পুরনো (বাঁ দিকে) এবং নতুন (ডান দিকে) ভারতীয় ন্যায়ের প্রতীক। ছবি: পিটিআই।
ভারতের ন্যায়ের প্রতীক বদলেছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় সেই নতুন প্রতীক উন্মোচন করে ঘোষণা করেছেন, ‘‘আইন এখন আর অন্ধ নয়। আইন এ বার চোখ মেলে দেখবে আর সবাইকে সমান ভাবে দেখবে।’’ সেই ভাবনা থেকেই ন্যায়ের প্রতীকের চোখের বাঁধন খুলেছে। তরবারি সরে হাতে উঠেছে সংবিধান। তবে এর পাশাপাশি বদলেছে নতুন মূর্তির পরিধানও।
আগের ‘লেডি জাস্টিস’-এর মূর্তিটি ছিল রোমান স্থাপত্যের নিদর্শন। তার পরনে ছিল রোমান ঐতিহ্যের দুধসাদা গাউন। দু’বাহুতে বাজুবন্ধ। কোমরে কাপড়ের বন্ধনী। নতুন মূর্তির পরনে কুঁচি-আচল দিয়ে পরানো নকশা পাড়ের শাড়ি। গলায় কয়েক ছড়া হার, কানে লম্বাটে দুল, হাতে বালা। সঙ্গে কোমরবন্ধ এবং মাথায় ভারতীয় দেব-দেবীর মতো মুকুট।
ন্যায়ের প্রাচীন মূর্তিটির সঙ্গে বিশ্বের পরিচয় করিয়েছিলেন রোমান সম্রাট অগস্টস। সে প্রায় দু’হাজার বছর আগের কথা। পরে ওই একই ন্যায়ের প্রতীকের ব্যবহার শুরু হয় ব্রিটেন-সহ বেশ কিছু দেশে। ভারতে ‘লেডি জাস্টিস’-এর আগমন ঘটেছিল ব্রিটিশদের হাত ধরেই। প্রায় ৩০০ বছর আগে যখন ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করে, তখন থেকেই ভারতীয় ন্যায়ের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিস’। তিন শতক পরে সেই প্রতীকের ভারতীয়করণ হল। যে বদলকে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব থেকে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার ‘মুক্তি’ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন প্রধান বিচারপতি। ন্যায়ের প্রতীকের পরিবর্তনে যে সেই ‘মুক্তি’ হয়েছে, তা মানছেন আইনজীবী এবং কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যও। তিনি বলছেন, ‘‘আগে চোখে কাপড় বাঁধার অর্থ ছিল, ধনী-দরিদ্র, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সামাজিক মর্যাদা যেন বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত না করে। কিন্তু সেটি ঔপনিবেশিক সময়ের ভাবনা। তখন সমাজে বৈষম্য ছিল। গণতান্ত্রিক দেশে এমনিই সবাই সমান। সেখানে চোখ বেঁধে রাখলে চলবে না। চোখ খুলে সব কিছু দেখতে হবে।’’ তবে একই সঙ্গে তাঁর মত, ‘‘ন্যায়ের প্রতীকের ভারতীয় দেবীর মতো পোশাক না পরালেও চলত। ওই অনাবশ্যক হিন্দুত্বকরণ না করলেও হত। এতে ওই বদলের তাৎপর্য কিছুটা হলেও লঘু হয়ে গিয়েছে।’’
গত কয়েক মাস ধরেই ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা, ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম-সহ নানা রকম পরিবর্তনের মধ্যে দিতে চলেছে ভারতীয় আইন। শাসক বিজেপির নেতারা বলছেন, ‘‘ওই সবই ব্রিটিশ শাসকের প্রভাবমুক্ত হয়ে আদতে ভারতীয় আইনের ‘আত্মশুদ্ধি’র প্রক্রিয়া।’’ ন্যায়ের প্রতীকের ভারতীয়করণকেও সেই আত্মশুদ্ধি বলেই মনে করছেন বিজেপির নেতারা। তাঁদের বক্তব্য সেই ভারতীয়করণ করার জন্য যদি ন্যায়ের প্রতীককে ভারতীয় পোশাক পরানো হয়, তবে ক্ষতি কী! রাজ্য বিজেপির সভাপতি এবং লোকসভার সাংসদ সুকান্ত মজুমদার বলছেন, ‘‘ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের যে মূর্তি, তাতে ভারতীয় পোশাক থাকবে না তো কি পাকিস্তানের থাকবে? আসলে একটা শ্রেণির মানুষের মজ্জায় কমিউনিজ়ম রয়ে গিয়েছে, যেটা গোটা পৃথিবী ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।’’
কিন্তু কোনও জিনিসের সংস্কৃতিগত বদলের জন্য কি পোশাক বদলানোটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। যে হেতু ন্যায়ের প্রতীক একটি ভাস্কর্য, তাই আনন্দবাজার অনলাইন প্রশ্ন করেছিল এক ভাস্কর্য শিল্পীকেই। সনাতন দিন্দা বললেন, ‘‘ন্যায়ের প্রতীকের হাতে সংবিধান ধরানো বা চোখের বন্ধন খুলে দেওয়ার নেপথ্যে নিশ্চয়ই কোনও ভাবনা কাজ করেছে। দেশের প্রধান বিচারপতি সেই কারণ জানিয়েছেনও। তবে পোশাকের ধরন বদলে দিয়ে আলাদা কিছু হয় বলে অন্তত আমি মনে করি না। আগের মূর্তিটি রোমান গ্রিক স্থাপত্যের ছিল। এখন শাড়ি-গয়না-মুকুট পরানো হয়েছে। তবে আমি মনে করি, আসল বদল ভিতর থেকে আসা দরকার। তা না হলে সবই অর্থহীন।’’
তবে ভারতীয় ন্যায়ের প্রতীকের পোশাকের সঙ্গে ভারতীয় দেবীর বেশভূষার সাযুজ্য থাকাকে অস্বাভাবিক মনে করছেন না ইতিহাসবিদেরা। তাঁরা বলছেন, রোমানেরা তো গ্রিক দেবী জাস্টিসিয়া বা ডাইসির আদলেই তৈরি করেছিল ন্যায়ের প্রতীককে। তবে এ-ও ঠিক, সে দেশে ভারতের মতো নানা জাতি নানা মতের বৈচিত্র ছিল না। তাই দু’টি বিষয়ের মধ্যে সরাসরি তুলনা টানাও যায় না।
সুকান্ত অবশ্য বলছেন, সব কিছুতে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রতীক খুঁজতে চাওয়াও অর্থহীন। তিনি বলছেন, ‘‘ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা তো আমাদের সংবিধানেই বলা আছে। কিন্তু মূর্তিকে দেবীর চেহারা দিলে তো এ দেশে অন্য কোনও রূপ দেওয়া সম্ভব নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy