প্রতীকী ছবি।
বাঙালি পেটের জন্য সুনাম ও দুর্নাম দুই-ই কুড়িয়েছে। তেল রগরগে কালিয়া, মুচমুচে ভাজাভুজির সুস্বাদে সে দুনিয়াকে মাত করেছে। নিজেও খেয়েছে কব্জি ডুবিয়ে, ডায়েট উড়িয়ে। এক দিকে যখন বাঙালি রসনার খ্যাতি দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনই গোটা বাঙালি জাতি ঘায়েল হয়েছে পেটের নানা গোলযোগে। পেট ফাঁপা, গ্যাস অম্বল, অজীর্ণ, চোঁয়াঢেকুর তার যেন নিত্যসঙ্গী। একটু কচুরি বা মাটন রোল খেয়ে জিভে তার রেশটুকুও রাখা যায় না, তখনই মুখশুদ্ধিতে খেতে হয় অ্যান্টাসিড। ফলে একটু বয়স বাড়লেই পেটে সইবে না মনে করে কত সুখাদ্য পাত থেকে বাদ হয়ে যায়। যদিও চিকিৎসকদের মতে, পেটের ভিতরের কলকব্জা সংক্রান্ত সব রোগের জন্যই কিন্তু তেলমশলাদার খাবার দায়ী নয়। যেমন কোলাইটিস বা বৃহদন্ত্রের প্রদাহ। এই রোগে বড়ই কষ্ট। পেট ব্যথা করে, ঘন ঘন টয়লেট যেতে-যেতেই জীবন জেরবার হয়ে যায়। তবে এই রোগ সহজেই সারানো যায়। কোলাইটিসের রোগলক্ষণ, রোগনির্ণয় ও তার চিকিৎসা পদ্ধতি বুঝিয়ে বললেন গ্যাসট্রোএনট্রোলজিস্টডা. অভিজিৎ চৌধুরী।
কেন হয় কোলাইটিস
কোলন বা বৃহদন্ত্রের ভিতরে কোনও সমস্যা হলে, যেমন জ্বালা করলে, ফুলে গেলে বা কোনও ঘা হলে কোলাইটিস দেখা দেয়। এই রোগের বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। ডা. চৌধুরী জানালেন, মূলত কিছু জলঘটিত সংক্রমণের কারণে কোলাইটিস হয়। মূত্র সংক্রমণের জন্য দায়ী ইসকেরেশিয়া কোলাই ব্যাকটিরিয়ার জন্যও কোলাইটিস হয়। ক্যাম্পাইলোব্যাকটার প্রভৃতি আরও কিছু ব্যাকটিরিয়াও কোলাইটিসের জন্য দায়ী। যাঁরা বহু দিন ধরে স্টেরয়েড খাচ্ছেন বা কোনও কারণে ‘ইমিউনোকম্প্রোমাইজ়ড’ অবস্থায় রয়েছেন, তাঁদেরও অনেক সময় ভাইরাল ইনফেকশনের কারণে কোলাইটিসে ভুগতে হয়। আমাদের দেশে অ্যামিবা অর্থাৎ যে পরজীবীটি আমাশয় ঘটায়, তার জন্যও অনেক সময় কোলাইটিস হতে পারে। হঠাৎ জ্বর, পেট খারাপ, পেট মোচড়ের সঙ্গে এই ধরনের কোলাইটিস হতে পারে।
অনেক রকমের কোলাইটিস (কোলনে আলসার) আছে, যেগুলি কেন হয় তা এখনও অজানা। সেগুলিকে বলা হয় ইডিয়োপ্যাথিক আলসারেটিভ কোলাইটিস।
অনেক সময়েই বহু দিন ধরে পেট খারাপ ও বর্জ্যের সঙ্গে রক্ত পড়ার সমস্যা থাকলে দেখা যায় ক্রোন’স ডিজ়িজ় হয়েছে। এটিও এক ধরনের কোলাইটিস।
টিউবারকুলোসিসের জন্যও কোলাইটিস হয়। এ ক্ষেত্রে টিবি কোলনে বাসা বাধে। অন্য সংক্রমণগুলি হঠাৎ করে আসে, আবার হঠাৎই চলে যায়। কিন্তু যে সব ক্ষেত্রে বহু দিন ধরে পেটের সমস্যা, রক্ত পড়ার মতো কষ্টে রোগী ভুগছেন, সেগুলি সাধারণত ইডিয়োপ্যাথিক আলসারেটিভ কোলাইটিস, ক্রন’স ডিজ়িজ় ও টিউবারকুলোসিস।
প্রসঙ্গত, পেটের রোগের ক্ষেত্রে ওষুধের অপব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করে দিলেন ডা. চৌধুরী। তাঁর মতে, পেটের রোগ মানেই অ্যামিবার আক্রমণে আমাশয় নয়। তাই কোলাইটিস হলেই নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ খাওয়ার বদভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। দু’-এক বার পেট কামড়ালে টপাটপ ওষুধ খাওয়া একেবারেই ঠিক নয়।
উপসর্গ ও রোগনির্ণয়
রোগীর বারবার শৌচালয় ব্যবহারের ইচ্ছে হয়, বর্জ্য হয় নরম। পেট ব্যথা করে। কখনও কখনও শরীরের মলদ্বারের পথে জ্বালাযন্ত্রণার সমস্যাও হয়। যে কোনও বয়সেই কোলাইটিস দেখা দিতে পারে। তবে যদি রোগীর বয়স বেশি হয়, তবে চিকিৎসক বিশেষ করে খেয়াল করেন তাঁর ওজন কমে যাচ্ছে কি না, সে দিকে। ওজন কমছে দেখলে ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে। সাধারণত, ক্যানসারের রোগীর ক্ষেত্রে কোলাইটিসের উপসর্গগুলিও থাকে। কিন্তু সাধারণত কোলাইটিসে ওজন কমে না। ক্যানসারের ক্ষেত্রে ওজন কমে যায়।
কোলনোস্কোপি করে কোলাইটিস রোগটি নির্ণয় করা হয়। ক্যানসার থাকলেও কোলনোস্কোপিতে ধরা পড়ে। কোলনোস্কোপি একটি ‘আউট পেশেন্ট প্রসিডিয়োর’। এর মাধ্যমে রেক্টাম ও কোলনে কোনও সমস্যা আছে কি না দেখা হয়। এই প্রক্রিয়ায় রোগীর অস্বস্তি হতে পারে বটে, তবে তা সাময়িক।
চিকিৎসার রকমফের
ওষুধ খেলেই কোলাইটিস সেরে যাবে। ব্যাকটিরিয়াল ইনফেকশনগুলির জন্য হঠাৎ করে কোলাইটিস হলে ৭-১০ দিন অ্যান্টিব্যাকটিরিয়াল ওষুধ খেলেই রোগ ভাল হয়ে যাবে। ভাইরাল কারণে অসুখ হলে নিজে থেকেই সেরে যাবে। কিছু কিছু ভাইরাসের জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ আছে সেটি দু’-এক মাস খেলেই চলে। এগুলি অ্যাকিউট কোলাইটিস।
আলসারেটিভ কোলাইটিস, ক্রন’স ডিজ়িজ় বা টিউবারকুলোসিসের কারণে কোলাইটিস হলে দীর্ঘ দিন ভোগায়। এগুলি ক্রনিক অসুখ। তারও আলাদা ওষুধ আছে। শরীরের অন্য অংশের মতোই টিবি-র কারণে কোলাইটিস হলে বারো মাসই ওষুধ খেতে হয়। আলসারেটিভ কোলাইটিস বা ক্রন’স ডিজ়িজ় সাধারণত অটোইমিউন ডিজ়িজ়। এ ক্ষেত্রে শরীরের প্রতিরোধী ক্ষমতা শরীরকেই আক্রমণ করে। এ ক্ষেত্রে বহু বছর ধরে স্টেরয়েড অথবা ইমিউনোসাপ্রেস্যান্ট খেতে হয়। তাতেই মানুষ ভাল থাকেন। খুব কম রোগীর ক্ষেত্রে (হাজার জনে এক জন) অসুস্থতা খুব বেশি হলে তবেই অপারেশন দরকার পড়ে। আর
দশ হাজারে মাত্র এক জন
রোগীর কোলাইটিস থেকে ক্যানসার হতে পারে। অর্থাৎ এই সম্ভাবনাও নগণ্য।
কোলাইটিস রোগটিকে আগে থেকে আটকানো যায় না। খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ করলে রোগটি হবে না, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ডা. চৌধুরীর আশ্বাস, ‘‘কোলাইটিস হয়েছে বলে মন খারাপ করার কারণ নেই। খাওয়াদাওয়ার শখ শেষ হয়ে গেল এমন ভাবার তো কোনও কারণই নেই। শুধু শুধু চিন্তা করে জীবন সঙ্কুচিত করবেন না। তার ফলে রোগ বাড়ে বই কমে না। কোলাইটিস রোগের ক্ষেত্রে ওষুধ খেলেই যথেষ্ট সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy