জীববাবু জানান, দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন বলরামবাবু। নিয়মিত কেমো নিতে হত তাঁকে। তবে তিনি আপাতত সুস্থই ছিলেন বলে সঞ্জীববাবুর দাবি। যদিও শুক্রবার উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী বলেন, “বলরামবাবু জ্বরে আক্রান্ত হলেও তাঁর ডেঙ্গি হয়নি। তাঁর রক্তের এনএস-১ পরীক্ষায় পজিটিভ হলেও ম্যাক-অ্যালাইজ়া পরীক্ষায় নেগেটিভ পাওয়া গিয়েছে। সেই রিপোর্ট আমার কাছে এসেছে।” এদিন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী পুর এলাকায় পরিচ্ছন্নতার কাজে জোর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মন্ত্রী জানান, খালপাড়ায় আক্রান্তদের বাড়ির পাশে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে। তাতে বহুদিন সাফাই হয় না। তাতে আবজর্না ও জল জমে অস্বাস্থ্যকর অবস্থা হয়ে রয়েছে। তাঁর মালিককে খঁুজে বের করে তাঁকে নোটিশ করা হবে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন।
আপাতত পুরসভাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা পরিস্কার করে দেওয়ার জন্য। এদিকে, নার্সিংহোমে অনেক ক্ষেত্রেই ম্যাক-অ্যালাইজা পরীক্ষার করাতে সরকারি হারে যে টাকা নির্দিষ্ট করা রয়েছে তার চেয়ে বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পেয়েছেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, “নার্সিংহোমগুলিতে যে কেউ যেতেই পারেন। কিন্তু নার্সিংহোমগুলিকে আরও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। আতঙ্ক যাতে না ছড়ায় সেটা দেখতে হবে। সরকারি হারে যে টাকা নির্দিষ্ট করা হয়েছে তা-ই নিতে হবে।”
শিলিগুড়ি নার্সিংহোম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক পীযূষ রায় মন্ত্রীর অভিযোগের সঙ্গে সহমত। তিনি বলেন, “কোনও নার্সিংহোম আতঙ্ক ছড়ালে বা পরীক্ষার জন্য অস্বাভাবিক বেশি হারে পয়সা নিলে সেই নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। তবে সরকারি ভতুর্কি না থাকায় নার্সিংহোমগুলিকে সামান্য বেশি অর্থ নিতে হয়।”
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy