Advertisement
E-Paper

এত দিনে হাঁটতেও ভুলে গিয়েছেন সুনীতারা! কী ভাবে আগের অবস্থায় ফিরবেন? লিখলেন বিজ্ঞানী

হাড়ের ক্ষয় হয়েছে। রক্তের ঘনত্ব কমেছে। হাঁটতেও ভুলে গিয়েছেন সুনীতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোর। পৃথিবীতে ফিরে কোন কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তাঁদের? লিখলেন এ দেশের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী।

What physical and mental changes will Sunita Williams and Butch Wilmore face after returning Earth

পৃথিবীতে ফিরে কোন কোন শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে সুনীতা ও বুচকে, জানালেন বিজ্ঞানী। ফাইল চিত্র।

সন্দীপ চক্রবর্তী

সন্দীপ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৫ ১৮:০৫
Share
Save

আমাদের শরীরে মস্তিষ্কের কোষগুলি বাদ দিয়ে, সারা শরীরের কোষেরই রূপান্তর হয়। মৃত কোষ সরে গিয়ে নতুন কোষের জন্ম হয়। হাড়ের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই হয়। প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ দিন অন্তর হাড়ের গায়ে ক্যালশিয়ামের প্রলেপ পড়ে তার বৃদ্ধি ও ঘনত্ব বাড়ে। এই প্রক্রিয়া নিরন্তর চলতে থাকে মানুষের শরীরে। আর এর নেপথ্যে রয়েছে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যা মানুষের ওজনকে ধরে রেখেছে। কিন্তু যিনি মহাকাশে গিয়েছেন বা সেখানে থাকছেন, তাঁর শরীরে মাধ্যাকর্ষণ কাজ করছে না। ফলে নতুন করে হাড়ের গঠন ও বৃদ্ধিও হচ্ছে না। উপরন্তু হাড়ের ক্ষয় হচ্ছে। পৃথিবীতে ফেরার পরে হাড়ের ক্ষয়জনিত এই সমস্যাতেই ভুগতে হবে নভশ্চর সুনীতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোরকে।

শিশু যখন ধীরে ধীরে বড় হয়, তখন তার গোটা শরীরের গঠন ও আকৃতি বদলায়। জন্মানোর সময়ে খুলির যে আকার ছিল, পরবর্তী কালে তা তো আর থাকবে না। কারণ, বৃদ্ধিটা কেবল পেশির নয়, হাড়েরও। শরীরের কোষ, কলা ও হাড় সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে বাড়তে থাকবে। তবেই শরীরের একটা গঠন তৈরি হবে। পায়ের পেশি শক্তপোক্ত হবে, হাড়ের বৃদ্ধি হবে এবং শিশু হাঁটতে শিখবে। শরীরের ওজনকে ধরে রেখে হাঁটাচলা করার জন্য হাড় ও পেশির যে গঠন তৈরি হয়, তা কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের অনুপাতেই হয়। মাধ্যাকর্ষণের যে প্রভাব আমাদের উপর কাজ করে, তাকে প্রতিহত করে পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে হাড় কতটা মজবুত হতে হবে, পেশির বৃদ্ধি কতটা হবে, তা শরীরই ঠিক করে নেয়। কিন্তু যে মুহূর্তে এই মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব কেটে যাবে, সেই মুহূর্ত থেকেই হাড় ও পেশির বৃদ্ধির অনুপাতটা বদলে যাবে। সুনীতাদের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটাই হয়েছে।

সুনীতা উইলিয়াম।

সুনীতা উইলিয়াম। ফাইল চিত্র।

অনেক মহাকাশচারীকেই দেখেছি, যাঁরা আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে ৭-৮ দিন কাটিয়ে এসেও দিব্যি পৃথিবীর মাটিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কারও সাহায্য ছাড়াই হাঁটাচলা করেছেন। কারণ, ৭-৮ দিন শূন্য মাধ্যাকর্ষণে (মাইক্রোগ্র্যাভিটি) থাকলে শরীরের উপর তেমন প্রভাব পড়ে না। ৩০-৩২ দিন পেরিয়ে গেলেই সমস্যাটা শুরু হয়। সুনীতারা সেখানে প্রায় ৯ মাস শূন্য মাধ্যাকর্ষণে ভেসে থেকেছেন। এতে তাঁদের শরীরের ভারসাম্য যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনই হাড়ের ক্ষয় দ্রুত গতিতে হয়েছে।

সে দিক থেকে দেখতে গেলে, শরীরে আর নতুন করে হাড়ই তৈরি হয়নি সুনীতাদের। পেশির বৃদ্ধির জন্য যেটুকু দরকার সেটুকুই হয়েছে। ওজন ধরে রাখার মতো হাড়ের শক্তি আর নেই। তাই পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করামাত্র যদি তাঁরা দাঁড়াতে যান, তা হলে তৎক্ষণাৎ পড়ে যাবেন। হাঁটাচলা করার প্রশ্নই নেই। কারণ, স্পেস স্টেশনে সর্ব ক্ষণ ভেসে থেকে হাঁটতে ভুলেই গিয়েছেন তাঁরা। আপাতত কয়েক মাস হুইলচেয়ারেই বন্দি থাকতে হবে। কেবল দাঁড়ানো নয়, বসে থাকা বা শুয়ে থাকার সময়েও আলাদা করে কোনও অনুভূতি জাগবে না। সেখানে জলে বসে থাকাও যা, লোহার চেয়ারে বা কাঠের চেয়ারে বসে থাকাও তাই। একই ভাবে শুয়েও সুখ আসবে না। কারণ, নরম বিছানায় শুচ্ছেন না কি শক্ত মাটিতে শুচ্ছেন, তার অনুভূতিটাই থাকবে না।

মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব কী ভাবে আমাদের উপর কাজ করে, তার আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। দেখবেন, নভশ্চরদের যখন মহাকাশে পাঠানো হয়, তখন শুয়ে পাঠানো হয়। দেখলে মনে হয়, মহাকাশযানে তাঁরা বসে রয়েছেন, কিন্তু আসলে শুয়ে থাকেন। কারণ, মহাকাশযান যখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের মায়া কাটিয়ে মহাশূন্যে চলে যায়, তখন যানটির গতি বহু গুণে বাড়িয়ে দিতে হয়। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণকে ভেদ করে যাওয়ার জন্য মহাকাশযানের যে গতি থাকে, তাতে যদি কেউ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকেন, তা হলে তার হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে। মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব চলে গেলে যেমন হাড় তৈরিই হবে না, তেমনই এর চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ হলে হাড় গুঁড়িয়ে যাবে। ঠিক যেমনটা হয় বৃহস্পতি গ্রহে। পৃথিবীর চেয়ে বৃহস্পতির মাধ্যাকর্ষণের টান বহু গুণে বেশি। সেখানে এক কিলোগ্রাম ওজন তুলেই নাস্তানাবুদ হতে হবে। তাই বৃহস্পতিতে যদি প্রাণ থাকত, তা হলে বিশাল বড় বড় দানবীয় প্রাণীর জন্ম হত। এতই বড় যে তাদের সারা শরীরে রক্ত পৌঁছে দিতে পাঁচ থেকে সাতটি হার্ট থাকতে হত।

সুনীতা উইলিয়াম ও বুচ উইলমোর।

সুনীতা উইলিয়াম ও বুচ উইলমোর। ছবি সূত্র: নাসা।

সে যাই হোক, সুনীতাদের আবার আগের মতো শরীর-স্বাস্থ্য ফিরে পেতে হলে মাসখানেক অপেক্ষা করতেই হবে। তার মধ্যে বার বারই চেস্ট এক্স-রে করা হবে। প্রথম প্রথম শুতে হবে ৫ ডিগ্রি ঢালু সোফাতে। যাতে শরীরের ওজন মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে সইয়ে নিতে পারে। কারণ, মাটির সঙ্গে সমান্তরালে রাখা বিছানায় শুলে তার শরীরের ওজন অনুভবই করতে পারবেন না। বিছানায় শুয়েছেন না মাটিতে, বুঝতেই পারবেন না। তার পর ধীরে ধীরে ১০ ডিগ্রি, ১৫ ডিগ্রি, ৩০ ডিগ্রি ঢালু সোফাতে শোয়ানো হবে তাঁদের। যত দিন না চিকিৎসকেরা বুঝবেন যে, নতুন করে হাড়ের গঠন তৈরি হচ্ছে, তত দিন তাঁদের নিজে থেকে হাঁটাচলা করা, ওঠাবসা করতে দেওয়াই হবে না।

মহাকর্ষীয় তরঙ্গের বিকিরণও যে ক্ষতি করবে না তা নয়। মহাকাশ স্টেশনের দেওয়াল তেজস্ক্রিয় বিকিরণকে ঠেকাতে পারে না। এই সব মহাজাগতিক রশ্মি স্পেস স্টেশনের দেওয়াল ভেদ করে ঢোকে, পরিবর্তি হয় এবং নভশ্চরদের শরীরে প্রভাব ফেলে। তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রভাব পরবর্তী সময়ে গিয়ে ক্যানসারের কারণ হতে পারে। শরীরের সুস্থ কোষগুলির অনিয়মিত বিভাজন শুরু হতে পারে। তাই সুনীতারা পৃথিবীতে ফেরার পরে, চিকিৎসকদের অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে তেমন কোনও আশঙ্কা আছে কি না।

সুনীতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোরের আরও কিছু সমস্যা হতে পারে। যেমন, প্রোটিনের ঘাটতি হবে শরীরে। স্পেস স্টেশনে যদিও সুনীতাদের খাওয়াদাওয়ায় নজর রাখা হত। তবে, যে হেতু এত দিন ধরে প্যাকেটজাত খাবার খাচ্ছেন তাঁরা, তাই প্রোটিন ও খনিজের অনুপাতটা আর ঠিকমতো নেই। টাটকা সব্জিও তেমন ভাবে পাননি স্পেস স্টেশনে। হয়তো লেটুস বা টম্যাটো ফলিয়ে খেয়েছেন তাঁরা। কিন্তু তাতে পুষ্টির চাহিদা মিটবে না। তার উপর প্রতি দিন ঘণ্টা দুয়েক করে হলেও শরীরচর্চা করেছেন। সে ক্ষেত্রেও প্রোটিনের ঘাটতি হয়েছে। তাই পৃথিবীতে ফিরে টাটকা সব্জি, ফল ও প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে।

রক্তের ঘনত্বও কমে মহাকাশে থাকলে। প্লাজ়মা বা রক্তরসের তারতম্য হতে পারে। তবে তা মাস দেড়েকের মধ্যে ঠিকও হয়ে যাবে। তবে বুচের চেয়ে সুনীতা অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়বেন। মেয়েদের একটা বয়সের পরে পেশির শক্তি কমে, ক্যালশিয়ামের ঘাটতি বেশি হয়। সুনীতা যে হেতু মহাকাশে এত মাস ছিলেন, তাই তাঁর শরীরে এই সমস্যাগুলি বেশি হবে। তবে সঠিক চিকিৎসা ও ডায়েটে এই ঘাটতিও পুষিয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি।

(লেখক জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী, ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজ়িক্স-এর অধিকর্তা)

NASA Sunita Williams

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}