আর জি করের ঘটনা উস্কে দিয়েছে বেশ কিছু চাপা পড়ে যাওয়া আলোচনার দরজা। যাদের মধ্যে একটা অবশ্যই সন্তানকে সুশিক্ষিত, সচেতন করে গড়ে তোলার পাঠ ও লিঙ্গসাম্যের শিক্ষা। বাড়ি, স্কুল ও পারিপার্শ্বিক থেকে একটা শিশু যা যা শুষে নেয়, তা-ই তৈরি করে দেয় আগামীর পৃথিবী। সেই পৃথিবী থেকে সমস্ত খারাপ, সব বৈষম্য উধাও হয়ে যাবে, তা কষ্টকল্পনা। তবে নিজেদের সন্তান বা ছাত্রছাত্রীকে একজন ভাল মানুষ ও দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বটুকু নেওয়াই যায়।
গোড়ার কথা
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপিকা সুহৃতা সাহা প্রথমেই একটা কথা স্পষ্ট করে দিলেন, ‘‘জেন্ডার সেন্সিটাইজ়েশন বিষয়টিই ‘ডিজেন্ডার্ড’ হতে হবে। অর্থাৎ, লিঙ্গসাম্য শেখাতে গেলে ছেলে কিংবা মেয়ে নির্বিশেষে শেখাতে হবে ছোটদের। আলাদা করে শুধু মেয়ে বলেই নয়, বরং মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শেখাতে হবে। ছেলে কিংবা মেয়ে হওয়ার কারণে আলাদা করে কোনও সুবিধে পাওয়া বা পিছিয়ে থাকার ভাবনাটাই যাতে মাথায় না আসে।’’ মানুষের আসল পরিচয় তার লিঙ্গে নয়, বরং তার কাজে, তা গোড়াতেই শেখাতে হবে ছেলেমেয়েদের।
এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দিলেন অধ্যাপিকা সাহা, ‘‘এক ইংরেজি সিনেমায় দেখেছিলাম, দুর্ঘটনায় স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলা এক মহিলাকে ডাক্তার স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় প্রশ্ন করছেন, ‘তোমার নাম কী’? মেয়েটি বলতে পারছে না। পরের প্রশ্নটাই ছিল, ‘তুমি কী করো?’ আমাদের দেশ হলে পরের প্রশ্নটা হয়তো হত, ‘তোমার স্বামীর/বাবার নাম কী?’ তফাত এখানেই।’’ লিঙ্গপরিচয় বা সঙ্গে যুক্ত মানুষটির পরিচয় নয়, বরং কাজের মাধ্যমেই একজনের পরিচয় নির্ধারিত হওয়া উচিত, সেটা বুঝিয়ে দিতে হবে সন্তানকে। ‘‘মেয়ে হলেও তাকে যে স্বনির্ভর হতেই হবে, সেই শিক্ষাটা খুব জরুরি। ছেলেরা উপার্জন না করলে বিয়ের বাজারে ‘যোগ্য’ হয়ে ওঠে না, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সেই বাধ্যবাধকতা নেই, পরিবারে এটাই লিঙ্গবৈষম্যের প্রথম পদক্ষেপ। সেটা গোড়া থেকে নির্মূল করতে হবে,’’ বললেন সুহৃতা।
ভেদাভেদ নয়
যোধপুর পার্ক বয়েজ় স্কুলের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিকক্ষ গোলাপি রং করানো হয়েছে। মেয়ে মানেই গোলাপি আর ছেলে মানেই নীল— এই ধারণা ভেঙে দিতেই এই পদক্ষেপ, বলে জানালেন সে স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিত সেন মজুমদার। ‘‘কলকাতা পুলিশের সহযোগিতায় জেন্ডার ইকুয়ালিটি নিয়ে অনেক ওয়ার্কশপ করানো হয়। আমাদের স্কুলে লটারির মাধ্যমে ভর্তির নিয়ম। ফলে অনেক ফার্স্ট জেনারেশন লার্নারও ভর্তি হয়। তাদের অনেকেই বাড়ি থেকে গালিগালাজ, নারীবিদ্বেষী কথাবার্তা শিখে এসে স্কুলে বলে। সেগুলোকে চিহ্নিত করি আমরা। অভিভাবকদেরও বোঝাই,’’ বললেন তিনি। বাবা-মা পরস্পরের প্রতি কেমন আচরণ করছেন, কী ভাবে কাজ ভাগ করে নিচ্ছেন, তা-ও সন্তানের মধ্যে সাম্যচেতনা তৈরি করে।
লড়িয়ে দেওয়া বা বিভেদ নয়, বরং ছেলেমেয়েরা সহজ ভাবে পরস্পরকে গ্রহণ করতে পারে যাতে, পরিপূরক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছোট থেকেই যাতে বুঝতে পারে, তার জন্য দায়িত্বশীল হতে হবে মা-বাবাকেও। ছেলেকে কাঁদতে দেখলে ‘মেয়েদের মতো কাঁদিস না’ গোছের কথাবার্তা বলা যাবে না। কাঁদার সঙ্গে যে দুর্বলতা বা মেয়েদের কোনও সম্পর্ক নেই, সেটা জানা দরকার। একই ভাবে ছেলেদের খেলনাবাটি খেলতেও নিষেধাজ্ঞা চাপানোর আগে ভাবা দরকার। সব রকম অপশন খোলা রাখুন সন্তানের সামনে। বেছে নিতে দিন তাকেই।
মডার্ন হাই স্কুল ফর গার্লস এবং মডার্ন হাই স্কুল ইন্টারন্যাশনালের ডিরেক্টর দেবী কর এ প্রসঙ্গেবললেন, ‘‘ছোট থেকে একসঙ্গে খেলাধুলো করে বেড়ে ওঠা, বড় হয়ে একসঙ্গে কাজ করা... ছেলে আর মেয়েদের সবই একসঙ্গে করতে হবে। তারই মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মে হরমোনের পরিবর্তন, যৌন আকর্ষণ তৈরি হবে। বাচ্চাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখাতে হবে তাই ছোট থেকেই।’’
সেক্স এডুকেশন
যৌনতা নিয়ে ট্যাবু নয়, তা যাতে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারে আপনার সন্তান, সে খেয়াল রাখতে হবে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ যে স্বাভাবিক, তা নিয়ে গোপনীয়তা বা বকাঝকার দরকার নেই, তা অনেক অভিভাবকই বোঝেন না। একটা বয়সের পরে যৌনচেতনার উন্মেষ ঘটবেই সন্তানের মধ্যে। তখন সংবেদনশীল ভাবে সামলাতে হবে পুরো বিষয়টি। স্কুলের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কেও সে সচেতন হতে শিখবে এই সময় থেকেই। বিপদ এলে কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করতে হবে, কী ভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হবে, সেটা শেখা জরুরি। ‘‘গুড টাচ, ব্যাড টাচের শিক্ষা এখন স্কুলে দেওয়া হলেও আমি মনে করি, এই শিক্ষাটা অর্গানিক্যালি হওয়া উচিত। বোঝার বয়স হওয়ার আগেই ‘গুড টাচ ব্যাড টাচ’-এর পাঠ দিলে অনেক সময়েই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সেগুলি আক্ষরিক অর্থে ধরে নেয়। আশপাশের সুস্থ, সুন্দর সম্পর্কগুলোও সন্দেহের আওতায় চলে আসে। সেটা খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়,’’ বললেন দেবী কর।
জেন্ডার সেন্সিটাইজ়েশনের একটা ইতিবাচক দিক হল, একটা কুইয়ার স্পেস তৈরি হয়েছে, মনে করেন সুহৃতা। তা ছাড়া মেয়েদের প্রতি অতি-সংবেদনশীলতা আসলে নারী-পুরুষের বিভেদ বাড়ায় বই কমায় না। ‘‘মেয়েদের আলাদা করে সুবিধে বা সাহায্য দরকার, এই ধারণাটাই মেয়েদের একটা অসম জায়গায় ঠেলে দেয়। সেটা কাম্য নয়,’’ বললেন সুহৃতা।
মনের বয়স
একই বয়সি বা একই ক্লাসে পড়া শিশুদের মধ্যে ম্যাচিয়োরিটির তফাত থাকে। কে কতটা বুঝতে বা গ্রহণ করতে পারবে, সেটা আঁচ করে সেই অনুযায়ী তাকে শেখাতে হবে। যেমন একটা পর্যায়ের পরে বায়োলজি সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি হলে মেনস্ট্রুয়েশন নিয়ে ট্যাবুও ভেঙে ফেলা দরকার। মেয়েরা স্বাভাবিক ভাবেই তা জেনে যায়, বয়সের সঙ্গে। ছেলেদের বোঝাতে হবে, প্রাণিজগতের বাকিদের মতোই মানুষের ক্ষেত্রেও এটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। অমিত সেন মজুমদার জানালেন, তাঁর স্কুলে এইট-নাইনের ছেলেদের এটা শেখানো হয়।
কো-এডুকেশনের চেয়েও, গার্লস ও বয়েজ় স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই খুব দরকারি হয়ে ওঠে লিঙ্গসাম্যের পাঠ। তবে এই শিক্ষার শুরু হওয়া উচিত বাড়ি থেকেই। সোশ্যাল মিডিয়ার দায়িত্বশীল ব্যবহারও এই শিক্ষার মধ্যেই পড়ে। নারী-পুরুষের সমমর্যাদার বিষয়টি ক্ষেত্রবিশেষে নয়, সর্বস্তরে প্রযোজ্য হওয়া দরকার। ঠিক, ভুলটা চিনিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বড়দের। বাকিটা বুঝে নিতে দিন জেন জ়ি-কেই।
সায়নী ঘটক
ছবি: সর্বজিৎ সেন; মডেল: আরুষ দে, অনুমেঘা কাহালি, রোমিত বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্ণেশ চক্রবর্তী; মেকআপ: অভিজিৎ কয়াল; লোকেশন: স্মৃতি ঘর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy