কাঁথার কাজের জন্য পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন প্রীতিকণা গোস্বামী। ছবি: সর্বজিৎ সেন।
সোনারপুরের কামরাবাদের যে জায়গায় এনে গুগল ম্যাপ দাঁড় করাল তার পরে আর চারচাকা যাওয়ার উপায় নেই। গলি এতটাই সরু যে বাইক যাওয়াও মুশকিল। বেশ কয়েকটি সঙ্কীর্ণ গলি পেরিয়ে পৌঁছনো গেল প্রীতিকণা গোস্বামীর বাড়িতে। কাঁথার কাজের জন্য যিনি সদ্যই পেয়েছেন পদ্মশ্রী। অতি সাদামাঠা দোতলা বাড়ি, সামনে একফালি বাগান। ভিতরে ঢুকতে বোঝা গেল, পরিকল্পনা করে বাড়িটি তৈরি হয়নি, হয়তো যখন যে ভাবে সম্ভব হয়েছে গাঁথা হয়েছে ইট। দরজা খুলে দিলেন প্রীতিকণার এক ছাত্রী। বসালেন দোতলার ঘরে, যেখানে আসবাব বলতে কয়েকটি চেয়ার। সে ঘরে রয়েছে তাঁর আরও পাঁচ ছাত্রী, মেঝে জুড়ে চলছে সুচ-সুতোর মিনাকারি।
আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় বেশ ঠান্ডা লেগেছে প্রীতিকণার। জানালেন কিছু দিন আগে দুবাই থেকে ফিরেছেন, সেখানে থাকে তাঁর বড় মেয়ে মহুয়া (লাহিড়ী)। সে দিন অবশ্য বাড়িতে মহুয়াও ছিলেন, মায়ের পদ্মশ্রী পাওয়ার খবর শোনার পরে ফেরা হয়নি কাজের জায়গায়। আশপাশের প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে সটান আমাকে বাড়িতে পৌঁছে যেতে দেখে মহুয়া বলছিলেন, ‘‘এই সম্মানটা পাওয়ার পরে পরিস্থিতি বদলেছে। আগে তো এই এলাকায় ‘অঙ্কিতার মা’ (প্রীতিকণার ছোট মেয়ে) বলে সকলে মা-কে চিনত। নিজের নামে পরিচিতি পাওয়ার সৌভাগ্য মায়ের সবে হল।’’ মেয়ের কথা আভাস দিয়ে গেল মায়ের প্রতি বঞ্চনার। ‘‘পরিবারে আমি কিন্তু দ্বিতীয় পদ্ম-পুরস্কার প্রাপক। আমার কাকা নিখিল জ্যোতি ঘোষ পদ্মভূষণ পেয়েছিলেন,’’ হাসি খেলে গেল বৃদ্ধার চোখে। না পড়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার।
আমার সামনে সেলাইয়ের যে জাদুসম্ভার তাঁরা মেঝেতে সাজিয়ে দিলেন দেখে মুগ্ধতার চেয়ে বিস্ময়ের পাল্লা ভারী। দেশজ ঐতিহ্যে কত যে মণিমাণিক্য লুকিয়ে! মাঝারি মাপের চৌকো কাপড়ের উপরে সুতোর টানে যে শিল্পের জন্ম হয়েছে, তাতে রান সেলাইয়ে রয়েছে অসংখ্য বৈচিত্র। এই পিসগুলি মূলত দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখার জন্য বানানো। সেলাইয়ের জ্যামিতিক বিন্যাসের সূক্ষ্মতাও চমকপ্রদ। নির্বাক হলাম জেনে যে, কাপড়ে শুধু আউটলাইন আঁকা হয়, ভিতরের কারুকাজ সবটাই হয় শুধু চোখের আন্দাজে! বয়সজনিত কারণে এখন আর মেঝেতে বসতে পারেন না তিনি। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে প্রীতিকণা বললেন, ‘‘প্রায় তিন-চারশো বছর আগে যে সেলাইগুলো করা হত সে সব অধিকাংশই অবলুপ্ত। বিভিন্ন মিউজ়িয়ামে তার কিছু নমুনা রয়েছে। সেখানে গিয়ে সেলাইগুলো ভাল করে দেখে ছবি তুলে এনে কাপড়ে করি। ছাত্রীদের শেখাই। এ ভাবে আমাদের ঐতিহ্যও বেঁচে থাকে।’’ তাই তাঁর কোনও কোনও শিল্পকর্মে রয়েছে প্রায় ২৪-২৫ রকমের সেলাই। এহেন নৈপুণ্য যে দীর্ঘ অভ্যেস ব্যতীত হাতে ধরা দেবে না, তা অনুমেয়। কিন্তু এর শুরু কী ভাবে? ‘‘আমাকে কেউ কোনও দিন সেলাই শেখায়নি। সবটা দেখে আন্দাজ করে শেখা। দশ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। আমরা পাঁচ বোন। এ দিকে সংসারে অনটন। স্কুল ফাইনাল পাশের পরে আমার এক বান্ধবী বালিগঞ্জে মারোয়াড়ি ফার্মে সেলাইয়ের কাজ করত। আমাকে ও সেখানে নিয়ে যায়। শাড়িতে শ্যাডো ওয়ার্ক করে মাসে চল্লিশ টাকা রোজগার করতে শুরু করলাম। কাজটা শিখেছিলাম ওরা কী ভাবে করছে সেটা দেখে। তার পর আমার কাজ দেখে একটার পর একটা কাজ আসতে শুরু করল। তিন বোনকেও তখন এই কাজে নিয়ে এলাম। বোনেরা মিলে রোজগার করে সংসার টানতাম,’’ তাঁর মুখের বলিরেখাও ঢেকে দিতে পারেনি মনের দৃঢ়তাকে।
তাঁর তৈরি শিল্পকর্মগুলির বৈশিষ্ট্য হল, কাপড়ের তিনটি স্তর একত্র করে কাজটি করা হয়েছে। কারণ বহু বছর আগে এ ভাবেই কাজ হত। কাজটা করতে হয় ভারসাম্য রেখে, যাতে সব দিক দেখতে একই রকম লাগে। ‘‘তার জন্য হাতে ব্যালান্স তৈরি করতে হয়। সেটা আনার জন্য ছাত্রীরা মায়ের সঙ্গে প্রায় দশ-পনেরো বছর ধরে কাজ করছে। তিন ধরনের ফ্যাব্রিক এখানে আছে, তিনটে একসঙ্গে সেলাই হয়। এর মধ্যে কোনও কাপড় হয়তো ধোয়ার পরে কুঁচকে যায়, কোনটা লুজ় থাকে, সেখানেই সেলাইয়ে ভারসাম্যের মুনশিয়ানা,’’ ব্যাখ্যা করলেন মহুয়া, প্রীতিকণার অন্যতম ছাত্রী। মায়ের জীবনসংগ্রাম জন্ম থেকে দেখেছেন মহুয়াও। খুব কম বয়সে বিয়ে হয় প্রীতিকণার। কিন্তু পারিবারিক অশান্তির কারণে বড় মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসেন মায়ের কাছে। ‘‘তখন আমার পিসতুতো দিদির উৎসাহে বিএ পড়তে শুরু করলাম। ওর মেয়ের একটা সংস্থা ছিল, সেখানে সেলাইয়ের কাজ করতে করতে গুজরাতি স্টিচ, বুলিয়ান, কাশ্মীরি স্টিচ, বখেয়া... কত রকম সেলাই শিখেছিলাম। এক দরজিকে দেখে রিফু করা শিখেছিলাম। দোকান থেকে রিফুর কাজ এনে বাড়িতে করতাম বাড়তি রোজগারের জন্য। ইতিমধ্যে আবার শ্বশুরবাড়িতে ফিরলাম। খোঁজ পেলাম সরকার থেকে উল বোনার ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। সেখানেই এক শিক্ষিকা একটি সংস্থায় সেলাই শেখানোর ব্যবস্থা করে দিলেন, ’’ আনন্দের দিনে বারেবারেই প্রীতিকণার কথায় ঘুরেফিরে আসছে ফেলে আসা মলিন দিনের কথা।
বিভিন্ন মিউজ়িয়ামে ঘুরে ছবি দেখে যেমন সেলাই শিখেছেন, তেমনই রাস্তাঘাটে বা বাসে কারও শাড়ি বা ওড়নার পাড় পছন্দ হলে মনে করে রাখতেন প্রীতিকণা। সেটাই সুচ সুতোয় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। তাঁর কাজের বিশেষত্ব হল কুইল্টিং, বাংলায় যাকে বলে ভুঁইফোঁড়। এই টেকনিকে প্রথমে পেন্সিলে আউটলাইন এঁকে ভিতরের অংশটুকুতে সেলাই করে ডিজ়াইন ফুটিয়ে তোলা হয়। কিন্তু এর ফলে আশপাশের অংশের কাপড় উঁচু-নিচু হয়ে থাকে, তাকে সমান করার জন্য ফাঁকা অংশে কুইল্টিং করা হয়। ‘‘আগে তো পুরনো শাড়ি দিয়ে কাঁথা বানানো হত, তাই কুইল্টিং করা হত তাকে টেকসই করার জন্য। এখন আমরা নতুন কাপড়ে করি, কিন্তু ওই এফেক্ট রাখার জন্য কুইল্টিং করা হয়। একটা টি কোজ়ি বানিয়েছিলাম কুইল্টিং করে। আমাদের কাজ মূলত মলমল, মসলিন, তসর ও খাদি সিল্কের উপরে। গত বছর অবধিও মিলের কাপড়ে সেলাই করেছিলাম, কিন্তু এখন তাঁতিদের কাছ থেকে সরাসরি কিনে কাজ শুরু করেছি। তবে দীর্ঘ দিন ধরে জাপানি একটি এনজিও-র কাজ করি, যেটা জর্জেটের উপরে করা হয়। এই কাজটা এখন আমার ছোট মেয়ে দেখে,’’ বললেন প্রীতিকণা।ঙে
এখন মায়ের সঙ্গী তাঁর মেয়েরা। প্রীতিকণার স্বপ্নকে সফল করার চেষ্টা করছেন বড় মেয়ে মহুয়া। প্রীতিকণার ইচ্ছে ছিল ব্যবসা করার, কিন্তু মূলধন আর লোকবলের অভাবে তা করে উঠতে পারেননি। ‘‘নব্বই সালে আটশো টাকা বেতনে কাজ শুরু করেছিলাম, ২০০১-এ যখন ছাড়লাম, পেতাম বারোশো টাকা। তবে জাপান থেকে কিছু কাজ আসার পর থেকে ওরা মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে দিত। বিভিন্ন মিউজ়িয়ামে কয়েকশো বছরের পুরনো যে সব কাজ রয়েছে, সেগুলো নতুন করে বানিয়েছি। কাজের জন্য ডিস্ট্রিক্ট থেকে পুরস্কার পেলাম, স্টেট অ্যাওয়ার্ড, জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছি। কিন্তু সেখানেও কারা বানিয়েছেন তাঁদের নাম সেলাই করে খোদাই করা আছে। অথচ সেই কাজ আমি করে গেলেও আমার নাম কেউ জানে না। শুধু মনে হত, টাকা পাচ্ছি সংসারটা চলছে, এটাই যথেষ্ট,’’ বিষণ্ণ গলায় বলেন পদ্মশ্রী প্রাপক ষাটোর্দ্ধ শিল্পী।
মায়ের এই অপ্রাপ্তি, বেদনার সাক্ষী মহুয়া। তাই সেলাইয়ে দক্ষতা এবং এনআইএফটি থেকে পাশ করা সত্ত্বেও মায়ের কাজ করতে চাননি তিনি। তবে তিনি হাল না ধরলে যে মায়ের কাজটা হারিয়ে যাবে। তাই নিজের এবং এক বন্ধুর প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন একটি সংস্থা। ‘‘বাড়ি বন্দক রেখে মা আমাকে পড়িয়েছিল। মা বলত, তুই এত ভাল কাজ করিস, আমার কাজের ধারাটা বাঁচিয়ে রাখিস। মায়ের ডিজ়াইন, আমার ভাবনা— এ ভাবেই কাজ শুরু হল। ক্রাফটে বদল না এনে প্রডাক্টের ব্যবহারিক দিক বাড়ানোর চেষ্টা করলাম। এই কনসেপ্টে ফ্যাশন শো-ও করেছি। মায়ের সবচেয়ে বড় দুঃখ পরিচিতিটুকু না পাওয়া। তাই আমাদের সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের প্রত্যেকটা কাজে কে কী করেছে সেটা লেখা থাকে। একটা জিনিস তৈরি হতে অন্তত বছর দুয়েক সময় লাগে। অনেক বড় সংস্থা আমাদের থেকে জিনিস কিনতে চেয়েছে কিন্তু বিক্রি করা যায়নি, কারণ তারা এতটা সময় দিতে পারবে না এবং বেশি সংখ্যক চায়, যেটা বানানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়,’’ নিজের প্রচেষ্টার কথা বললেন মহুয়া। তাঁরই উদ্যোগে যোগাযোগ হয় জর্জ ওয়াশিংটন ইউনির্ভাসিটি মিউজ়িয়ামের সঙ্গে। ওখানকার আড়াইশো বছরের একটি পুরনো পিস নতুন ভাবে বানিয়ে দেন তাঁরা। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারত সরকারের তরফ থেকে একটি ট্রাভেল এগজ়িবিশনে নির্বাচিত হয় মহুয়ার একটি আঁকা, যাতে সেলাইয়ের মাধ্যমে ধরা হয়েছে বাংলার ইতিহাস। সেই শিল্পকর্মটি এখন রয়েছে প্যারিসে, এর পর যাবে অস্ট্রেলিয়ায়।
এ ভাবেই প্রীতিকণার অপ্রাপ্তিকে সম্মানে বদলে দিতে চান মহুয়া। আর প্রীতিকণা আলো দেখান বহু নারীকে, জীবনযুদ্ধে ভেঙে না পড়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy