Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bhaiphonta Celebration

ভাইফোঁটার উৎস সন্ধানে নামলে কিন্তু জৈন ধর্মেও খুঁজে পাওয়া যায় একটি কাহিনি

কী আছে ভাইফোঁটার উৎসবে? কোথা থেকে এল এই উৎসব? এই উৎসব কি শুধুমাত্র বাংলার? না কি সমগ্র দেশবাসীর? নানা কাহিনি ছড়িয়ে আছে নানা বইয়ে।

bhaiphota

ছবি: সংগৃহীত।

অতীন্দ্র দানিয়াড়ী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:০১
Share: Save:

গণেশ ঠাকুরের পর কর্মের দেবতা বিশ্বকর্মা। তার পর, আভিজাত্য আর বনেদিয়ানার চালচিত্রে অসুর বধের মহোৎসব দুর্গাপূজা। এই মহোৎসবের রেশ কাটতে না কাটতেই চলে আসে সম্পদের দেবী লক্ষ্মী আর আলোর উৎসব কালীপূজা। আশ্বিনের শারদ প্রভাত থেকে কার্তিকের কুয়াশাঘেরা আবছায়ায় চলে উৎসবের আয়োজন। এই সময়ে নিয়ম মেনে একের পর এক দেবদেবীরা আসেন, চলে পূজা, আরাধনা, হোমযজ্ঞ। কিন্তু এত পূজা আয়োজনের ভিড়ে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের ঘনঘটায় একটি উৎসব একেবারেই ব্যতিক্রমী। অজস্র দেবতার-যাওয়া আসার মাঝখানে বাঙালির এই একচিলতে উৎসব হল ভাইফোঁটা, যেখানে কোনও দেবতা নেই।

প্রায় দেড় মাস ধরে চলা উৎসব মুখর এই সময়টায় দেবদেবীদের আনাগোনায় চারপাশটা উজ্জ্বল হয়ে থাকলেও, দেবদেবীহীন ভাইফোঁটার দিনটির জন্য কিন্তু সকলেরই অপেক্ষা থাকে। ওই একটি দিন তার নিজস্ব মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, মাতিয়ে রাখে বাঙালিকে। অদ্ভুত এই উৎসব, যেখানে কোনও পুজা-আরাধনার প্রয়োজন পড়ে না। এখানে কোনও আলো, মণ্ডপ বা পুরোহিতকেও দরকার লাগে না। এই উৎসবে মানুষ থাকলেও মানুষের ভিড় নেই, আলোর রোশনাই নেই, মাইক্রোফোনের চিৎকারও নেই। অথচ বাঙালির সমাজ জীবনে ভাইফোঁটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক উৎসব হয়ে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। সে দিন প্রতিটি ঘর থেকে শোনা যায় একটাই সংলাপ, ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা, যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমার ভাই যেন হয় সোনার ভাঁটা’। এই সংলাপই যেন ভাইফোঁটা উৎসবের আবহ সঙ্গীত। পূজা-অর্চনার মন্ত্রের মতো এই মন্ত্রই ভাইফোঁটার একমাত্র শাস্ত্রীয় বিধান। কিন্তু কেন? কী আছে এই ভাইফোঁটার উৎসবে? কোথা থেকে এল এই উৎসব? এই উৎসব কি শুধুমাত্র বাংলার? নাকি সমগ্র দেশবাসীর? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে, আমাদের চলে যেতে হবে মৎস্যপুরাণের কাহিনিতে, যেখানে যম এবং যমুনা দুই ভাইবোন।

bhaiphota

ছবি: সংগৃহীত।

পুরাণে যম আর যমুনার বাবা-মা ছিলেন সূর্য এবং সংজ্ঞা। অন্যমতে দেখা যায় সূর্যের সংজ্ঞা, প্রভা ও রজনী নামে তিন জন পত্নি ছিলেন। বিভিন্ন পুরাণের কাহিনিতে আমরা নানা রকম গল্প পেলেও সব মতামতেই যমের বোনের নাম ছিল যমুনা, যার সঙ্গে কৃষ্ণের দাদা বলরামের বিবাহ হয়েছিল। পুরাণ মতে যম আর যমুনার জন্মের পর সূর্যদেবের উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে, তাঁর পত্নি সংজ্ঞা মর্তে চলে যান। যাওয়ার সময়ে তিনি সূর্যের আর এক পত্নি ছায়ার কাছে যম আর যমুনাকে রেখে যান। কিন্তু ছায়া যম আর যমুনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে থাকেন। দুই ভাইবোন সব কথা সূর্যকে জানালেও তিনি অন্ধ মোহে আচ্ছন্ন হয়ে তাঁর পত্নির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেন না। দুই ভাইবোনের মধ্যে খুবই সুসম্পর্ক ছিল। তারা দু’জন দু’জনকেই খুব ভালবাসত। এক দিন, বিমাতা ছায়ার ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে যম যমপুরী তৈরি করে সেখানে চলে যান, আর কৃষ্ণের দাদা বলরামের সঙ্গে যমুনার বিয়ে হয়ে যায়। এ ভাবেই দিন এগোচ্ছিল, কিন্তু বোনকে না দেখতে পেয়ে যম ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তিনি যমুনাকে এক বার দেখতে চান। এই খবর পেয়ে যমুনা তাঁর দাদাকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। এমনই এক শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় যমুনার আমন্ত্রণে যম তাঁর বোনের বাড়িতে যান। যমুনা আদরযত্ন করে তাঁকে খাওয়ান। সন্তুষ্ট হয়ে যম, যমুনাকে বর চাইতে বলেন। যমুনা তখন ওই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার বর চান। যম, যমুনাকে বলেন, শুক্লপক্ষের এই দ্বিতীয়ার দিনটি ভাইফোঁটা নামে উদ্‌যাপিত হবে। সব বোনেরা তাদের ভাইদের মঙ্গলকামনায় ভাইফোঁটা দেবে। বিশ্বাস করা হয়, ওই দিন থেকেই ভাইফোঁটা প্রথার সূচনা হয়েছিল। পুরাণ ঘাঁটলে এমন অনেক কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু মৎস্য পুরাণের এই কাহিনিই জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচারিত। পুরাণের এই গল্প ছাড়াও ভাইফোঁটা নিয়ে বিভিন্ন পুরাণে আরও অনেক কাহিনির উল্লেখ আছে কিন্তু সব জায়গাতেই যম আর যমুনার, ভাই বোনের সম্পর্ককেই ভাইফোঁটার উৎস ধরা হয়, তাই ফোঁটা দেওয়ার সময় বোনেরা যম আর যমুনার কথা স্মরণ করে ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় তার কপালে ফোঁটা দেন।

অন্য আর একটি গল্পে দেখা যায়, কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের এই দ্বিতীয়া তিথিতেই শ্রীকৃষ্ণ ভয়ঙ্কর নরকাসুরকে বধ করে বাড়ি ফেরেন। বাড়ির দরজায় তাঁর বোন সুভদ্রা তাঁকে জয়টিকা পরিয়ে দিয়ে আদর আপ্যায়ন করেন। মনে করা হয়, এই ঘটনা থেকেও ভাইফোঁটা উৎসবের সূচনা হয়েছিল।

এ তো গেল পুরাণের গল্প কথা। ভাইফোঁটা উৎসবের জন্ম নিয়ে ইতিহাস কী বলে, সেটা খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যাওয়া গেল খ্রীষ্টপূর্ব ৫২৭ অব্দে। এই সময়েই জৈন ধর্মগুরু মহাবীরের প্রয়াণ ঘটেছিল। চতুর্দশ শতাব্দীতে এক পণ্ডিত, সর্বানন্দসুরীর লেখা তালপাতার পুঁথি ‘দীপোৎসবকল্প’ নামের এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ থেকে ভাইফোঁটা উৎসবের জন্ম নিয়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। ‘দীপোৎসবকল্পে’ সর্বানন্দসুরী লিখেছেন, মহাবীরের মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যেরা খুবই ভেঙে পড়েন। তাঁরা খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেন। দীর্ঘ অনশনে তাঁদের শরীর দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে। মহাবীরের খুব কাছের শিষ্য ছিলেন নন্দীবর্ধন। মহাবীরের পর জৈন ধর্মালম্বীদের কাছে নন্দীবর্ধণের খুবই জনপ্রিয়তা ছিল। অন্যান্য শিষ্যেরা এবং সাধারণ জৈনরা আশঙ্কা করলেন, এমন চলতে থাকলে জৈন ধর্মের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারে। মহাবীরের পর জৈন ধর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দক্ষতা এবং শিক্ষা নন্দীবর্ধনের মধ্যে ছিল। সবাই তাঁকে গুরু হিসাবে মান্যও করত। অনশন করে নন্দিবর্ধন যদি এ ভাবে নিজেকে শেষ করে দেন তা হলে জৈন ধর্ম সঙ্কটে পড়তে পারে। এমন অবস্থায় নন্দীবর্ধনের বোন অনুসূয়া এগিয়ে এলেন। তিনি তাঁর ভাইকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে অনশন ভাঙালেন, তার পর তাঁর মাথায় চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে তাঁকে জৈন ধর্মের প্রচার, প্রসার এবং সাংগঠনিক দায়িত্ব নিতে বললেন। পণ্ডিত সর্বানন্দসুরীর মতে সেই দিনটিও ছিল কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকেই বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্ববিদ ভাইফোঁটা উৎসবের উৎস হিসাবে মনে করে থাকেন।

bhaiphota

ছবি: সংগৃহীত।

পূরাণ ইতিহাস ছাড়াও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ভাই-বোনের এই আত্মিক সম্পর্ক নিয়ে অনেক কাহিনি আছে। শোনা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তাঁদের কাজকর্মের মধ্যে ভাইফোঁটার ভাবনাকে ভীষণ গুরুত্ব দিতেন। শুধুমাত্র এই বঙ্গে নয়, সারা দেশেই ভাইফোঁটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এক উৎসব। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন নামে, যেমন উত্তর পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারতের কিছু রাজ্যে ভাইফোঁটা উৎসবকে ‘ভাইদুজ’ ও ‘ভাইবিজ’ বলা হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অংশে এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের কিছু জেলায় ভাইফোঁটা উৎসব ‘ভাইবিছিয়া’ নামেও পরিচিত।

যেখানে যা-ই বলে ডাকা হোক বা যে ভাবেই এই উৎসব পালন করা হোক, ভাইফোঁটা এই উপমহাদেশের এক প্রাচীন ঐতিহ্য, যে ঐতিহ্য এক সুন্দর পবিত্র সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা দেয়, তাই অজস্র উৎসবের ভিড়ে ‘ভাইফোঁটা’ তার নিজের আলোতেই আলোকিত হয়ে আছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Bhaifota Bhaidooj Bhaiphota 2024
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy