নিছক মাথাব্যথা নয়। মাইগ্রেনের তীব্রতা অনেক ক্ষেত্রে এতই বেশি হতে পারে যে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর প্রয়োজন পড়ে যায়। মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণায় রোগী জ্ঞানও হারাতে পারেন। তাই মাথাব্যথাকে উপেক্ষা না করে, যখন-তখন নিজের মতো ওষুধ না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। আর তাই এই রোগের ধরন সম্পর্কে বিশদ জানা প্রয়োজন। মাইগ্রেনের ধাপ, কারণ এবং উপশম নিয়ে আনন্দবাজার ডট কমের সঙ্গে আলোচনা করলেন স্নায়ুরোগ চিকিৎসক সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায়।
মাইগ্রেন কী
চিকিৎসক বলছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত মাইগ্রেনের ব্যথার কোনও কারণ খুঁজে বার করা যায়নি। তবে কিছু গবেষণার উপর ভিত্তি করে এটুকু বোঝা গিয়েছে যে, এই রোগের নেপথ্যে বড় ভূমিকা রয়েছে জিনের। মা অথবা বাবা, কিংবা মা-বাবা দু’জনেরই এই রোগ ছিল। তাঁদের থেকেই সন্তানের মাইগ্রেন।’’
মাইগ্রেনের সময় শরীর থেকে কিছু রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়। আর তার ফলেই অত্যধিক ব্যথা হতে থাকে। ধমনী দিয়ে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। সেই কারণেই মাইগ্রেনের ব্যথায় মাথা দপদপ করতে থাকে। শরীরে রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া থেকেই মাইগ্রেনের সূত্রপাত।
কী কী কারণে রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট হয়
যাঁদের জিনগত কারণে মাইগ্রেন রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে জীবনযাপন এবং শারীরবৃত্তীয় কিছু বিষয়ের বড় অবদান রয়েছে, যা এই ব্যথাকে অসহনীয় করে তোলে।
হরমোনের তারতম্য: চিকিৎসক বলছেন, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি। আর তার কারণ, হরমোনের তারতম্য। সাধারণত, ৫ জন মহিলার মধ্যে ১ জনের এই রোগ থাকবেই। পুরুষদের ক্ষেত্রে ১০ জনের মধ্যে ১ জন, এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ১৫ জনের মধ্যে ১ জনের মাইগ্রেনের সমস্যা রয়েছে। প্রসঙ্গত, শিশুদের ক্ষেত্রে মাইগ্রেনের ব্যথা মাথায় হয় না, পেটে হয়।
ঘুমের সময়কাল: ঘুমের সময় যদি বার বার বদল হয়, অথবা পর্যাপ্ত ঘুম যদি না হয়, মাইগ্রেনের দাপট বেড়ে যেতে পারে।
আবহাওয়া: মেঘলা দিনে মাইগ্রেনের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়। আবহাওয়ার তারতম্য ঘটলে শরীরে জলের অভাব ঘটে। আর সেই সময়েও এই সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন:
অতিরিক্ত শরীরচর্চা: ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেকেই প্রয়োজনের থেকে বেশি শরীরচর্চা করেন। কারও আবার পেশার কারণে বিশ্রামের অভাব হয়। অতি সক্রিয়তাও মাইগ্রেনের জন্য খারাপ।
খাওয়ার সময়ের অভাব: কাজের চাপে অনেকেই নির্দিষ্ট কোনও মিল বাদ দিয়ে ফেলেন। জলখাবার বা দুপুরের খাবার, অথবা সন্ধে বা রাত, নিয়ম করে পরিমাণ মতো পেটের রসদ না জোগালে ক্ষতি হতে পারে।
এ ছাড়াও মানসিক চাপ, ক্যাফিন সেবন, ধূমপান, ইত্যাদি অনেক বিষয় মাইগ্রেনকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। কয়েকটি খাবার যেমন, পুরনো চিজ়, ডার্ক চকোলেট, রেড ওয়াইন, নুডলস (মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেট যুক্ত খাবার), কৃত্রিম সুইটনার, আচার, ইত্যাদির থেকেও দূরে থাকার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক।

মাইগ্রেনের ব্যথা হলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ না করে ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। ছবি: সংগৃহীত।
মাইগ্রেন ধাপ
মাইগ্রেনের মোট ৪টি ধাপ-
প্রোড্রোম: প্রথম পর্যায়টি মাথাব্যথা শুরুর ২৪ ঘণ্টা আগে থেকে শুরু হয়। মেজাজে বার বার বদল, ঘুম না আসা, ক্লান্তি, ঘন ঘন জল পিপাসা, বার বার প্রস্রাবের বেগ আসা ইত্যাদি এর লক্ষণ।
অরা: দ্বিতীয় পর্যায়কে মাইগ্রেনের ব্যথার একটি সতর্কতা চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়। পর্যায়টি ৬০ মিনিট বা ৫ মিনিটেরও কম সময় স্থায়ী হতে পারে। মাথাব্যথার ঠিক আগে পেশি দুর্বল হয়ে আসে, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যায়, কানে ‘চিঁ’ আওয়াজ শোনা যায়, শরীর অবশ হয়ে আসে, মনোযোগের অভাব দেখা দেয়, কথাবার্তায় জড়তা চলে আসে।
মাথাব্যথা: মাইগ্রেনের মাথাব্যথা ৪ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। মাথার এক পাশ থেকে শুরু হয়। তার পর অন্য পাশেও যেতে পারে। দপদপ করতে থাকে। আলো, শব্দ, কয়েক রকমের গন্ধ কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না রোগী। চিকিৎসকের পরামর্শ, ৭২ ঘণ্টার বেশি যদি ব্যথা, বমি ভাব, ইত্যাদির লক্ষণ থেকে যায়, তা হলে রোগীকে আর বাড়িতে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। সেই ক্ষেত্রে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
পোস্টড্রোম: ঝড় বয়ে যাওয়ার পরের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয় এই পর্যায়কে। সাধারণত ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। একে ‘মাইগ্রেন হ্যাংওভার’ও বলা হয়। শরীর অতি দুর্বল হয়ে যায়, ঘাড়ের কাছে ব্যথা হতে পারে, আলো-শব্দ নিয়ে অস্বস্তি তখনও থাকতে পারে। অনেক সময় বমি হয়ে যাওয়ার পর আরাম পান অনেকে।

মাইগ্রেনের ব্যথা থেকে মুক্তির উপায়। ছবি: সংগৃহীত।
মাইগ্রেনের ব্যথা থেকে মুক্তির উপায় কী
চিকিৎসক বলছেন, ‘‘মাইগ্রেনকে রোধ করা আর মাইগ্রেন হওয়ার পর সেটির তীব্রতা কমানো, দু’টি আলাদা। চিকিৎসকেরা রোগীর অবস্থা পরীক্ষা করে বিভিন্ন ওষুধ দেন। কিন্তু তা ছাড়াও ঘরোয়া কিছু উপায়ে এই রোগের উপশম সম্ভব।’’
জীবনযাত্রায় বদল এনে মাইগ্রেন থেকে দূরে থাকা সম্ভব। যে যে খাবার থেকে মাইগ্রেন বাড়তে পারে, সেগুলি এড়িয়ে চলা থেকে শুরু করে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমোনো, ফোন বা ল্যাপটপের সামনে খুব বেশি সময় না কাটানো, ভিটামিন-সমৃদ্ধ খাবার বা ওষুধ খাওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসের যোগ অভ্যাস করা, পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খাওয়া ইত্যাদি।
মাইগ্রেন হওয়ার পর একটি অন্ধকার, শান্ত ঘরে চুপচাপ বসে থাকার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক। ঠান্ডা অথবা গরম কাপড় দিয়ে ঘাড় ও কপালে সেঁক দিতে হবে। তা ছাড়া নিজেই নিজের মাথার তালু এবং কপালের দু’পাশে মালিশ করতে পারলে উপকার পাওয়া যেতে পারে। সঙ্গে শ্বাস সংক্রান্ত যোগ অভ্যাস করলে মাইগ্রেনের তীব্রতা অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
পরিশেষে চিকিৎসক সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘অনেকেই মাইগ্রেনের ব্যথা হলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ না করে প্যারাসিটামল খেয়ে নেন যখন-তখন। এই অভ্যাস খুবই ক্ষতিকারক। কারণ, মাইগ্রেন ভেবে আরও বড় কোনও রোগকে উপেক্ষা করে ফেলেন অনেকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ভাবে ব্যথা কমে গেলে রোগ শনাক্তকরণে দেরি হয়ে যায়। তাই মাইগ্রেন ধরা পড়ুক আর না পড়ুক, নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে।’’