Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Sleep Paralysis

নিদ্রারূপেণ

ঘুমের মধ্যেই অনেক সময়ে হাত-পা একেবারে স্থির হয়ে আসে, নড়ানোর ক্ষমতা নেই মনে হয় যেন! এই স্লিপ প্যারালিসিস আসলে কী? এর সমাধান কী?প্রচলিত লব্জে আবহমান কাল ধরেই আছে ‘বোবায় ধরা’র মতো শব্দ। ভূতের গল্পের সুবাদে ভূতে ধরা বা ‘নিশিতে পাওয়া’-র মতো শব্দবন্ধ আমাদের চেনা।

শিশির রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০২:৪৮
Share: Save:

কিছু কিছু অসুখের নাম শুনলে মনে হয়, এ বুঝি নিতান্ত আজকের যুগের। কিন্তু লোকায়ত জনজীবনেও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে তাদের। হয়তো তারা আছে রূপকথায় বা ঠাকুমা-দিদিমার ছড়ায়, গানে-গল্পে। ‘স্লিপ প্যারালিসিস’ শুনলে আধুনিক বা জটিল কিছু মনে হয়। কিন্তু প্রচলিত লব্জে আবহমান কাল ধরেই আছে ‘বোবায় ধরা’র মতো শব্দ। ভূতের গল্পের সুবাদে ভূতে ধরা বা ‘নিশিতে পাওয়া’-র মতো শব্দবন্ধ আমাদের চেনা। ‘বোবায় ধরা’ হয়তো ততটা নয়। কিন্তু, নাম থেকেই পরিষ্কার, কাউকে ‘বোবায় ধরা’ মানে এমন একটা শারীরিক অবস্থার ইঙ্গিত করা হচ্ছে, যখন আক্রান্ত মানুষটি কোনও শব্দ করতে পারছেন না। বাড়ির বয়স্কদের জিজ্ঞেস করলে বা নিজেই একটু তলিয়ে দেখলে জানা যাবে আনুষঙ্গিক আরও কিছু লক্ষণ। শুধু মুখের আওয়াজই নয়, যে কোনও রকম নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, কয়েক মুহূর্তের জন্য চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়া, এমনকি দৃষ্টিবিভ্রমও ঘটে। ‘বোবায় ধরলে’ নাকি এমনটাই হয়।

স্লিপ প্যারালিসিস কী?

উপরে যেমন বলা হল, তার অংশত বা অনেকটাই এ রকম অর্থাৎ ‘স্লিপ প্যারালিসিস’। নামই বলে দিচ্ছে, এই ক্লিনিক্যাল অবস্থাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঘুম। ঘুম চলে এসেছে এমন সময়ে (প্রিডরমাইটাল) বা ঘুম থেকে জেগে ওঠার মুহূর্তে (পোস্টডরমাইটাল) কিছুক্ষণের জন্য যদি মনে হয় হাত-পা বা শরীরের কোনও অংশই নড়াচড়া করা যাচ্ছে না একেবারে, মুখ দিয়ে শব্দ পর্যন্ত বেরোচ্ছে না, বুকের উপরে যেন মস্ত ভারী কিছু চেপে বসে আছে, তা হলে সেটা স্লিপ প্যারালিসিস হতে পারে। শরীরের সক্রিয়তা সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাই এ ক্ষেত্রে ‘প্যারালিসিস’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। পুরোটাই কিন্তু ঘটে অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু ওইটুকু সময়ের আতঙ্কের জেরে অনেকের হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টিবিভ্রমও ঘটতে পারে।

স্লিপ অ্যাপনিয়ার সঙ্গে এর পার্থক্য?

স্লিপ অ্যাপনিয়া একটা গুরুতর অসুস্থতা। সেখানেও দমবন্ধ ভাবের ব্যাপার থাকে, কিন্তু তার প্যাথোলজিক্যাল কারণ অন্য। এটি সাধারণত উচ্চ বিএমআই-যুক্ত মানুষদের মধ্যে দেখা যায়। শ্বাস নেওয়া-ছাড়ার অসুবিধে, নাক ডাকা, ফুসফুসের উপরে চাপ বৃদ্ধি, পালস রেট বেড়ে যাওয়া, ফুসফুসকে সাহায্য করতে হৃৎপিণ্ডের অতিসক্রিয়তা... এগুলো হয় স্লিপ অ্যাপনিয়ায়। হার্টের গুরুতর সমস্যাও হতে পারে এতে। স্লিপ অ্যাপনিয়ার যথাযথ ও সত্বর চিকিৎসা প্রয়োজন, স্লিপ প্যারালিসিস কিন্তু অন্য জিনিস।

স্লিপ প্যারালিসিস কেন হয়?

জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বলছেন, ‘‘ঘুমের মধ্যে আমরা যে রিল্যাক্সড থাকি, তা প্রকৃতি ভালর জন্যই করেছে। এই প্রকৃতির অঙ্কের হিসেবে সামান্য ভুলই স্লিপ প্যারালিসিসের কারণ। এটা কোনও রোগ নয়। বড়জোর এক ধরনের সমস্যা বলা যেতে পারে। যে সমস্যার শিকড় লুকিয়ে আছে ঘুমের অভ্যেসে। আমাদের সহজ স্বাভাবিক ঘুমের অভ্যেস নিয়মিত ভাবে বিঘ্নিত হলে স্লিপ প্যারালিসিস হতে পারে। শরীর পর্যাপ্ত বা যথেষ্ট ঘুম না পেলে, বা ঘুমের নির্দিষ্ট বা স্বাভাবিক চক্রটা অনিয়মিত বা নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে এই সমস্যা হতে পারে। মানসিক চাপ, স্ট্রেসও এর একটা বড় কারণ। ঘুমের স্বাভাবিক চক্র ঘেঁটে গেল, সঙ্গে যোগ হল স্ট্রেস অথবা স্ট্রেসের কারণেই ঘুম অনিয়মিত বা বিঘ্নিত হওয়া শুরু হল— এই দু’রকম অবস্থাই স্লিপ প্যারালিসিসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।’’

এটা কাদের হয়? বিশেষ কোনও বয়সের মানুষ কি এতে ভোগেন?

দেখা গিয়েছে, স্লিপ প্যারালিসিসের শিকার মানুষজনের অধিকাংশই অল্পবয়সি, টিনএজ (তেরো থেকে উনিশ) কিশোর-কিশোরী বা তরুণেরা, খুব বেশি হলে তিরিশ বছরের মধ্যে। তার বেশি বয়সের, মধ্যবয়সি বা বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে তেমন দেখা যায় না। তা দেখা দিলে ব্রেনের যথাযথ ইভ্যালুয়েশন বা স্লিপ অ্যাপনিয়ার মাত্রা নির্ধারণ প্রয়োজন। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের জীবনে পড়াশোনা বা আনুষঙ্গিক ক্ষেত্রের খুব চাপ থাকে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পারিবারিক পরিবেশও অনেক সময়ে স্ট্রেসের কারণ হয়। ডা. সুবীর কুমার মণ্ডলের কথায়, ‘‘আর একটা বড় কারণ— কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-যুবারা স্মার্টফোন বা কম্পিউটার ছাড়তে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারা ঘুমোতে যাচ্ছে খুব দেরি করে ‘অস্বাভাবিক’ সময়ে, এবং বিছানায়ও স্মার্টফোন নিয়ে কাটাচ্ছে অনেকটা সময়। এই সমস্ত কিছুই ঘুমের নিয়মিত ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে, যার পরিণতিতে স্লিপ প্যারালিসিস হতে পারে। এক জন বেশি বয়সের মানুষও দেরিতে বা স্মার্টফোন নিয়ে ঘুমোতে যান বা যেতে পারেন, তবে সাধারণত তাঁরা একটা নির্দিষ্ট সময় বা সীমার বাইরে ব্যাপারটাকে যেতে দেন না। অল্পবয়সিরা তা করে না বলেই তাদের স্লিপ প্যারালিসিসে ভোগার সম্ভাবনা বেশি।’’

এর চিকিৎসা কী?

স্লিপ প্যারালিসিস কোনও রোগ নয়, আগেই বলা হয়েছে। তাই এর ‘চিকিৎসা’ নয়, ‘সমাধান’ নিয়ে কথা বলাটাই যুক্তিযুক্ত হবে। এমন নয় যে কোনও ওষুধ বা থেরাপিতে স্লিপ প্যারালিসিস সেরে যাবে। স্লিপ প্যারালিসিসের সমাধানে সময়মতো ও যথেষ্ট ঘুমোতে হবে। রাত জেগে কাজ, বিশেষত কম্পিউটারে টানা বসে থেকে কাজ বন্ধ করতে হবে। বিশেষ কোনও ওষুধের প্রয়োজন থাকে না। দীর্ঘ দিন ঠিক সময়ে বা যথেষ্ট ঘুমের অভ্যেস নেই, তাই গোড়াতেই ‘এক্ষুনি ঘুমোব’ বললেই ঘুম না-ও আসতে পারে। ডা. মণ্ডল বললেন, ‘‘ঘুমোনোর প্রস্তুতি হিসেবে ঘরে হালকা, সুন্দর গান বা মিউজ়িক চালানো যেতে পারে। তাতে শরীর-মন শান্ত হবে, স্বস্তি পাবে। বালিশ বা পাশবালিশ জড়িয়ে এক পাশ ফিরে শোয়া সব সময়েই ভাল— স্লিপ অ্যাপনিয়া ও স্লিপ প্যারালিসিস দুটোর জন্যই। এগুলো নতুন বা অজানা কিছু নয়, অনেকেই করে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সহজ ‘হোম রেমিডি’-তেই কাজ হয়। তবে স্লিপ প্যারালিসিসের সমস্যা বেশি, ঘন ঘন বা তীব্র হলে অনেক সময়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক মেলাটোনিন হরমোন সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে থাকেন। এই হরমোন ঘুমের প্যাটার্ন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।’’

ঘুম আর স্ট্রেস সামলানো দরকার স্লিপ প্যারালিসিসের ক্ষেত্রে। স্ট্রেস নানা কারণে হতে পারে। অসুখ লুকিয়ে থাকতে পারে মনেও, তার চিকিৎসা করা তো অবশ্যই দরকার। অনেকে ‘ইনসমনিয়া’-র জন্যও চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। আসলে ‘স্লিপ প্যারালিসিস’-এ ‘স্লিপ’ শব্দটা আছে বলেই ঘুম সংক্রান্ত নানা সমস্যার কথা এর গায়ে গায়ে চলে আসে। সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর প্রয়োজনমতো নিয়ন্ত্রণ বা সমাধানে নজর দিতে হবে। তাতেই মিলবে স্লিপ প্যারালিসিস থেকে নির্ভার মুক্তি।

অন্য বিষয়গুলি:

Sleep Paralysis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy