অস্থিরতার জন্ম হয় বয়স ও কাজের পরিস্থিতি ভেদে বিভিন্ন কারণে। ছবি: অমিত দাস।
সকাল ছ’টায় ভোর হয় অহনা ও সুদীপ্তর। ছেলে আর মেয়েকে ঘুম থেকে তোলা, টিফিন বানানো, খাবার রেডি করে দেওয়া, বাচ্চাদের স্নান... ঘড়ির কাঁটার তালে ছুট ছুট। তার পর বাজারের সবজিওয়ালা, মাছের দোকানে দরদাম, ভুষিমালের দোকান থেকে জিনিস আনা, রান্নার লোক না এলে তারও ব্যবস্থা করা... সব সামলে যখন কর্মক্ষেত্রে পৌঁছনো গেল, তখন জুনিয়র যেই একটু বেশি হেসে ফেলেছে, সমস্ত বিরক্তি গিয়ে পড়ল ওর উপরে।
মেজাজ! অদ্ভুত এই আবেগ, যার চাবি নিজের হাতে থাকলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। বাড়িতে মা-বাবার, ছেলেমেয়ের, পরিচারিকার মেজাজ। রাস্তায় অটোওয়ালা, ট্যাক্সিওয়ালা, বাসের কনডাক্টর সক্কলে বিরক্ত, হর্নের চিৎকার। কর্মব্যস্ত জীবনে এই টেমপারামেন্টের বিরাট দাপট। কিন্তু আমাদেরই বা ধৈর্য কমছে কেন, যার কারণে ছোট-বড় সকলের মেজাজের বাড়বাড়ন্ত। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, চারপাশে যেন একটা ‘খেলা’ চলছে, সব কাজ দ্রুত সেরে ফেলার। টাইপ করছি মুহূর্তে, লাইট, ফ্যান চালানোও এখন মুখে বললে হয়ে যাচ্ছে... এমন গতিময় দিনযাপনে ধীরেসুস্থে কিছু করার অবকাশ নেই। তাই ইন্টারনেট একটু ধীরে চললে আমরা অস্থির, উবার পেতে দেরি হলে বিরক্ত। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বিরক্তি বা খিটখিটে মেজাজের মধ্য দিয়ে, যার পরবর্তী ধাপ রাগ নামক ‘রস’।
কেন এই বিরক্তি?
আসলে অস্থিরতার জন্ম হয় বয়স ও কাজের পরিস্থিতি ভেদে বিভিন্ন কারণে। ছোট ছেলে বা মেয়েটি হয়তো স্কুলে বুলিংয়ের শিকার, শিক্ষক বিরক্ত শিক্ষাঙ্গনে চলা রাজনীতি নিয়ে, গৃহবধূর দায়িত্বপালন সকাল থেকে রাত অবধি চলছে, চাকুরিরতা ঘরে-বাইরে সামলাচ্ছে, পুরুষটি বাজার, বাবা-মায়ের দায়িত্ব, ইএমআইয়ের চক্করে ছুটে চলেছে... এই অত্যধিক কর্মব্যস্ততা ও দ্রুততার কারণে ‘সময়ের কাজ সময়ে’ চিরাচরিত নীতিবাক্যটি হোঁচট খাচ্ছে। ধরুন, কেউ বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য ২০ মিনিট সময় বরাদ্দ রেখেছেন, কিন্তু যখনই খাওয়াতে গিয়ে সেই সময়টা পেরিয়ে যাচ্ছে, তাঁর কাজ জমছে, তিনি মেজাজ হারিয়ে ফেলছেন। বাচ্চা সেটা দেখে ধরে নিচ্ছে, তারও কিছু অপছন্দ হলে রুক্ষ ভাবে নাকচ করতে হবে।
কোনও বিষয়ে প্রত্যাশা পূরণ না হলে আমরা মেজাজ হারাই। তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তি আমাদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। নিজেরাই যেখানে চাহিদাকে সংবরণ করতে পারছি না, সেখানে ছোটদের প্রকৃত অর্থে সংবরণ করা শেখাবেন কী ভাবে? সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই চলছে ‘তুলনা’ নামক ইন্দ্রজালটির সঙ্গে। পরিস্থিতিকে হাতিয়ার করে সমাজও যে চাপ সৃষ্টি করছে।
শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এখন বহু বাড়িতে থাকে না, যার প্রধান কারণ দায়িত্বের পাহাড়প্রমাণ চাপ। আগে যৌথ পরিবারে দায়িত্ব ভাগ হয়ে যেত, কিন্তু এখন নিউক্লিয়ার পরিবারে সব সামলাতে হয় নিজেদের। ফলে পরস্পরকে এবং বাচ্চাটিকে দেওয়ার মতো সময়ের বড্ড অভাব। দিনের শেষে কর্মক্লান্ত থাকলেও নিজেকে একটু সময় দিতে গিয়ে চলছে বেশি রাত অবধি সিরিজ় দেখা। ভুলে যাচ্ছি যে, ঘুমের সঙ্গে মেজাজের সম্পর্ক ওতপ্রোত। বাবা-মায়ের ঘুমের সময় ঠিক না থাকার প্রভাব পড়ে বাচ্চাটির উপরেও।
মেজাজ আয়ত্তে আসবে?
মনে রাখতে হবে, কোনও মানুষই ইচ্ছাকৃত ভাবে রূঢ় আচরণ করে না। কারণ সেটা করে সে আনন্দ পায় না। যখন কেউ রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করছে, সেটা তার ভিতরে স্ট্রেসের বহিঃপ্রকাশ। কখনও বাইরের চাপকে শান্ত ভাবে সামলাতে গিয়ে দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা ঘিরে ধরছে নানা দিক থেকে, কখনও বা উল্টোটা। কিন্তু তার সমাধান রয়েছে নিজের মধ্যেই। জেনে নিতে হবে সেটাই।
মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম মনে করেন, আমাদের নতুন করে ‘বোর হওয়া’টা শিখতে হবে। বাচ্চারাও আজকাল মাঝেমধ্যেই বলে, ‘আমি বোর হচ্ছি।’ ‘‘চুপ করে বসে থাকা খুব ইতিবাচক প্রভাব ফেলে মনের উপরে। সারাক্ষণ আমাকে কিছু করতে হবে, এটা কে বলেছে! কী ভাবে কাজটা ভাল করে করা যায় সেটা নিয়ে ভাবা, আত্মমগ্ন থাকার ক্ষমতাটা আমরা হারিয়ে ফেলছি। তাই মি টাইম খুব দরকার। তাতে অন্যের প্রতি ব্যবহারটা ভাল হবে,’’ বললেন ডা. রাম। সেই সঙ্গে জরুরি সচেতন ভাবে অন্যের কথা শোনা। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া না দেওয়া থেকে বিরত থাকা অভ্যেস করতে হবে। সেটা সব সময়ে সম্ভব নয় ঠিকই, কিন্তু সচেতন থাকাটা জরুরি। কারণ দুর্ব্যবহার করে ফেললে তার দাগ থেকে যায় মনের মধ্যে। তবে কেউ ক্রমাগত খারাপ ব্যবহার করে যেতে থাকলে প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে, তবে প্রথমেই নয়।
অভিনেত্রী ও সাইকোলজিস্ট সন্দীপ্তা সেন এমন একটি পেশায় রয়েছেন, যেখানে অনিশ্চয়তা নিত্যসঙ্গী, কিন্তু তাঁরা পাবলিক ফিগার। তাই মাথা ঠান্ডা রাখাটা বাধ্যতামূলক। কী ভাবে নিজেকে সংযত রাখেন? ‘‘সব সময়ে নিজেকে প্রমাণ করার চাপ, সমান ভাবে এগিয়ে যাওয়ার চাপ, বিরাট অঙ্কের ইএমআই, প্রতিনিয়ত তুলনা... সেখান থেকেই আসছে অসহিষ্ণুতা। প্রত্যেকের মধ্যে ধৈর্যের খুব অভাব। অতিরিক্ত মেজাজ গরম হলে মেডিটেশন দরকার। বিরক্তিকে বাড়তে দিলে এক সময়ে তার বিস্ফোরণ হবেই। নিজের ক্ষেত্রে কেন আমি বিরক্ত হচ্ছি, সেটা বোঝা জরুরি। তবেই সমাধান সম্ভব,’’ উত্তর সন্দীপ্তার।
আসলে মেজাজ, সহিষ্ণুতার অভাব এগুলো এখন এতটাই ছোঁয়াচে যে, বয়সভেদে সকল মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে। তার একটা বড় কারণ অবশ্য পেশাগত, সেটা আপনার পেশা যা-ই হোক না কেন। উদাহরণস্বরূপ একটা ঘটনা বলি, পাড়ার এক মুদি দোকানের মালিককে বরাবর দেখেছি ভীষণ শান্ত। অথচ সকাল থেকে খদ্দেরের কচকচি, কারও জ্ঞান, কারও বিরক্তিপ্রকাশ চলতেই থাকে। তার পরেও তিনি হাসিমুখে থাকেন কী ভাবে? হেসে বলেছিলেন, ‘‘আমার কাজটাকে কাজ ভাবি না। এটা করতে আমার ভাল লাগে। আর যে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে, আমি তার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকি না এবং সে আমার ক্রেতা। তাই কিছুক্ষণ সহ্য করে নিই।’’ জীবনের সহজ সমাধান অবলীলায় বলে গেলেন তিনি।
বয়সে ছোট মেজাজে ভারী
বড়দের সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলা, খিটখিটে মেজাজ সঙ্গী এখন ছোটদেরও, বিশেষ করে টিনএজারদের। তখন তাদের মধ্যে আমিত্ব খুব বড় হয়ে দেখা দেয়। এই সময়ে অভিভাবকদের কয়েকটি দিক খেয়াল রেখে চলতে হবে বলে জানালেন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ।
ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে নির্দেশমূলক সুরে কথা নয়। যখনই দেখবেন, খুব তর্ক করছে, তার মানে ওর ইগোতে ধাক্কা লেগেছে। সম্মানজনক ব্যবহার চাইছে সে। ‘এটা করে নিবি’ না বলে ‘এটা কি তুমি করতে পারো’— এ ভাবে কথা বলার ধরন বদলাতে হবে। মারধর করা একেবারেই চলবে না।
পারিবারিক মিটিংয়েরও দরকার রয়েছে। সন্তানকে সুযোগ দিতে হবে বাবা-মায়ের প্রতি কোনও অভিযোগ থাকলে খোলাখুলি বলার। বিষয়গুলো নিয়ে সন্তান যেন ক্ষুব্ধ হয়ে না থাকে।
সন্তানকে নিজস্ব পরিসর দিতে হবে। হয়তো সে ফোন করতে করতে আড়ালে গেল। সেখানে গোয়েন্দার মতো অনুসরণ করলে ওরা কিন্তু মা-বাবার প্রতি বিশ্বাস হারাবে।
পৃথিবীটাকে কখনও ওদের নজরে দেখুন। আপনার অলিভিয়া রডরিগোর গান ভাল না-ই লাগতে পারে, কিন্তু সন্তানের জন্য না হয় ওর সঙ্গে বসেই গানটা শুনলেন। সেখান থেকেই তৈরি হবে বন্ধুত্ব। ‘‘এক কথা বারবার বলা বন্ধ করতে হবে। সারাক্ষণ ‘পড়তে বস’ বললেই সে পড়বে না, বরং বিরক্ত হবে। তার চেয়ে বোঝার চেষ্টা করুন ও কেন পড়তে চাইছে না বা কোনও বিষয়কে ভয় পাচ্ছে কি না। এ ছাড়া, ডিজিটাল সময় যদি নির্দিষ্ট না রাখা যায়, তা হলে রাগ, মেজাজ এগুলো চলতেই থাকবে। সেটা যদি সন্তান মেনে চলে, তা হলে প্রশংসাও ওর প্রাপ্য। কারণ এই বয়সটা প্রশংসা পেতে চায়,’’ পরামর্শ পায়েলের।
টিনএজে সন্তান কোনও সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই সংঘাত নয়। বরং কোনও একটা ঘটনা যা আপনার ঠিক মনে হয়নি, তার উদাহরণ দিয়ে বোঝান যে, ‘ওর তো এ ভাবে পরিস্থিতি সামলানো উচিত ছিল, কিন্তু ও সেটা করেনি, ওর অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই তো?’ এই বিষয়গুলো মন ও মেজাজ নিয়ন্ত্রণে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
কোনও কারণে সন্তান হয়তো রেগে গিয়ে চিৎকার করছে বা এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেছে যাতে আপনি স্তম্ভিত। তখন কিন্তু অভিভাবককে একটু থেমে যেতে হবে। ১৫ বা ১৬র সন্তানকে বলা উচিত, ও যে ভাবে কথা বলছে, তাতে আপনার কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে। এই যে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, এটাও ওদের ভুল বুঝতে সাহায্য করবে।
পরিশেষে বলি, মেজাজে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে গেলে আপনাকেও কখনও দৌড় থামাতে হবে। নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে। আত্মবিশ্লেষণ এবং উল্টো দিকের মানুষটিকে বোঝার মধ্যেই লুকিয়ে এর সমাধানসূত্র।
মডেল: অলিভিয়া সরকার, রেজ়ওয়ান রব্বানি শেখ, নিকুঞ্জ বিহারী পাল, মোনালিসা পাহাড়ি শতপথী, রাইমা গুপ্ত; পোশাক: ভেরো মোদা, সাউথ সিটি মল (অলিভিয়া), নীলাঞ্জনা মোনালিসা); লোকেশন: ভর্দে ভিস্তা, চক গড়িয়া
ফুড পার্টনার: চাওম্যান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy