মাঝেমাঝেই ভোররাতে প্রচণ্ড মাথাব্যথায় ঘুম ভেঙে যাচ্ছে, সঙ্গে বমি বমি ভাব। অথচ বোঝা যাচ্ছে ব্যথাটা মাইগ্রেনের নয়। কারণ যন্ত্রণার ধরনটা বেশ অদ্ভুত এবং অসহ্য। সামান্য নড়াচড়া করলেই ব্যথাটাও কেমন বদলে যাচ্ছে। সাধারণ কথা, কয়েক দিন আগের ঘটনাও ভুলে যাওয়ার সমস্যা বাড়ছে। ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষটি যেন বদলে যাচ্ছে। চলতে-ফিরতে টাল সামলানো যাচ্ছে না। হাত-পা নাড়াতেও অসুবিধে হচ্ছে।
উপরের লক্ষণগুলিকে চিনে রাখুন। এগুলি কিন্তু ব্রেন টিউমরের উপসর্গ। এই রোগের নাম শুনেই আঁতকে ওঠার দরকার নেই। মস্তিষ্কে টিউমর হয়েছে মানেই আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, এমনটা নয়। মস্তিষ্কের অনেক টিউমরই বিনাইন। অর্থাৎ ক্যানসারমুক্ত। উপযুক্ত চিকিৎসায়, ঠিক অস্ত্রোপচারে সেরে যায়। অনেক সময়ে ওষুধেও নিরাময় সম্ভব। সে ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হয় না। তবে ম্যালিগন্যান্ট অর্থাৎ ক্যানসারযুক্ত টিউমরের ক্ষেত্রে ঠিক সময়ে রোগ শনাক্ত হওয়া জরুরি। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিউমর বাদ দিয়ে বহু মানুষই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান। এ বিষয়ে জরুরি পরামর্শ দিলেন কনসালট্যান্ট নিউরো-সার্জন ডা. পরিমল ত্রিপাঠী এবং স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়ন্ত রায়।
অধিকাংশ ব্রেন টিউমরই বিনাইন
মস্তিষ্কের ভিতরে অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ব্রেন টিউমর দেখা দিতে পারে। ডা. পরিমল ত্রিপাঠীর কথায়, মস্তিষ্কের টিউমর সাধারণত দু’রকম। যেগুলির উৎসকোষ মস্তিষ্কের মধ্যে, সেগুলি ‘প্রাইমারি ব্রেন টিউমর’। শরীরের অন্য কোথাও ক্যানসার হয়ে মস্তিষ্কে এলে তাকে ‘সেকেন্ডারি ব্রেন টিউমর’ বলে। মূলত ব্রেস্ট, কিডনি, কোলন থেকে এই ক্যানসার মস্তিষ্কে আসে। লিউকিমিয়া, লিম্ফোমা প্রভৃতি থেকেও ব্রেনে টিউমর হয়। প্রাইমারি ব্রেন টিউমরের মধ্যেও দু’-তিন রকম ভাগ আছে। মস্তিষ্কের কোষ থেকে উৎপন্ন টিউমর হতে পারে। সাপোর্টিং সেলসের মধ্যে অ্যাস্ট্রোসাইটস থেকে অ্যাস্ট্রোসাইটোমা, অলিগোডেনড্রোসাইটস থেকে অলিগোডেনড্রোগ্লায়োমা, এপেনডাইমা থেকে এপেনডাইমোমা হতে পারে। এর কোনওটা লো গ্রেডের টিউমর, কোনওটা হাই গ্রেডের। হাই গ্রেডের ক্ষেত্রে টিউমর তাড়াতাড়ি বড় হয়, লো গ্রেডের টিউমর ধীরে-ধীরে ছড়ায়।
মস্তিষ্কের মেনিনজেস থেকে (ব্রেন সেল থেকে নয়) যে টিউমর হয়, সেটি মেনিনজিয়োমা। এটি প্রধানত বিনাইন। কিন্তু বহু দিন থাকলে, এতেও ম্যালিগন্যান্সি দেখা দিতে পারে। স্নায়ু থেকে (যেমন অপটিক নার্ভ, অডিটরি নার্ভ) তৈরি টিউমরও বিনাইন হতে পারে। একে বলে সোয়ার্নোমা।
ডা. জয়ন্ত রায় বললেন, ‘‘এপেনডাইমোমা, অলিগোডেনড্রোগ্লায়োমা, মেনিনজিয়োমা প্রভৃতি বেশির ভাগ ব্রেন টিউমরই বিনাইন। মেনিনজিয়োমার ক্ষেত্রে টিউমর সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে রোগীকে পুরোপুরি সুস্থ সবল করে তোলা যায়। এমনও হয়েছে— রোগীর খুবই ছোট মেনিনজিয়োমা, কোনও সমস্যা নেই। সেখানে সার্জারিও লাগেনি। এই ধরনের মেনিনজিয়োমা ওই রকমই রেখে দেওয়া যায়।’’
রোগ লক্ষণের প্রকারভেদ
‘‘মস্তিষ্ক থাকে খুলির মধ্যে, বদ্ধ অবস্থায়। তার মধ্যে অতিরিক্ত কিছু থাকলে ক্রেনিয়াল ক্যাভিটিতে চাপ বাড়বে। চাপ বাড়ার কারণে, টিউমরের কারণে, অপটিক নার্ভ অর্থাৎ চোখের স্নায়ুকে চাপ দেওয়ার জন্য, এপেনডাইমা থেকে টিউমর হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের জল জমার জন্য ‘সিমটমস অব রেইজ়ড ইনট্রাক্রেনিয়াল প্রেশার’ দেখা দেয়। এই উপসর্গগুলি হল মাথাব্যথা (বিশেষত সকালে), বমি ভাব, কোনও কাজ করতে গেলে মাথার যন্ত্রণা।
‘‘টিউমর মস্তিষ্কের কোথায় হয়েছে, তার উপরে নির্ভর করবে অন্যান্য উপসর্গগুলি। মস্তিষ্কের প্রতিটি অংশেরই আলাদা কাজ আছে। যে অংশে টিউমর হয়েছে, সেই অংশের কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে কি না, তা বোঝা গেলেও আদতে অসুখটিকে ধরতে সুবিধে হবে। যেমন, মাথার পিছনের অক্সিপিটাল লোবে টিউমর থাকলে দৃষ্টিশক্তির সমস্যা হবে। টেম্পোরাল লোবের ক্ষেত্রে শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে। ফ্রন্টাল লোবের ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্বে বদল আসতে পারে,’’ বললেন ডা. ত্রিপাঠী।
তাঁর কথায়, ‘‘এ ছাড়াও মস্তিষ্কের কিছু অংশ আছে যেগুলিকে ‘সাইলেন্ট এরিয়া’ বলা হয়। সেখানে টিউমর হলে মস্তিষ্কের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত লক্ষণ না-ই থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে বমি, মাথাব্যথা দেখেই চিকিৎসক টিউমরের সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখেন।’’
রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা
সিটি স্ক্যানে টিউমর হয়েছে কি না ধরা পড়ে। এমআরআই-এ আন্দাজ করা যায় টিউমরটি কতটা লো গ্রেড অথবা হাই গ্রেডের। টিউমরের জায়গাটা কোথায় ও সেটি কত বড় এবং আক্রান্তকে সেটি কী ভাবে অক্ষম করছে, তার উপরে ভিত্তি করে চিকিৎসাপদ্ধতি স্থির করা হয়। টিউমর পুরোপুরি বার করে আনাই লক্ষ্য। কিছু ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। যতটা সম্ভব হয়, টিউমরের ততখানি অংশই বার করা হয়। বায়পসি রিপোর্ট দেখে, কেমোথেরাপি ও রেডিয়োথেরাপির প্ল্যান দেওয়া হয়।
ডা. রায় বললেন, ‘‘এই রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসাপদ্ধতি এখন অত্যন্ত উন্নত। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে যা ভাবতেই পারতাম না, তা আজ বাস্তব। ম্যালিগন্যান্ট ব্রেন টিউমর সারিয়ে রোগীকে সুস্থ স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে, তাঁদের আয়ু বাড়ানো হয়েছে। তবে ম্যালিগন্যান্ট টিউমরের ক্ষেত্রে অসুখ ফিরে আসার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়।’’
জীবনের নিরাপত্তা
নতুন প্রযুক্তিতে আগে থেকেই জানা যাচ্ছে যে, টিউমরটির ম্যালিগন্যান্ট হওয়ার সম্ভাবনা কতটা, অস্ত্রোপচার করলে মস্তিষ্কের কোথায় কতটা ক্ষতি হতে পারে। সার্জারির পরে খুব ভাল ফলও মিলছে। মস্তিষ্কের অন্যত্র প্রভাব পড়ছে না। ডা. জয়ন্ত রায়ের কথায়, ‘‘ধরুন, টিউমর রয়েছে মস্তিষ্কের বাঁ দিকে, রোগীর ‘স্পিচসেন্টার’-এর উপরে। এই টিউমর বার করার সময়ে রোগীর ডান দিকে প্যারালিসিস হতে পারে, বাক্শক্তিও চলে যেতে পারে। নতুন প্রযুক্তিতে স্পিচ সেন্টার থেকে টিউমরটা কত দূরে আছে, সেটায় লেগে যাচ্ছে কি না— আগেই জানা যায়। শল্যচিকিৎসক কোন দিক দিয়ে এগোলে মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে কম ও সুফলের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তাও জানা সম্ভব। ফলে রোগী দারুণ উপকৃত হচ্ছেন। ‘অ্যাওয়েক ক্রেনিয়োটমি’ পদ্ধতিতে তো মাথা খুলে অস্ত্রোপচারের সময়ে রোগীকে অজ্ঞান করারও প্রয়োজন হয় না। চিকিৎসক কথা বলেন রোগীর সঙ্গে, রোগী গান করেন, বেহালা বাজান— সেই অবস্থাতেই অপারেশন হয়। যদি চিকিৎসক ‘স্পিচ এরিয়া’-য় ঢুকে যান, তা হলে কিন্তু রোগীর কথা বলতে অসুবিধে হবে। ডাক্তারও সাবধান হয়ে যাবেন। এখন এ রকম নানা ভাবে মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাঁচিয়ে সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার কলকাতাতেও হচ্ছে। তাই ব্রেন টিউমর নিয়ে ভয় অনেকটাই কমে গিয়েছে।’’
প্রতিরোধ সম্ভব?
কিছু জেনেটিক ফ্যাক্টরের কারণে এই রোগের সম্ভাবনা বাড়ে। সে সব প্রতিরোধ করা যায় না। স্তন বা কোলন ক্যানসারের সম্ভাবনা তো আগে থেকেই নির্ণয় করা যাচ্ছে। মস্তিষ্কের টিউমরের গবেষণাও সে দিকেই এগোচ্ছে। মোবাইল, হেডফোনের অতিব্যবহারে রোগটি হয় কি না, তারও প্রমাণ মেলেনি।
রোগটির প্রসঙ্গে ডা. ত্রিপাঠী বলছেন, ‘‘রাস্তায় বেরোলে কখন দুর্ঘটনা ঘটবে আর কখন ঘটবে না, তা কে বলতে পারে?
তেমনই ব্রেন টিউমর হবে কি না, তাও বলা যায় না। অতএব জীবনের রাস্তাতেও চোখ-কান খোলা রাখুন, সতর্ক থাকুন। বিপদের লক্ষণ দেখলেই চিকিৎসকের কাছে আসুন। যত তাড়াতাড়ি আসবেন, চিকিৎসার সুযোগও তত বেশি থাকবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy