Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Novel Coronavisus

করোনার টিকা এখনই পাওয়ার ভাবনা অবান্তর! কিন্তু কেন?

এই করোনাভাইরাস আগে আরও দুটো মহামারি ঘটিয়েছিল— চিনে শুরু হওয়া সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম বা সার্স এবং সৌদি আরবে শুরু হওয়া মিল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম বা মার্স।

বিশ্ব জুড়েই কোভিড-১৯-এর ভ্যাক্সিন নিয়ে চলছে পরীক্ষা। ছবি— পিটিআই।

বিশ্ব জুড়েই কোভিড-১৯-এর ভ্যাক্সিন নিয়ে চলছে পরীক্ষা। ছবি— পিটিআই।

সুবর্ণ গোস্বামী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২০ ১৫:৫১
Share: Save:

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড ১৯-কে মহামারী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সকলের আগ্রহ বাড়ছে ভ্যাকসিন বা টিকার প্রতি। কারণ, একটা ভ্যাকসিন বা টিকা মানুষকে এই ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে রোগের হাত থেকে বাঁচাতে পারে।

প্রায় ৩৫টি সংস্থা এবং শিক্ষা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই ধরনের টিকা তৈরির জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে। এর মধ্যে এমন অন্তত চারটি টিকা রয়েছে যেগুলো ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মনুষ্যেতর প্রাণীর উপর প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি বস্টনের বায়োটেক ফার্ম মডার্না-র প্রডাক্ট। মানব শরীরে এটির ট্রায়াল শুরু হয়েছে।

এত তাড়াতাড়ি এ কাজ করা সম্ভব হচ্ছে, তার কারণ জানুয়ারির প্রথম দিকেই চিন এই ভাইরাসের জেনেটিক কোড বিশ্লেষণ করে তা সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছিল। এই ভাইরাসের বৃদ্ধি কী ভাবে ঘটে, এটি কী ভাবে মানবকোষকে আক্রমণ করে এবং মানুষকে অসুস্থ করে তোলে তা অধ্যয়ন করার সুযোগ করে দেয় তামাম বিশ্বের গবেষণাগারগুলোকে।

আরও পড়ুন: ঢোকা-বেরনো বন্ধ, খুলবে না বাজারও, রাজ্যের সম্ভাব্য হটস্পট এলাকাগুলি

তবে এত দ্রুত টিকা তৈরির কাজ শুরু করতে পারার আরও একটি কারণ রয়েছে। সার্স এবং মার্স-পরবর্তী কালে করোনাভাইরাসের প্রোটোটাইপ নিয়ে আগেই গবেষণা শুরু করে দিয়েছিলেন ভ্যাকসিনোলজিস্টরা।

এই করোনাভাইরাস আগে আরও দুটো মহামারি ঘটিয়েছিল— চিনে শুরু হওয়া সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম বা সার্স এবং সৌদি আরবে শুরু হওয়া মিল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম বা মার্স। উভয়ক্ষেত্রেই ভ্যাকসিনগুলির কাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু পরে তা ঠান্ডাঘরে চলে যায়। মেরিল্যান্ডের নোভাভ্যাক্স নামে একটি সংস্থা এখন সার্স-সিওভি-২-এর জন্য এই ভ্যাকসিনগুলি পুনরায় গুদাম থেকে বের করে হিউম্যান ট্রায়ালের চেষ্টা করছে। অন্য দিকে মডার্না কোম্পানি মেরিল্যান্ডের বেথেসডায় ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের সহযোগিতায় তৈরি মার্স ভ্যাকসিনগুলোর হিউম্যান ট্রায়ালে উদ্যোগী হচ্ছে।

পরীক্ষার জন্য দরকার পর্য়াপ্ত কিট। — এএফপি।

সমস্ত ভ্যাকসিন একই নীতি মেনে কাজ করে। জীবাণুর কিছু অংশ বা পুরো জীবাণুকেই সাধারণত ইনজেকশন আকারে কম ডোজে শরীরে ঢোকানো হয় যাতে সেগুলো ব্যবহার করে আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। এই অ্যান্টিবডি তৈরির প্রক্রিয়াটি আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম তার স্মৃতিতে ধরে রাখে, যাতে পরে ওই জীবাণুর সত্যিকারের সংক্রমণ হলে শরীর আবার দ্রুত অনেক অ্যান্টিবডি তৈরি করে নিতে পারে।

আরও পড়ুন: নিজামউদ্দিন থেকে ফিরে করোনা, গলার নলি কেটে হাসপাতালেই আত্মঘাতী যুবক

সাধারণ ভাবে, জ্যান্ত ভাইরাসকে তাপে বা অন্য ভাবে দুর্বল করে অথবা মৃত ভাইরাসের অংশ বা পুরোটাই ভ্যাকসিনের মাধ্যমে শরীরে ঢোকানো হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে টিকা তৈরির কিছু বাস্তব সমস্যা রয়েছে। জ্যান্ত দুর্বলীকৃত ভাইরাস ভ্যাকসিনের মাধ্যমে শরীরে ঢোকার পর পুনরায় শক্তি অর্জন করে স্বমূর্তি ধারণ করতে পারে। তখন ভ্যাকসিন মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার বদলে শরীরে রোগ তৈরি করার ক্ষমতা ফিরে পেতে পারে। অন্য দিকে, মৃত ভাইরাস দিয়ে তৈরি ভ্যাকসিন আবার কম ডোজে ভাল কাজ করে না, তা ছাড়া ঠিকঠাক সুরক্ষা পেতে গেলে এ ধরনের টিকা বার বার বুস্টার ডোজে দিয়ে যেতে হয়।

কোভিড ১৯-এর কিছু ভ্যাকসিন প্রকল্প এই প্রথাগত পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করছে। আবার অনেকেই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। যেমন, নোভাভ্যাক্স ‘রিকম্বিনেন্ট’ প্রযুক্তিতে ভ্যাকসিন তৈরি করছে। সার্স-সিওভি-২ ভাইরাসের পিঠের প্রোটিন স্পাইকগুলোর জেনেটিক কোড বের করে তাকে ব্যাক্টিরিয়াম বা ইস্টের জিনোমের সঙ্গে সেঁটে দেওয়া হয় যাতে ইস্ট বা ব্যাক্টিরিয়াম ওই ভাইরাস প্রোটিনকে ভাল ভাবে নেড়েচেড়ে নিস্তেজ করে দিতে পারে। এমনকি, আরও নতুন নতুন পদ্ধতিতেও টিকা তৈরির চেষ্টা চলছে। যেমন, প্রোটিনকে বাইপাস করে শুধুমাত্র জিনগত নির্দেশকে ব্যবহার করেই ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চলছে। মডার্না এবং কিওরভ্যাক নামে বস্টনের আর একটি প্রতিষ্ঠান এখন এই নতুন পদ্ধতিগুলোই অনুসরণ করছে, মেসেঞ্জার আরএনএ থেকে কোভিড ১৯-এর ভ্যাকসিন তৈরি করছে।

আরও পড়ুন: দেশ: ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা এই প্রথম হাজার ছাড়াল, মৃত বেড়ে ২৩৯

সেপি’র অর্থানুকূল্যে চলা মোট চারটি কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন প্রকল্পই এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে কাজ করছে। গত সপ্তাহেই সেপি নোভাভ্যাক্স এবং অক্সফোর্ডের এক ইউনিভার্সিটির যৌথ ভ্যাকসিন প্রকল্পের জন্য সাড়ে চার মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থবরাদ্দ করেছে। কিন্তু তার পরেও হ্যাচেট বলেছেন, ‘‘ভ্যাকসিনের বিকাশের পথে আমাদের অভিজ্ঞতা হল, আপনি কোথায় হোঁচট খাবেন তা আগাম অনুমান করতে পারবেন না।’’ তাই সব রকম পদ্ধতিতেই চেষ্টা চলছে সমান্তরাল ভাবে।

যে কোনও টিকা বাজারজাত করার অনুমোদন পেতে গেলে হিউম্যান ক্লিনিকাল ট্রায়াল হল একটা অপরিহার্য পূর্বশর্ত। এই ট্রায়াল সাধারণত তিনটি পর্যায়ে ঘটে। প্রথমে অল্পসংখ্যক স্বাস্থ্যবান স্বেচ্ছাসেবকের উপর টিকা প্রয়োগ করে দেখা হয় ভ্যাকসিন তাদের কতটা সুরক্ষা দেয় এবং তাদের উপর ভ্যাকসিনের কোনও বিরূপ প্রভাব পড়ছে কি না। দ্বিতীয় ধাপে সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত কোনও দেশের কয়েকশো মানুষের উপর প্রয়োগ করে দেখা হয় ভ্যাকসিনটি কতটা কার্যকরী। তৃতীয় ধাপে কয়েক হাজার লোকের ক্ষেত্রেও একই ভাবে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরখ করা হয়। পরীক্ষামূলক ভাবে কোনও ভ্যাকসিন এই পর্যায়গুলির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় অনেক স্বেচ্ছাসেবক মাঝপথে পিঠটান দেন, ফলে আরও দেরি হয়। ওয়াশিংটনের সেবিন ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট, যারা ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন বাজারে এনেছিল, তারা আশঙ্কা করছে, এই ভ্যাকসিন হিউম্যান ট্রায়ালের মাঝপথে অনেকেই সরে দাঁড়াতে পারেন।

এর অবশ্য যথেষ্ট কারণও রয়েছে। হয় টিকাগুলো নিরাপদ নয় বা সে রকম কার্যকর নয়, বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে দু’টিই সত্যি। এই ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করা অপরিহার্য, এ জন্যই ক্লিনিকাল ট্রায়াল এড়িয়ে বা তাড়াহুড়ো করে বাজারজাত করা নিষেধ। যদি নিয়ামকেরা আগে অনুরূপ পণ্য অনুমোদন করে থাকেন, তবে অনুমোদনের গতি বাড়ানো যেতে পারে বড়জোর। উদাহরণস্বরূপ, বার্ষিক ফ্লু ভ্যাকসিনটি হল একটি পরীক্ষিত ভ্যাকসিন, যেখানে প্রতি বছর কেবল দু’-একটি মডিউল আপডেট করলেই হয়। বিপরীতে, সার্স-সিওভি-২ একটা নতুন জীবাণু এবং এর ভ্যাকসিন তৈরিতে ব্যবহৃত অনেকগুলি প্রযুক্তিই একেবার আনকোরা নতুন এবং অপরীক্ষিত। আরএনএ বা ডিএনএ, কোনও জেনেটিক উপাদান থেকেই তৈরি কোনও ভ্যাকসিন আজ অবধি অনুমোদিত হয়নি। সুতরাং কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনগুলোকে একেবারে নতুন ভ্যাকসিন হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনও শর্টকাট রাস্তা নিলে হিতে বিপরীত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৬০-এর দশকে শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ সৃষ্টিকারী সিনসিটিয়াল ভাইরাসের বিরুদ্ধে একটা ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছিল। সিনসিটিয়াল ভাইরাস একটা সাধারণ ভাইরাস যা শিশুদের কমন কোল্ডের জন্য দায়ী। ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলিতে দেখা গেল ওই ভ্যাকসিনটি শিশুদের মধ্যে উপসর্গ আরও বাড়িয়ে তুলছে। ফলে ভ্যাকসিনটি বাতিল করা হল। প্রারম্ভিক পরীক্ষামূলক সার্স ভ্যাকসিন দেওয়া প্রাণীদের মধ্যেও একই রকম ঘটনা ঘটতে দেখা গিয়েছে। তখন সমস্যা মেটাতে কিছু সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল ঠিকই, তবে এখন যেহেতু ওই ভ্যাকসিনগুলো সার্স-সিওভি-২-এর জন্য পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে, সেহেতু ঝুঁকি এড়াতে কঠোর সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োগ করা দরকার।

এই সব কারণে একটা ভ্যাকসিনের সমস্ত দিক খতিয়ে দেখে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনের জন্য সাধারণত এক দশক বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। গত ২ মার্চ হোয়াইট হাউসের এক সভায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভ্রান্তিকর দাবি করেছিলেন একটি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থার উপর। তিনি চাপ দিচ্ছিলেন নভেম্বরে মার্কিন নির্বাচনের আগেই ভ্যাকসিন বাজারে আনতে, যা একটা অবান্তর দাবি, অসম্ভব সময়সীমা। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ তথা অধ্যাপক অ্যানেলিজ ওয়াইল্ডার স্মিথ বলেছেন, ‘‘বেশির ভাগ ভ্যাকসিনোলজিস্টের মতো, আমিও মনে করি না যে এই টিকাটি ১৮ মাসের আগে প্রস্তুত হয়ে যাবে। এই সময়সীমাও বাস্তবে যথেষ্ট কম।’’

আরও একটা বড় সমস্যা রয়েছে। কোনও একটা ভ্যাকসিন অনুমোদিত হলেই তার বিপুল চাহিদা তৈরি হবে এবং কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে সামিল বেশির ভাগ সংস্থারই অত বেশি উৎপাদন ক্ষমতা নেই। ব্যবসার দিক থেকে ভ্যাকসিন তৈরিতে বিনিয়োগ এমনিতেই যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ খুব কম ভ্যাকসিন শেষ অবধি অনুমোদন পায়। বিনিয়োগকারী জানেনও না যে তাঁর পণ্যটি বাণিজ্যিক ভাবে সফল হবে কি না। সেপি এবং অনুরূপ সংস্থাগুলি ঝুঁকি নিয়েই দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। সেপি সমান্তরালভাবে কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন তৈরি এবং উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করেছে।

এক বার কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন অনুমোদিত হয়ে গেলে আরও একটা চ্যালেঞ্জ সামনে আসবে, তা হল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। ভ্যাকসিনকে অগ্রাধিকার দেবে যতটুকু সম্ভব। তবে মহামারিতে দেশগুলিকে ওষুধের জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। ক্ষমতাধর ও বিত্তশালী দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য আগেভাগেই ভ্যাকসিনের সত্ত্ব কিনে নিতে চাইবে, বঞ্চিত হবে তৃতীয় বিশ্ব।

একটা কার্যকরী ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত মহামারী নিয়ন্ত্রণে আমাদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্যগুলো পালন করে যেতে হবে— কাফ এটিকেট, হাত ধোয়া এবং সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং।

(লেখক জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক)

অন্য বিষয়গুলি:

Research Vaccine coronavirus Novel Coronavisus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy