‘কুলি’ ছবির শুটিংয়ের সময়ে ভয়ঙ্কর এক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন অমিতাভ বচ্চন। প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন তিনি। তবে প্রাণে বাঁচলেও সে সময়ে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি-এর ভাইরাস ঢুকে পড়েছিল তাঁর শরীরে। বছরখানেক আগে বলিউডের বিগ বি নিজেই জানিয়েছিলেন, তাঁর লিভারের মাত্র ২৫ শতাংশ ঠিক আছে। তবে টানা চিকিৎসা ও নিয়মের মধ্যে থাকার ফলে অভিনেতা কিন্তু এখন স্বাভাবিক জীবনযাপনই করছেন।
অনেক সময়ে বিদেশে যাওয়ার আগে বা রক্তদান করার সময়ে অথবা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করাতে গিয়ে অনেকের হেপাটাইটিস বি বা সি ধরা পড়ে। প্রাথমিক ভাবে এতে বেশির ভাগ রোগীই ভেঙে পড়েন। কারণ অনেকেরই ধারণা, হেপাটাইটিস বি বা সি মানেই লিভার সিরোসিস বা ক্যানসার অবধারিত। অর্থাৎ অনেকাংশেই মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু সত্যিই কি তাই? না কি সেখান থেকেও ফিরে আসা যায় সুস্থ ভাবে?
হেপাটাইটিস আসলে কী?
এটি যকৃত বা লিভারের প্রদাহজনিত অসুখ। মূলত লিভারে ভাইরাসের সংক্রমণের ফলেই এই রোগ হয়। এ ক্ষেত্রে চিহ্নিত করা গিয়েছে মোট পাঁচটি ভাইরাস। যা পরিচিত হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি, ই নামে। হেপাটাইটিস এ এবং ই সংক্রামিত হয় দূষিত খাদ্য এবং পানীয়ের মাধ্যমে। হেপাটাইটিস বি, সি, ডি সংক্রামিত হয় মূলত ব্লাড ট্রান্সফিউশন এবং একাধিক বার ব্যবহৃত একই ইঞ্জেকশনের সুচ ব্যবহারের মাধ্যমে। এ ছাড়াও সাঁলয় ট্যাটু আঁকার সময়েও সতর্কতার অভাবে এই ভাইরাস দেহে ঢুকতে পারে। সংক্রামিত মায়ের দেহ থেকে শিশুর মধ্যে হতে পারে সংক্রমণ।
যকৃতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, রক্তে লোহিত কণিকার আয়ু শেষ হলে, তার অন্তর্গত বিলিরুবিনকে দেহ থেকে নিষ্কাশিত করা। হেপাটাইটিস ভাইরাসের ফলে যকৃতের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। ফলে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে দেহ হলদেটে হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন ধরনের ভাইরাল হেপাটাইটিসের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হল হেপাটাইটিস বি এবং সি। কারণ এই দু’ধরনের ভাইরাস থেকে সমস্যা হলে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। আবার এই দু’টি ভাইরাস থেকে ক্রনিক হেপাটাইটিসও হতে পারে। যা পুরোপুরি নিরাময় করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। ক্রনিক হেপাটাইটিস থেকে লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যানসার হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. অনির্বাণ নিয়োগী বললেন, ‘‘ঠিক সময়ে ধরা পড়লে হেপাটাইটিস বি নিরাময় করা সম্ভব। গত পাঁচ বছরে অনেক ভাল ওষুধ আবিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন উপসর্গ ঠিক সময়ে ধরা পড়ে না। চিকিৎসা দেরিতে শুরু হলে সমস্যা জটিল হয়ে উঠতে পারে।’’
রোগের লক্ষণ
অনেক সময়েই দীর্ঘ দিন এই রোগের উপসর্গ ধরা পড়ে না। সংক্রমণের পরে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে সময় লাগতে পারে ৩০ থেকে ১৮০ দিন পর্যন্ত। প্রথমে ঠান্ডায় কাঁপুনি, খিদে না পাওয়া, ক্লান্তি, জ্বরজ্বর ভাব, শরীরে ব্যথা— এই উপসর্গ দেখা দিতে পারে। পরবর্তী স্তরে অবশ্য জন্ডিস, চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া, তীব্র জ্বর, অস্থিসন্ধিতে যন্ত্রণা, গাঢ় বর্ণের প্রস্রাব, বমি বমি ভাব ও বমি, গা চুলকানি, পেট ব্যথা, গায়ের রং ফ্যাকাশে হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়।
রোগ নির্ণয়
কিছু রক্ত পরীক্ষা এবং লিভার ফাংশন টেস্টের (এলএফটি) মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়ে থাকে।
রকমফের
হেপাটাইটিস বি-এর সংক্রমণকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন অ্যাকিউট বা তীব্র সংক্রমণ এবং ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ।
কোনও ব্যক্তি যখন প্রথম বার আক্রান্ত হন, তখন সেটিকে অ্যাকিউট হেপাটাইটিস বলে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ওযুধের মাধ্যমে এটি সেরে যায়। এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে হেপাটাইটিস বি-এর অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যা তাকে পুনর্সংক্রমণের হাত থেকেও রক্ষা করে।
কিন্তু এই ভাইরাসটিই যখন দীর্ঘ সময় অর্থাৎ ছ’মাসেরও বেশি সময় ধরে রক্তে থাকে, তখনই তা পরিণত হয় ক্রনিকে। আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাধারণত ৫-১০ শতাংশ ক্রনিক হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
ক্রনিক হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে অনেক সময়ে যকৃত ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডা. নিয়োগী বললেন, ‘‘অনেক সময়েই অ্যাকিউট অবস্থায় হেপাটাইটিস ধরাই পড়ে না। ফলে যখন তা নির্ণয় করা হয়, তখন দেখা যায়, সেটি ক্রনিকে পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার লিভার সিরোসিস হওয়ার পরেও ধরা পড়ে। তবে সেই পরিস্থিতিতেও যদি ঠিক মতো চিকিৎসা হয়, তা হলে ধীরে ধীরে সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তবে ক্রনিক হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা (যকৃত ক্যানসার) হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যদিও সেই শতাংশ আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। আসলে হেপাটাইটিস সি হলে লিভার ক্যানসারের ভয় বেশি থাকে।’’
নিরাময়ের উপায়
হেপাটাইটিস বি ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন। অ্যাকিউট হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে কিছু ওষুধ এবং ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠা যায় বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তবে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে হবে হেপাটাইটিস বি নেগেটিভ হয়েছে কি না। এ ছাড়া পুরোপুরি সুস্থ হলেও নিয়ম মেনে চলতে হবে।
ক্রনিক হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে চিকিৎসা চলবে নিয়মিত। চিকিৎসকের পরামর্শের বাইরে কিছু করা যাবে না। সেই সঙ্গে রোগীর সম্পূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন। রোগীর পথ্যতেও বিশেষ নজর দিতে হবে।
কী খাবেন?
হেপাটাইটিস বি হলে একেবারেই তেলমশলা যুক্ত খাবার খাওয়া চলবে না। গ্লুকোজ় শরবত খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়। এ সময়ে শরীরকে যতটা সম্ভব ঠান্ডা রাখতে হয়। তাই আখের রস, কচি ডাবের জল, মৌরি-মিছরি ভেজানো জল খাওয়ানো উচিত। তবে ঠান্ডা লাগার ধাত থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এ ছাড়াও বেশি করে ফল, আনাজ খাওয়া ভাল। সহজে হজম হয়, এমন খাবার বেছে নেওয়া উচিত।
হেপাটাইটিস বি-এর টিকা
হেপাটাইটিস বি-এর টিকা বেশ জনপ্রিয়। এটি নিলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় থাকে না। এ ক্ষেত্রে প্রথমে তিনটি ডোজ় এক মাস অন্তর দিতে হয়। চতুর্থ টিকা দিতে হয় প্রথম ডোজ়ের ঠিক এক বছর পরে। পাঁচ বছর পরে নিতে হয় বুস্টার ডোজ়। এতে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে শরীরে। টিকা নেওয়া না থাকলে যে কোনও বয়সে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রত্যেক বছর ২৮ জুলাই বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিস দিবস পালন করা হয়। সেখানে হেপাটাইটিস বি এবং সি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি, রোগনির্ণয়, রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতন করা হয়ে থাকে। মোদ্দা কথা, সাধারণ কিছু উপসর্গকে গুরুত্ব দিয়ে যদি ঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা শুরু করা যায়, তবে এই রোগ থেকে মুক্তি সম্ভব।
মডেল: মোনালিসা পাহাড়ি
তৃণা বৈদ্য
ছবি: দেবর্ষি সরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy