গবেষকদের দাবি, কোভিডে আক্রান্ত ও মৃতদের মধ্যে মহিলাদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যাই বেশি। ছবি: পিটিআই।
কোভিড-১৯-এর দাপটে এখনও কোণঠাসা বিশ্ব। প্রতি দিনই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে গবেষকদের দাবি, কোভিডে আক্রান্ত ও মৃতদের মধ্যে মহিলাদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যাই বেশি। এই মতের সপক্ষে বেশ কয়েকটি পরিসংখ্যানের কথাও উল্লেখ করেছেন তাঁরা। যেমন:
• ২২ এপ্রিল ‘জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন হাসপাতালে যে ৫ হাজার ৭০০জন কোভিড রোগী ভর্তি আছেন, তার মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি আছেন পুরুষ রোগী। এঁদের মধ্যে যে ৩৭৩ জনকে আইসিইউ-তে পাঠানো হয়েছে, তাতেও সংখ্যাধিক্য পুরুষের, মোট রোগীর প্রায় ৬৬.৫ শতাংশ।
• এপ্রিল মাসের গোড়ায় আর একটি গবেষণার কথা প্রকাশ্যে আনে ‘ওয়েস্টার্ন জার্নাল অব এমারজেন্সি মেডিসিন’। সেখানে গবেষকরা জানিয়েছেন, উহানের হাসপাতালে যত সংখ্যক কোভিড রোগী ভর্তি আছেন, তার মধ্যে ৫১-৬৬.৭ শতাংশ হলেন পুরুষ। ইটালিতে পুরুষ রোগীর সংখ্যা, মোট রোগীর ৫৮ শতাংশ।
আরও পড়ুন: ধরা পড়ছে করোনার নতুন নতুন উপসর্গ, যে সব লক্ষণ দেখলেই সতর্ক হতে বলছেন চিকিৎসকরা
• ৪৪ হাজার ৬০০জন কোভিড রোগীকে নিয়ে এক সমীক্ষা হয় চিনে। দেখা যায়, এঁদের মধ্যে ২.৮ শতাংশ পুরুষ মারা গেছেন। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে মারা যাওয়ার সংখ্যাটা এর প্রায় অর্ধেক। ১.৭ শতাংশ।
পুরুষ ও মহিলাদের শরীরে কোভিড সংক্রমণ নিয়ে এমন নানা সমীক্ষা-গবেষণা হয়ে চলেছে সারা পৃথিবী জুড়ে। এবং তারা প্রত্যেকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে, পুরুষদের ক্ষেত্রে কোভিড একটু বেশি-ই ভয়ানক হয়ে উঠছে। দেশ-কাল নির্বিশেষে পুরুষকে সে আক্রমণ করছে বেশি, অধিক জটিলতা সৃষ্টি করছে। বিশ্ব জুড়ে মহিলাদের তুলনায় বাড়ছে পুরুষের মৃত্যুর হারও।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে পুরুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা মহিলাদের তুলনায় কম। ছবি: পিটিআই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী জানিয়েছেন, “সারা পৃথিবী যে ভাবে আক্রান্ত, আমাদের দেশে তো এখনও সে ভাবে নয়। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আমেরিকা-স্পেন-ইটালির তুলনায় এখনও এ দেশে অনেক কম। তবু সে জায়গায় দাঁড়িয়ে, দেশীয় কোনও পরিসংখ্যাগত তথ্য দিতে না পারলেও, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে মহিলাদের তুলনায় পুরুষেরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। জটিলতাও বেশি হচ্ছে তাঁদের। তবে শুধু কোভিড নয়, করোনা গ্রুপের যে কোনও ভাইরাসের ক্ষেত্রেই এ কথা সত্য।”
ম্যান ফ্লু! সেটা কী?
২০০৩ সালে সার্স ও ২০১২ সালে মার্স যখন ডালপালা মেলেছিল পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে। এদের মূলেও করোনা গোত্রের অন্য দু’টি ভাইরাসের হাত ছিল। তখনও ঘটেছিল এই একই ঘটনা। সেই ভাইরাসের আক্রমণেও মহিলাদের তুলনায় বেশি সংখ্যক পুরুষ মারা যান। ২০১৬-র এক গবেষণা থেকে জানা যায়, মার্সের প্রভাবে বিশ্বে যত মহিলা মারা গিয়েছিলেন, পুরুষ মারা গিয়েছেন তার চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। এই পরিসংখ্যানগত কারণের জন্য তখন মার্সকে ডাকা হত ‘ম্যান ফ্লু’ নামে।
কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা জানান, যে সব ভাইরাস প্রধাণত শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করে, তাদের প্রভাবে ছেলেরা ঘায়েল হয় বেশি। এমনকি, ঋতু পরিবর্তনের সময় যে সাধারণ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়, তাতেও ভোগেন বেশি পুরুষেরা। অর্থাৎ এই সব ভাইরাসের বিরুদ্ধে পুরুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা মহিলাদের তুলনায় কম।
আরও পড়ুন: ভিড় শুধু নয়, বদ্ধ ঘরও বিপদ বাড়ায়
কেন পুরুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম?
এই ‘কেন’-র নেপথ্যে অনেক তত্ত্ব আছে। কেউ বলছেন যৌন হরমোনের কথা। কোনও কোনও বিজ্ঞানী বলছেন ক্রোমোজোমের কথা। কেউ আবার এনেছেন রিসেপ্টারের তত্ত্ব। মানব কোষের অন্তঃস্থলে ঢুকতে কোভিড যার সাহায্য নেয়, তা রিসেপ্টার। কেউ আবার তুলে ধরেছেন মহিলাদের সহজাত নিয়ম-নিষ্ঠার কথা।
যৌন হরমোন
সার্স ও মার্স নিয়ে গবেষণা করে ২০১৭ ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে এক প্রবন্ধ ছাপা হয়। তাতে বিজ্ঞানীরা জানান, এই জাতীয় ভাইরাসের বিরুদ্ধে ছেলেদের প্রতিরোধ শক্তি কম থাকার নেপথ্যে সম্ভবত লুকিয়ে আছে যৌন হরমোনের মধ্যে। কিন্তু কী ভাবে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন?
‘দ্য জার্নাল অব ইমিউনোলজি’-তে প্রকাশিত এক প্রবন্ধ অনুযায়ী, বিভিন্ন বয়সি নারী ও পুরুষ ইঁদুরের শরীরে সার্স ভাইরাস প্রবেশ করিয়েছিলেন গবেষকরা। তাতে দেখা যায়, পুরুষ ইঁদুরগুলি আক্রান্ত হয়েছে বেশি সংখ্যায়। এ বার মহিলা ইঁদুরদের একাংশের যৌন হরমোন ইস্ট্রোজেনের উৎস ডিম্বাশয় কেটে ফেলা হল ও এমন ওষুধ দেওয়া হল যাতে ইস্ট্রোজেন আর কোনও ভাবেই বেরতে না পারে। এ বার সব মহিলা ইঁদুরদের শরীরে সার্স ভাইরাস ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হল। দেখা গেল, যে সব ইঁদুরের শরীরে ডিম্বাশয় তথা ইস্ট্রোজেন আছে, তাদের চেয়ে ডিম্বাশয় বাদ পড়া মহিলা ইঁদুররা বেশি সংখ্যায় মারা যাচ্ছে। গবেষকরা জানান, ইস্ট্রোজেন তথা স্ত্রী যৌন হরমোন শরীরে নিঃসৃত হওয়ায় মহিলারা তুলনামূলক ভাবে কম ক্ষতিগ্রস্থ হন।
ক্রোমোজোম
‘মেয়ো ক্লিনিক’-এর গবেষক ভিনা তানেজা জানিয়েছেন, নারী ও পুরুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার তারতম্যের মূলে এক্স ক্রোমোজোমের হাত থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি। সাধারণত, নারীরক শরীরের কোষে থাকে দু’টি এক্স ক্রোমোজোম ও পুরুষ শরীরে একটি এক্স ও একটি ওয়াই ক্রোমোজোম। এক্স ক্রোমোজোমের মধ্যে এমন কিছু জিন আছে, যারা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। যদিও দ্বিতীয় এক্স ক্রোমোজোম একটু চুপচাপই থাকে, তবে তার মধ্যেও যে সব সুরক্ষা জিন আছে তাদের ১০ শতাংশ কিন্তু বেশ কার্যকর। এবং তার ফলেই এই ফারাকটা ঘটে যায়।
আরও পড়ুন: অতিমারির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত দেবী
বিজ্ঞানীদের দাবি, রিচ্ছন্নতার অভ্যাসেও এগিয়ে মেয়েরা।ছবি: শাটারস্টক।
রিসেপ্টারের তত্ত্ব
আর একটি ব্রিটিশ গবেষণার মত, নোভেল করোনাভাইরাস লুকিয়ে থাকতে পারে ছেলেদের টেস্টিসে। মেয়েদের ডিম্বাশয়ে কিন্তু এর চিহ্নমাত্র থাকে না। কিন্তু কেন? বিজ্ঞানীরা এখানে সামনে আনছেন রিসেপ্টার তত্ত্ব। এসিই-২ নামের রিসেপ্টারে ভর করে কোষের গভীরে ঢোকে কোভিড-১৯। যেখানে যেখানে এই রিসেপ্টারের প্রাচুর্য, সেখানেই তার রাজত্ব। পুরো শ্বাসযন্ত্র জুড়েই বসে আছে এমন রিসেপ্টার। রয়েছে পরিপাকতন্ত্র জুড়েও। টেস্টিসেও এর উপস্থিতি রয়েছে। বিজ্ঞানীদের দাবি, সে কারণেই মেয়েদের শরীর থেকে কোভিড পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন গড়ে ৪ দিন সময় লাগলেও, ছেলেদের ক্ষেত্রে রিসেপ্টার বেশি থাকায় সময় লাগে গড়ে ৬ দিন। এই বাড়তি দু’দিনে শরীরে মরণকামড় বসাচ্ছে করোনা। ফলে রোগ জটিল হচ্ছে ও মৃত্যু ঘটছে রোগীর। তবে এই ভাইরাস পুরুষের টেস্টিসকেও সংক্রামিত করে, না কি কেবল রিসার্ভার হিসেবেই ব্যবহার করে, তা জানতে এখনও অনেক গবেষণা প্রয়োজন।
পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস
মেয়েদের রোগ কম হওয়া বা কম রোগের প্রকার তুলনায় কম জটিল হওয়ার মূলে এই কয়েকটা কারণই শেষ নয়। বিজ্ঞানীদের অভিমত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ঘন ঘন নিয়ম-কানুন মানার বিষয়ে মেয়েদের যে সহজাত প্রবৃত্তি, তাও এই তফাতের আর একটা বড় কারণ। পুরুষরাও অবশ্যই পরিচ্ছন্ন থাকেন, তবে সাধারণত ঘন ঘন পরিচ্ছন্ন হওয়ার অভ্যাস পুরুষের চেয়ে মেয়েদেরই বেশি। এই অভ্যাসই কোভিড ঠেকাতে মেয়েদের কিছু বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে বলে গবেষকদের একাংশের মত।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy