চাকরির সূত্রে মুম্বইয়ে থাকতে বেতনের প্রায় অর্ধেক টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া। কিন্তু লকডাউন পরিস্থিতিতে বাড়ি থেকেই কাজ চলছে। বেহালার বাসিন্দা, বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী স্নেহা হালদার তাই বুঝে পাচ্ছেন না, তাঁর বান্দ্রার ফ্ল্যাট আর বকুলতলার বাড়ির পার্থক্য! তাঁর কথায়, “ওয়ার্ক ফ্রম হোমে কোন বাড়িতে বসে কাজ, তা কেউ দেখতে আসছেন না। অফিসই যেতে না হলে মাসে মাসে লক্ষাধিক টাকা ভাড়া দিয়ে ফ্ল্যাটে কেন থাকব!” কেরলের বাসিন্দা, তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থার এক কর্মী আবার মাঝেমধ্যেই ল্যাপটপ নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসছেন। তাঁর বাড়িতে নাকি কাজের পরিবেশ নেই! বন্ধুরা মজা করে বলছেন, ‘ওয়ার্ক ফ্রম কার’!
করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় সব ক্ষেত্রেই কর্মীদের কাজের ধরন বদলেছে। দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়েছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। প্রাথমিক কিছু সমস্যা সামনে এলেও বহু বেসরকারি সংস্থা এখন মনে করছে, বাড়ি থেকে কাজ করাই হয়ে উঠতে চলেছে ভবিষ্যতের কর্ম-সংস্কৃতি। টিসিএস-এর মতো তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী পাঁচ বছর মাত্র ২৫ শতাংশ কর্মী অফিসে এসে কাজ করবেন। বাকি ৭৫ শতাংশ কাজ করবেন বাড়ি থেকেই। সংস্থার তরফে বলা হয়েছে— ‘এটা ২৫/২৫ মডেল। ২০২৫ সাল পর্যন্ত ২৫ শতাংশ কর্মী দিয়েই অফিস চালানো হবে। উৎপাদনশীলতা ১০০ শতাংশ সচল রাখতে এর বেশি সংখ্যক কর্মীকে অফিসে আনানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বাকিরা বাড়ি থেকে করলেই হবে।’
ন্যাসকমের পূর্বাঞ্চলীয় শাখার অধিকর্তা নিরূপম চৌধুরী আবার বলছেন, “পরবর্তী কালে যদি অফিসে লোক আনতে হয়, তা হলে ওই কর্মী কত ক্ষণ অফিসে থাকবেন তা তাঁর কাজের ধরনের উপরে নির্ভর করবে।”
তবে কি আট ঘণ্টার কাজের রীতিও বদলাতে চলেছে?
তথ্য-প্রযুক্তি থেকে নানা বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত কর্তা-কর্মীরা জানাচ্ছেন, বাড়ি থেকে কাজের ফলে খরচের সঙ্গে সঙ্গে যাতায়াতের সময়ও বাঁচবে। সে কারণে আরও কাজের সুযোগ তৈরি হতে পারে। কর্মক্ষেত্রের বাঁধা-ধরা সময় না থাকায় বহু গৃহবধূ, অবসরপ্রাপ্ত কর্মী বা পড়ুয়ার জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি হতে পারে। কাজের জন্য অনেককে আবার ভিন্ রাজ্য বা বিদেশে পাড়ি দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে অফিস না যেতে হলে বিদেশে পড়ে থাকার মূল কারণই থাকবে না। তাঁদের বক্তব্য, “কলকাতার ছেলে বাড়ি বসেই ক্যালিফোর্নিয়ার অফিসে হাজিরা দিতে পারবেন। বিদেশ থেকে বহু কাজের সুযোগ আসবে দেশে।”
সেক্টর ফাইভ স্টেক হোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি কল্যাণ করের যদিও দাবি, তথ্য-প্রযুক্তি কাজকে মূলত দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত আইটি পরিষেবা, যা মূলত সফটঅয়্যার তৈরির কাজ। দ্বিতীয়ত বিপিও বা কলসেন্টারের মতো আইটি এনাবেল পরিষেবা। প্রথমটিতে বাড়ি থেকে কাজ করার প্রচলন বহু দিন থেকেই চলছে। কিন্তু বিপিও বা কলসেন্টারের কাজ এখনই বাড়ি থেকে করা সম্ভব হচ্ছে না। কল্যাণের কথায়, “মূল সমস্যা হল তথ্য নিরাপত্তা। যেমন ব্যাঙ্কের তথ্য সংক্রান্ত কাজ বাড়ি বসে করতে গিয়ে নিরাপত্তা না থাকলে সমস্যা। আর একটি বড় সমস্যা বাড়ির উপযুক্ত কাজের পরিবেশ না থাকা। ইন্টারনেট বা নির্ভরশীল ব্যান্ডউইথ না থাকার চেয়েও যা বড়। অনেকের বাড়িতেই হয়তো ব্যক্তিগত কাজের পরিসর কম।” তিনি আরও বলেন, “এর জন্য উৎপাদনশীলতায় প্রভাব পড়তে বাধ্য। একটি সংস্থার কথা জানি, যার বহু কর্মী সুন্দরবন এলাকায় থাকেন। প্রায়ই ঝড়ে সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ চলে যায়। এখন বাড়ি থেকেই তাঁদের কাজ করতে হওয়ায় ভোর থেকে শুরু করে বিকেলের মধ্যেই সব কাজ শেষ করছেন ওঁরা। চেষ্টা করলে সব হতে পারে।”
কিন্তু এই চেষ্টার অভাবই বাড়ি বসে কাজের সব চেয়ে বড় বাধা বলে মত অনেকের। তাঁরা জানাচ্ছেন, অফিসে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শুরুর নিয়ম অনেকেই বাড়ি থেকে কাজ করতে গিয়ে মানছেন না। সেই সঙ্গে রয়েছে নজরদারির অভাব। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের আহ্বায়ক সৌম্য বিশ্বাস যদিও বললেন, “যাঁরা কাজ করার তাঁরা করবেনই। সরকারি ক্ষেত্রে ওয়ার্ক ফ্রম হোম চালুর সুফল পাওয়া গিয়েছে। সরকার এত দিন যে ই-ওয়ার্ক ব্যবস্থায় জোর দিতে চাইছিল তা সফল হয়েছে। এখন সবই অনলাইনে হচ্ছে।”
তবে বাড়ি থেকে কাজে সকলেই যে খুশি, এমন নয়। বাগবাজারের এক কলেজশিক্ষিকার কথায়, “সহকর্মী, পড়ুয়াদের সঙ্গে মুখোমুখি কথোপকথনের যে শান্তি, তা বাড়িতে বসে কাজের প্রযুক্তি-নির্ভরতায় কোথায়?”
আরও পড়ুন: করোনা ও লকডাউনের সময় ভাবী মায়েরা কী করবেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy