Advertisement
০৮ নভেম্বর ২০২৪
Oats

যদি চান শস্য, খেতে হবে ‘ওটস’ও

লাইফস্টাইল ডিজ়িজ় এড়াতে এই প্রজন্ম ঝুঁকছে স্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে। প্রাতরাশে তাই লুচি-পরোটার জায়গা দখল করে নিয়েছে ওটস লাইফস্টাইল ডিজ়িজ় এড়াতে এই প্রজন্ম ঝুঁকছে স্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে। প্রাতরাশে তাই লুচি-পরোটার জায়গা দখল করে নিয়েছে ওটস 

টক দই ও ফলের কুচি দিয়ে ওটস

টক দই ও ফলের কুচি দিয়ে ওটস

নবনীতা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৭:১৫
Share: Save:

লেখাটির গোড়ায় একটু ইতিহাসে চোখ রাখা যাক। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশদের ব্রেকফাস্ট টেবলে রোজকার অতিথি ছিল ‘পরিজ’। দুধের মধ্যে দানাজাতীয় শস্য জ্বাল দিয়ে তৈরি হত এই পরিজ। শরীর ভাল রাখতে এই খাবারটি খেতেন সাহেবসুবোরা। তার দেখাদেখি বাঙালি বাড়িতেও পরিজ তৈরি শুরু হয়, তবে অবশ্যই তা পথ্য হিসেবে। নানা ফোড়ন দেওয়া, রকমারি মাছের রসনায় তৃপ্ত বাঙালি এ পরিজ পছন্দ না করলেও, সাহেব ডাক্তারের পরামর্শে মাঝেসাঝে খেতেন। কিন্তু যুগ বদলেছে। বিশ্বায়নের জীবনে থাবা বসিয়েছে সেডেন্টারি লাইফস্টাইল ও নানা অসুখ। তাই রোগবালাই দূরে রাখতে প্রাত্যহিক জীবনে এই খাবার কাছে টেনে নিয়েছে বাঙালি। আর পরিজ তৈরির সাধু উপাদান ওটস জায়গা করে নিয়েছে হেঁশেলে।

উৎসের সন্ধানে

একেবারেই দেশজ নয় এই খাবারটি। বরং ব্রিটিশ বলা যায়। ইউরোপের ঠান্ডা আবহাওয়ায় লালিত এ শস্য। প্রায় ৪০০০ বছরের পুরনো এ শস্য কিন্তু প্রথমে মানুষে মুখেও তুলত না। বরং খামারের পশুদের খাওয়ানোর জন্য ব্যবহার করা হত। যেহেতু ফাইবার প্রচুর থাকে, গৃহপালিত পশুদের পেট ভরানোর জন্য এটি ছিল উপাদেয়। পরে ক্রমশ এর গুণে মুগ্ধ হয়ে ওটসকে পছন্দের খাবারের তালিকায় নিয়ে আসেন স্কটল্যান্ডের বাসিন্দারা। ব্রেকফাস্ট টেবলে জায়গা করে নেয় ওটস। ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপ ও আমেরিকায়। প্রত্যেক বছর আমেরিকায় ২৯ অক্টোবর ওটমিল দিবস পালন করা হয়।

রকমসকম

ওটসের অনেক ভাগ আছে। এই শস্য তুলে তা ছাঁটাই করা হয়। আর এই কাটের উপরেই নির্ভর করে ওটসের টেক্সচার ও স্বাদ। তাই কাটের উপরে ভিত্তি করে এর নামও দেওয়া হয়েছে। খেত থেকে তোলার পরে এ শস্য অনেকটা পাকা ধানের মতো দেখতে হয়। হালকা সোনালি রঙের। আর এত গুণ থাকায় একে গোল্ডেন গ্রেন বা সোনালি শস্যও বলা হয়ে থাকে।

এই শস্য তুলে খোসা ছাড়িয়ে বিভিন্ন কাট দেওয়া হয়। গোটা ওটস অনেক সময় লাগে রাঁধতে। তাই স্টিল কাট বা রোলড ওটসের চাহিদাই বেশি। সাধারণত মেটাল ব্লেড দিয়ে এক-একটা শস্য দানা দু’তিন ভাগে কেটে নেওয়া হয়। একে বলে স্টিল কাট ওটস। এই ওটস সিদ্ধ হতে কুড়ি মিনিট মতো সময় লাগে। তবে এতে টেক্সচার বজায় থাকে। মেটাল ব্লেড দিয়ে কাটার পরিবর্তে স্কটিশরা পাথর দিয়ে এই শস্য গুঁড়িয়ে নিতেন। এতে যেমন সূক্ষ্ম দানাও থাকত, মোটা দানাও থেকে যেত। ফলে রান্না করলে ভাল টেক্সচার পাওয়া যেত। এই ধরনের ওটস দিয়ে সাধারণত পরিজ তৈরি করেই খাওয়া হত। একে বলে স্কটিশ ওটমিল। আর আছে রোলড ওটস। ধান থেকে যেভাবে চাল তৈরি করে, সেভাবেই এ শস্য স্টিম করে নেওয়া হয়। তার পরে রোল করে ফ্লেকসের আকার দেওয়া হয়। এই ওটস ফ্লেকসই রোলড ওটস নামে পরিচিত। এই প্রসেসড ওটস আবার ওটমিল নামেও পরিচিত। যেহেতু রোলড ওটস ঝটপট রান্না করে খাওয়ার জন্য তৈরি করা যায়, তাই একে ওটমিলও বলে। আর বেশি সময় ধরে স্টিম করে পাতলা ফ্লেকস বানিয়ে তৈরি হয় ইনস্ট্যান্ট ওটস। এই ধরনের ওটস বিক্রিও হয় বেশি। পাওয়া যায় ওটসের ময়দা, যা দিয়ে ব্রেড, কুকিজ়ও তৈরি করা হয়।

কেন খাবেন ওটস?

• ডায়াটিশিয়ান প্রিয়া আগরওয়াল বললেন, ‘‘১০০ গ্রাম ওটসে ৩৮৯ ক্যালরি, ১৬.৯ গ্রাম প্রোটিন, ৬৬.৩ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১০.৬ গ্রাম ফাইবার, ৬.৯ গ্রাম ফ্যাট পাওয়া যায়। এ ছাড়াও জ়িঙ্ক, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, কপারের মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসে ভরপুর এই শস্য। ফলে এর গুণ অনেক।’’

• একে তো প্রচুর ফাইবার থাকে। তাই কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। তাই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলে ওটস কাজে দেবে। তা ছাড়া পেট ভরায়, ওজনও নিয়ন্ত্রণে রাখে।

• ওটস গ্লুটেনফ্লি। শারীরিক সমস্যার জন্য যাঁদের গ্লুটেন খাওয়ায় বিধিনিষেধ আছে, তাঁরা ওটস খেতে পারেন স্বচ্ছন্দে।

• রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে ওটস। আর টাইপ-টু ডায়াবিটিসের রিস্কও কমাতে সাহায্য করে। এর হাই ফাইবার আর কমপ্লেক্স কার্বস গ্লাইকোজেনেসিস পদ্ধতি মন্থর করে। এতে বিটা-গ্লুকেন থাকে, যা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

• এটি লিপিড প্রোফাইল নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে কোলেস্টেরল লেভেল ঠিক রাখতেও ওটস খুব কার্যকর। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলে তাঁরাও নিয়মিত ওটস খেতে পারেন।

• ওটসে যেহেতু ফাইবার বেশি, কার্বস ও ফ্যাটের পরিমাণ কম, তাই ওজন কমাতেও ওটস সিদ্ধহস্ত। তাই ওবেসিটির রোগীরা ডায়েটে রাখতেই পারেন ওটস। তবে তা খেতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে।

কোন ওটস খাবেন ও কী ভাবে রাঁধবেন?

প্রিয়ার কথায়, ‘‘বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ইনস্ট্যান্ট বা কুইক ওটস। কিন্তু আমার মতে, স্টিল কাট বা রোলড ওটস খাওয়াই সবচেয়ে ভাল। আর ওটস কী ভাবে খাবেন, তার উপরেও এর পুষ্টিগুণ নির্ভর করে। পরিজ বা খিচুড়ির মতো রেঁধে খেলেই এর পুষ্টি পুরোটা বজায় থাকে। টক দইয়ের মধ্যে ফলের কুচি ও ওটস দিয়েও খাওয়া যায়।’’ এ বিষয়ে সহমত ক্লিনিকাল নিউট্রিশনিস্ট হিনা নাফিসও। হিনার কথায়, ‘‘পুষ্টিকর খাবার আনহেলদি ভাবে তৈরি করলে কোনও লাভ নেই। ওটসে অনেক তেল, ঘি দিয়ে বিরিয়ানি তৈরি করে খেলে খুব উপকার নেই। বরং খিচুড়ি করে খেতে পারেন।’’ ওটসের ময়দা দিয়ে রুটি তৈরি করেও খাওয়া যায়।

ওটস কেনার সময়ে তা কোন দেশের, সেটাও দেখা দরকার বলে মনে করছেন প্রিয়া। তাঁর মতে, কাশ্মীরের আপেলের স্বাদ আর পশ্চিমবঙ্গে কৃত্রিম আবহাওয়া তৈরি করে তাতে যে আপেল উৎপাদন হয়, তার স্বাদ ও পুষ্টি এক নয়। ওটসের ক্ষেত্রেও তাই। পশ্চিমের শীতল আবহাওয়া ওটসের ফলনে সহায়ক। আমাদের দেশে এখন ওটস চাষ হচ্ছে। কিন্তু অনুকূল আবহাওয়া নেই। তাই আইরিশ বা স্কটিশ ওটসের স্বাদ বা গুণ এ দেশে উৎপন্ন ওটসের তুলনায় অনেক বেশি। তবে আমাদের দেশেও কিন্তু এমন গুণী-শস্য কম নেই। ওটসের বদলে আমাদের দেশজ ফসল জোয়ার, বাজরা, অমরন্থও সমান উপকারী বলে জানালেন প্রিয়া। তবে সব খাবারের মধ্যে ওটসও রাখতে পারেন রোজকার আহারে। এতে খাদ্যতালিকা সমৃদ্ধ হবে বইকি।

শুধু খাদ্যগুণই নয়। ত্বক ভাল রাখতেও ওটস প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। তাই খাওয়ার মাঝেই সপ্তাহে এক দিন দুধ, মধু ও ওটস দিয়ে প্যাক বানিয়ে মুখে মেখে নিতে পারেন। এতে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস থাকায় তা ত্বকে বলিরেখা পড়া রোধ করে। যৌবন ধরে রাখে ত্বকের। শরীর ও ত্বক, এই দুইয়েরই বন্ধু হয়ে উঠতে পারে ওটস।

অন্য বিষয়গুলি:

Oats Health Lifestyle
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE