কেমন আয় হয় শহরের ইউটিউবারদের? ছবি: সংগৃহীত।
ইন্টারনেট ও মোবাইল— নয়া প্রজন্মের এই দুই অপরিহার্য বিষয়কে হাতিয়ার করে বিশ্ব জুড়ে বিনোদনের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে ইউটিউব। সারা বিশ্বের মতো এ দেশেও ক্রমশ লাফিয়ে বাড়ছে ইউটিউবের দর্শক সংখ্যা। আট থেকে আশি ইউটিউবের দর্শক কিন্তু সকলেই। তবে শুধু দর্শক হিসাবেই নয়, নতুন প্রজন্ম ইউটিউবকে উপার্জনের মাধ্যম হিসাবেও ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এখন অনেকেই অন্য পেশা ছেড়ে ইউটিউবার হতে চান। নিজস্ব একটি ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করেন, সেখানেই বিভিন্ন ধরনের ভিডিয়ো পোস্ট করেন তাঁরা। ইউটিউবের নিয়মিত দর্শক, এই ধরনের বিনোদন পেতে নিজেদের সেই চ্যানেলের সদস্য করে নেন। চ্যানেলের সদস্য সংখ্যা যত বাড়ে ততই বাড়ে ইউটিউবারের পরিচিতি।
টেলিভিশনের জনপ্রিয়তাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে ইউটিউব। কোনও কোনও ক্ষেত্রে টেলিভিশনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে সে কথা বললেও ভুল হবে না। এমনকি, প্রতি দিন টেলিভিশনের পর্দায় যাঁদের দেখা যায়, তাঁদের মধ্যেও অনেকেই ইদানীং এক-একটি করে ইউটিউব চ্যানেল খুলে ফেলেছেন। নিজেদের জীবনের রোজনামচা দর্শকদের সামনে তুলে ধরছেন তাঁরা। বাদ যান না টলিউড ও বলিউডের তারকারাও। ইউটিউব থেকে থেকে কী ভাবে আয় হয় আর আয়ের মাত্রা বাড়ানোর উপায় কী, সেই নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন শহরের ইউটিউবাররা।
আলোচনার শুরুতেই যে প্রশ্নটা উঠে এল, সেটি হল, ইউটিউবারদের রোজগার হয় কী ভাবে? অনেকেই মনে করেন, চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা বাড়লেই বোধহয় ইউটিউবের তরফ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা জমা পড়বে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। বিষয়টা কি আদৌ ঠিক? আপনি যেই ভিডিয়োটি পোস্ট করলেন তাতে কত সংখ্যক ‘ভিউ’ হল, প্রত্যক্ষ ভাবে তার উপরেও আপনার রোজগার নির্ভর করে না। বরং আপনার পোস্ট করা ভিডিয়োয় বিজ্ঞাপন আসছে কি না, সেটাই আসল কথা। ইউটিউব থেকে কী ভাবে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করা যায়? ‘স্নেহা দেবজিৎ’ চ্যানেলের দেবজিৎ পাল বলেন, ‘‘ইউটিউবাররা মূলত দু’ভাবে রোজগার করে থাকেন। এক, চ্যানেলে পোস্ট করা ভিডিয়োয় বিজ্ঞাপনের কমিশন থেকে আসা অঙ্ক। দ্বিতীয়ত, পেড-প্রোমোশন। অনেক সময়ে, কোনও কোনও ব্র্যান্ড তাদের প্রোডাক্টকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তোলার জন্য ‘সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার’দের খোঁজ করে। এ ক্ষেত্রে তারা অনেক সময়েই বেছে নেন ইউটিউবারদের। তাতে সংস্থার তরফে ইউটিউবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাদের প্রোডাক্টের প্রচার করতে বলা হয়। এর বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি অঙ্কের টাকা পান ইউটিউবাররা। কিন্তু সেই টাকার অঙ্কটা কত, তা নির্ভর করে ইউটিউবারের জনপ্রিয়তা ও তাঁর ভিডিয়োয় ‘ভিউ’ কত, তার উপরে। অনেকের ধারণা, ইউটিউবে সামান্য পরিচিতি পেয়ে গেলেই বোধ হয় অনেক টাকা আয় করা সম্ভব। বিষয়টা কিন্তু একেবারেই তা নয়। এখন ফেসবুকের মতো ঘরে ঘরে লোকে ইউটিউব চ্যানেল খুলছেন। এই প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা কিন্তু সহজ নয়। ইউটিউব ‘ফুল টাইম’ চাকরির মতো। এই পেশায় ধারাবাহিকতা না থাকলে উপার্জন হবে না। ধরুন এক জন ইউটিউবারের আড়াই লক্ষ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে এবং তিনি মাসে ১৫টি ভিডিয়ো করেন। তাঁর প্রতিটি ভিডিয়োতে ৭০ থেকে ৮০ হাজার ভিউ আসে। তিনি মাসে ১ লক্ষ টকা অবধি উপার্জন করতে পারেন। আর মাসে যদি ৪ থেকে ৫টি বিজ্ঞাপন ভিডিয়োতে ঢুকিয়ে দিতে পারেন, তা হলে আরও বাড়তি ২০ হাজার থেকে ১ লক্ষ পর্যন্ত আয় সম্ভব। পুরো বিষয়টি নির্ভর করে আপনি ব্র্যান্ডের সঙ্গে কতটা দর কষাকষি করতে পারছেন তার উপর। এমন অনেকেই আছেন যাঁদের চ্যানেল মনিটাইজ় হওয়ার হয়তো ১ বছর পর ১০০ ডলার (প্রায় ৮,০০০ টাকা) ব্যাঙ্কে ঢোকে। ১ বছর বিনা উপার্জনে পরিশ্রম চালিয়ে যাওয়ার ধৈর্য কিন্তু সবার থাকে না। আর এখানেই দৌড়ে পিছিয়ে পড়েন অনেকেই। ধরুন, আপনি মোটা অঙ্কের চাকরি ছেড়ে ইউটিউবে ৩-৪ বছর সময় দিয়ে সেখানে বেশ পরিচিতি লাভ করলেন, ভাল আয়ও হল। তবে আয়ে সব সময় একই হবে তা কিন্তু নয়, ৪ বছর পর ধরুন আপনার কনটেন্ট লোকে অপছন্দ করতে শুরু করল, তখন কিন্তু ভিউয়ের পাশাপাশি আয়ও কমে যাবে। এত বছর চাকরি ছাড়ার পর আবার পুরনো জায়গায় ফিরে যাওয়াও সহজ নয়, তাই সেই রিস্কটা নেওয়ার জন্যেও তৈরি থাকতে হবে।’’
মোটা অঙ্কের চাকরি ছেড়ে শয়ে শয়ে মানুষ ইউটিউবে ভ্লগ বানাচ্ছেন। ইউটিউবের দিকে ঝুঁকে কি কোথাও তরুণরা নিজেদের ভবিষ্যৎ বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে? ‘জ়িরোওয়াট ফিল্মস’ চ্যানেলের সৌমজিৎ ঘোষ বললেন, ‘‘এখন আর কেউ প্যাশনের কথা ভেবে কাজটা করছে না, সবাই রোজগারের কথা ভাবছে। বছর পাঁচের আগে আমিও চাকরি ছেড়ে ইউটিউব করা শুরু করি। তখন আমার মনে একটাই বিষয় কাজ করছিল জীবনে স্বাধীন ভাবে কিছু করব, কারও অধীনে থেকে আর কাজ নয়। সেই ভাবনা থেকেই আমার ইউটিউব যাত্রা। প্রথমের দিকে যখন ভিডিয়ো করতাম তখন ভিউ আসত না, হতাশা গ্রাস করত। অনেক ধৈর্য রাখার পর ‘জ়িরোওয়াট ফিল্মস’ এখন মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। যাত্রাপথ কিন্তু মোটেই সহজ নয়। প্রথম থেকেই টাকা কামানোর কথা মাথায় আনলে সমস্যা আছে। কাজটাকে ভালবাসতে না পারলে এই যাত্রায় ধৈর্য ঠিকিয়ে রাখা ভীষণ কঠিন। মানুষ কেমন ভিডিয়ো চাইছেন, আপনার কোন ধরনের ভিডিয়ো তাঁদের বেশি মনে ধরছে, আপনি কাজটা কতটা উপভোগ করছেন— আগে সেটা দেখতে হবে। পেশাকে নেশায় পরিণত না করতে পারলে এই ক্ষেত্রে কিন্তু সাফল্য আনা মুশকিল। শয়ে শয়ে লোকে ভিডিয়ো করছেন, আপনার কনটেন্ট অন্যদের থেকে আলাদা হলে তবেই লোকে আসবে আপনার ভিডিয়ো দেখতে। এর জন্য চাই পরিশ্রম, বুদ্ধি, প্রযুক্তিগত ধ্যান ধারণা। যাঁরা চাকরি ছেড়ে আসছেন তাঁদের কিন্তু এই কথাগুলি মাথায় রেখে চলতে হবে। ইউটিউবে আসার পর টাকার মুখ দেখতে অনেকটা সময় লেগে যায়। তাই নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে তবেই এই পথে হাঁটা উচিত।’’
একাধিক ভিডিয়ো বানিয়েও মনের মতো ভিউ আসে না বলে বলে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন। হারিয়ে যায় ভিডিয়ো বানানোর তাগিদ। ইউটিউবে চ্যানেলের ভিউজ় বাড়াতে হলে কোন কোন বিষয় মাথায় রাখা দরকার? কোন পথে সাফল্য আসবে? ‘দ্য লেজ়ি বং’-এর দীপ্ত শঙ্কর বক্সী বলেন, ‘‘ইউটটিউবের জগতে এখন প্রতিযোগিতা অনেক, তাই নিজের চ্যানেলকে এই বাজারে টিকিয়ে রাখতে চাইলে সবার আগে আপনাকে নিজের ভিডিয়োত নিজস্বতা রাখতে হবে। এমন কিছু করতে হবে যা আর পাঁচ জনের ভিডিয়োতে থাকবে না, তবেই কিন্তু ভিড়ের মাঝেও লোকে আপনাকে চিনতে পারবে। ইউটিউবের কাজে সৃজনশীলতার প্রয়োজন। একটা ভিডিয়োকে কী ভাবে সুন্দর করে দর্শকের সামনে তুলে ধরা যায়, সেই দক্ষতাটা আপনার মধ্যে থাকতে হবে। টাকা আয় না হলেও ভিডিয়ো বানিয়ে যাব— এই তাগিদটা রাখতে হবে মনের মধ্যে। টাকা কামাব বলে ভিডিয়ো বানালে কিন্তু হবে না, ভিডিয়ো বানানোর নেশা না থাকলে, সমাজমাধ্যমকে ভাল না বাসলে এই কর্মক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়া কঠিন। এ ক্ষেত্রে আপনার ভিডিয়োর গুণগত মানের উপরেও কিন্তু নজর দিতে হবে। সাউন্ড, ভিডিয়ো কোয়ালিটি, এটিডিংয়ের দিকে ভীষণ মন দিতে হবে। যে কোনও বিষয়ে ভিডিয়ো বানিয়ে ফেললেই হল না। সেই ভিডিয়োতে সঠিক তথ্য থাকতে হবে, বিনোদনমূলক উপাদান থাকতে হবে এবং একই সঙ্গে ভিডিয়োর গুণগত মানও ভাল হতে হবে— এই সব কিছু প্যাকেজ করে দর্শকের সামনে তুলে ধরতে পারলেই কিন্তু সাফল্য আসবে। একটা-দু’টো ভিডিয়ো ভাইরাল হয়ে গেলেই কিন্তু ভাল ইউটিউবার হওয়া যায় না। আপনার প্রতিটি ভিডিয়ো যেন মানুষের ভাল লাগে, সেই প্রচেষ্টাই চালিয়ে যেতে হবে। টাকার জন্য ভিডিয়ো বানালে হবে না, ভাল ভিডিয়ো বানানোর দিকে মন দিলে টাকা এমনিই আসবে।’’
অনেকে স্বাধীন ভাবে কাজ করার জন্য ইউটিউবে আসেন। এই ক্ষেত্রে কি সত্যিই সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে কাজ করা যায়? নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক টেক ইউটিউবার বলেন, ‘‘ইউটিউবে মোটা আয় করতে চাইলে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রচারমূলক ভিডিয়ো আপনাকে নিজের ভিডিয়োতে রাখতেই হবে। আর ব্র্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হলেই প্রতক্ষ ভাবে না হলেও পরোক্ষ ভাবে তারা আপনার ভিডিয়োতে হস্তক্ষেপ করে। ভিডিয়োটি নির্দিষ্ট সময় প্রকাশ করার একটা চাপ থাকে। ধরুন কোনও ভিডিয়ো আপনি দু’চার দিন পর আরও একটু ভাল এডিট করে প্রকাশ করতেন। কিন্তু ব্র্যান্ডের চাপে পড়ে আপনাকে সময়ের আগেই সেটা ছেড়ে দিতে হল, এ ক্ষেত্রে আপনাকে গুণগত মানের সঙ্গে আপস করতে হল বইকি! এ ছাড়াও টেক ভিডিয়োর ক্ষেত্রে ভিডিয়ো বানানোর সময় আপনার আশেপাশে আর কোন সংস্থার জিনিস থাকবে সেটাও কিন্তু ব্র্যান্ডই ঠিক করে দেয়। ওরা আপনাকে টাকা দিচ্ছে তাই আপনাকেও ওদের মতো করে চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে কিন্তু ইউটিউবে থেকেও আপনার মাথার উপরে ছড়ি ঘোরানোর লোক চলেই আসে। কাজ করার স্বাধীনতা কিছুটা হলেও বাধা পায়। বেশি টাকা কামাতে হলে ব্র্যান্ডের সঙ্গে মানিয়ে চলা ছাড়া কিন্তু উপায় নেই।’’
দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে এবং আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল হতে বিভিন্ন বয়সের মানুষ ইউটিউবকে পেশা হিসাবে বেছে নিচ্ছেন। ঝাঁপ দিচ্ছেন অনিশ্চিতের দিকে। নেটমাধ্যমে প্রভাবী (ইনফ্লুয়েন্সার) হওয়ার স্বপ্ন দেখেন অনেকেই। এই কাজেও কিন্তু প্রচুর পরিশ্রম দরকার হয়। দশর্কের পছন্দ বুঝে সেই মতো বিনোদনমূলক বা তথ্যমূলক কোনও অনুষ্ঠান তাঁদের সামনে নিয়ে আসা একেবারেই সহজসাধ্য নয়। সেই সঙ্গে তো রয়েছে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা। তা ছাড়া সাফল্য-ব্যর্থতা তো লেগেই আছে। অনেকে বলছেন, কম সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা এবং অর্থ— এই দুইয়ের কারণেই মূলত এই পেশার প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রতিযোগিতার বাজার ও মানসিক চাপ। এর প্রভাব পড়ছে ব্যক্তিগত জীবনেও। তাঁদের মতে, ইউটিউবকে আয়ের একমাত্র উৎস হিসাবে না দেখে নিজেদের শিল্পীসত্তা প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে দেখাই শ্রেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy