Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Education

অনিশ্চয়তার শিক্ষাবর্ষ

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলির অনিশ্চয়তা তো রয়েছেই। তবে পড়ুয়াদের বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে অতিমারির কারণে। আশাভঙ্গ হলেও শক্ত থাকাই এ কঠিন সময়ের দাবিভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ ও প্রবণতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে গত কয়েক দশকে।

মধুমন্তী পৈত চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০২:৫১
Share: Save:

আজ শিক্ষক দিবস। শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার দিন। ই-স্কুল, ই-লার্নিং এর মতো পরিভাষা ও ব্যবস্থাপনা এই সম্পর্কে কতটা বদল এনেছে, তা সমাজতাত্ত্বিকদের আগামী দিনের গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষকেরা একটি বিষয়ে সহমত হবেন যে, অতিমারির এই বছর শিক্ষাব্যবস্থায় একটি জরুরি অবস্থার সৃষ্টি করেছে। বিশেষত, ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এক দিকে জনসংখ্যার চাপ, অন্য দিকে উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব শিক্ষাক্ষেত্রে কতকগুলি জরুরি প্রশ্ন তুলেছে। শুধুমাত্র সমাজের মুষ্টিমেয় শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা ই-লার্নিংয়ের সুযোগ পাচ্ছে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি দোলাচল, সময়সূচির পরিবর্তন ছাত্রসমাজকে ঠেলে দিয়েছে এক দিশাহীন অনিশ্চয়তার দিকে।

ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ ও প্রবণতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে গত কয়েক দশকে। অতিমারির কারণে সেই স্বপ্নও হোঁচট খেয়েছে। কারণ বিদেশে পড়তে যাওয়ার সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িত আর্থিক সঙ্গতির প্রশ্নটি। এ ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভিসা পাওয়া, ট্রাভেল করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন মেনে পছন্দের কোর্স পড়ার সুযোগ... রয়েছে এই বিষয়গুলিও। সব মিলিয়ে, উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে ছাত্রদের মানসিক স্বাস্থ্য প্রশ্নের মুখে।

হাইব্রিড বা ব্লেন্ডেড লার্নিং: অতিমারি দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিধানে যোগ করেছে নতুন পরিভাষা, ‘হাইব্রিড লার্নিং’ অর্থাৎ ক্লাসরুম লার্নিং এবং ই-লার্নিংয়ের যৌথ আয়োজন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি, আইআইএম... এই মডেলেই চলছে।

দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকায় পরিবর্তন

এ বছর যে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস টুয়েলভ পাশ করেছে, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা বেড়েছে। কারণ শহর বা দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার প্রবণতা এদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। দেশের বিভিন্ন নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলি গত কয়েক বছরে অনলাইনে পরিচালিত হয়। তবে এ বছর বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের লিখিত প্রবেশিকা পরীক্ষা বাতিল করেছে। এ বছর নামী স্কুল থেকে আইএসসি পাশ করেছেন প্রজ্ঞা ভট্টাচার্য। স্নাতকের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলেন মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস, পুণের ফার্গুসন কলেজ এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রজ্ঞা জানালেন, টাটা ইনস্টিটিউটের প্রবেশিকায় একটি অবজেক্টিভ পরীক্ষা হয় আর একটি শর্ট নোটস লেখার পরীক্ষা। অবজেক্টিভ পরীক্ষাটি অনলাইন হয়েছে। তবে শর্ট নোটস বিভাগটি এ বার বাতিল করা হয়েছে। ফার্গুসন কলেজের একটি ইনটিগ্রেটেড কোর্সের জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষা হত। তবে এ বছর সেটি বোর্ড পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের নিরিখে হয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যে কলেজগুলিতে নম্বরভিত্তিক ভর্তি হত, কলেজে অ্যাপ্লাইয়ের পর দিনই দিল্লি গিয়ে সংশ্লিষ্ট কলেজে ফর্ম ও চালান জমা করতে হত। এ বারে সবটাই অনলাইন। আবার বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিষয়গুলিতে লিখিত পরীক্ষা হয়, তা এ বারও বহাল। অন্য সেন্টারের মতো কলকাতার সল্টলেকের একটি কেন্দ্রে পরীক্ষা হয়েছে। বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স-এর (আইআইএসসি) ইঞ্জিনিয়ারিং ও সায়েন্সের বিভিন্ন শাখার প্রবেশিকা অনলাইন পরীক্ষার মাধ্যমেই হয়। তাই আলাদা করে অসুবিধে হয়নি।

মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়

আমেরিকান সেন্টার কলকাতা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রদের মধ্যে ১৮ শতাংশ ভারতীয়। গত বছর ভারতীয় ছাত্রসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২.৯ শতাংশ। তবে করোনার জন্য আমেরিকার পরিস্থিতি খুবই সঙ্গিন। ছাত্রদের মধ্যেও আমেরিকায় পড়তে যাওয়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

কানাডার ম্যানিটোবা ইনস্টিটিউট অব ট্রেডস অ্যান্ড টেকনোলজিতে এমবিএ পড়তে ‘ফল সিমেস্টারে’ যাওয়ার কথা ছিল রক্তিম পালের। কিন্তু তিনি যাওয়া বাতিল করেছেন। রক্তিমের কথায়, ‘‘কানাডায় পড়তে যাওয়ার প্রথম উদ্দেশ্য ক্লাসরুম লার্নিং। ই-লার্নিং তো এখান থেকেও করতে পারি। আর এদের হাইব্রিড মডেল নয়, পুরোটাই ই-লার্নিং। তাই এত টাকাপয়সা খরচ করে যাওয়ার মানে নেই। আমার সিকিয়োরড চাকরিও রয়েছে।’’ আগামী বছরে এই কোর্সে জয়েন করতে হলে রক্তিমকে নতুন করে অ্যাপ্লাই করতে হবে।

ক্যানসার বায়োলজি নিয়ে পোস্ট-ডক্টরেট করতে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস সাউথওয়েস্টার্ন মেডিক্যাল সেন্টারে যাচ্ছেন সৌরভ ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাজ গবেষণার, সিমেস্টারভিত্তিক নয়। তাই যেতে অসুবিধে নেই। আমার জে-ওয়ান ভিসাও হয়ে গিয়েছে।’’

ভিসা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়াকড়ির ফলে মাঝে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছিলেন আন্তর্জাতিক ছাত্ররা। আমেরিকান সেন্টার কলকাতার ডিরেক্টর মণিকা শাইয়ের কথায়, ‘‘আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার জন্য আগ্রহী ভারতীয় ছাত্রদের এডুকেশন ইউএসএ অ্যাডভাইসমেন্ট-এর যে কোনও সেন্টারে যোগাযোগ করতে আহ্বান জানাচ্ছি। কোর্সের খুঁটিনাটি সম্পর্কে বিনামূল্যে ঠিক তথ্য পাবেন।’’

ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়

আমেরিকার পরেই ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে ব্রিটেনে পড়তে যাওয়ার পরিসংখ্যান উল্লেখযোগ্য। এ বছর ‘ফল সিমেস্টারে’ ইউনিভার্সিটি অব ম্যাঞ্চেস্টারে মাস্টার্স ইন ম্যানেজমেন্ট কোর্সে যোগ দেওয়ার কথা ছিল ঋতায়ন ঘোষের। কিন্তু তিনিও এই সিমেস্টারে যাচ্ছেন না। ঋতায়ন জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে তিনটি বিকল্প দেওয়া হয়েছিল। প্রথমত, হোম-কান্ট্রি থেকে প্রথম সিমেস্টারের কিছুটা করে, পরে সশরীর পৌঁছনো। দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় সিমেস্টার শুরু হওয়ার আগে নিশ্চিত করা যে, সশরীর এই কোর্সে জয়েন করবে ছাত্র। তৃতীয়ত, আগামী বছরে অ্যাডমিশন পিছিয়ে দেওয়া। তৃতীয় বিকল্পই নিয়েছেন ঋতায়ন।

ব্রিটেনে ‘ফল সিমেস্টারে’ যাওয়া প্রসঙ্গে ড. দেবাঞ্জন চক্রবর্তী (ডিরেক্টর ব্রিটিশ কাউন্সিল, পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারত) বলেছেন, ‘‘ব্রিটেন সরকার এবং উচ্চশিক্ষা দফতর চেষ্টা করছে, যাতে আন্তর্জাতিক ছাত্ররা অনলাইন ক্লাস করতে ও সুবিধেমতো ক্যাম্পাসে পৌঁছতে পারে।’’

ভিসার সুবিধে

ব্রিটেন সরকার আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য ‘গ্র্যাজুয়েট রুট পোস্ট-স্টাডি ওয়র্ক ভিসা’ চালু করেছে। যে ছাত্ররা ২০২১-এর সামারে ব্রিটেনের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পাবেন, তাঁরা কোর্স শেষ হওয়ার পরেও দু’বছর পর্যন্ত ব্রিটেনে থাকতে পারবেন (যে কোনও ধরনের কর্মসংস্থানের ভিত্তিতেই)। করোনা পরিস্থিতির কারণে কোনও ছাত্র সময়ের মধ্যে ডিগ্রি শেষ করতে না পারলে, তিনিও এই ভিসার জন্য যোগ্য হবেন। আগামী বছর ৬ এপ্রিলের মধ্যে ব্রিটেনে পৌঁছলে এই ভিসার জন্য আবেদন করা যাবে। সাধারণত ভিসা পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যেই ব্রিটেনে পৌঁছতে হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা ৯০ দিন করা হয়েছে।

বিশ্বের অন্য প্রান্তে

করোনা মোকাবিলায় জার্মানি অন্য অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। ২০১৮ সাল থেকে জার্মানিতে রয়েছেন পৌলমী বন্দ্যোপাধ্যায়। কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার ডিগ্রি করছেন টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব কাইজ়ারসলটার্ন থেকে। বললেন, ‘‘আমাদের ক্লাস সব অনলাইনে হচ্ছে। কিন্তু আমার ভাইভা ছিল কয়েক দিন আগে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা দিতে ক্যাম্পাসে যেতে হয়েছে।’’ ফ্রান্সের ইনসিয়াড-সহ কয়েকটি বিজ়নেস স্কুলের সেশনও পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রাশিয়া, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় ছাত্রদের উপস্থিতি ইদানীং চোখে পড়ার মতো। এই বিষয়ে আলোকপাত করলেন অশোক হল গার্লস হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুলের প্রাক্তন ভাইস-প্রিন্সিপাল এবং বর্তমানে একটি এডুকেশন কাউন্সেলিং সেন্টারের চিফ লার্নিং অফিসার অব্জা অধিকারী। তিনি জানালেন, রাশিয়ার বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় অন্য বছরের মতোই আন্তর্জাতিক ছাত্রদের ভর্তি নিচ্ছে। সাধারণত নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এখানে ক্লাস শুরু হয়। এখনও অবধি অনলাইন ক্লাসের ঘোষণা করা হয়নি। তবে পরিস্থিতি বুঝে সেই সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য এ বছর অস্ট্রেলিয়ার সরকার ‘অফ-শোর ভিসা’ চালু করেছে, যাতে হোম কান্ট্রি থেকেই ক্লাস করা যায়। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। তবে বিজ্ঞানের কয়েকটি শাখায় ল্যাব-ওয়র্কের জন্য বিশেষ অনুমতি নিয়ে ক্যাম্পাসে ক্লাস হচ্ছে।

সিঙ্গাপুরের কোভিড পরিস্থিতি বিপজ্জনক না হওয়ায় এখানে অন-ক্যাম্পাস ক্লাস হচ্ছে। তবে জুন, ২০২০ থেকে জানুয়ারি, ২০২১ পর্যন্ত চারটি ভাগে ক্লাসের আয়োজন করা হয়েছে। ক্যাম্পাসে যোগদানের জন্য আন্তর্জাতিক ছাত্রদের হোম কান্ট্রি এবং সিঙ্গাপুরের শিক্ষামন্ত্রকের কাছ থেকে অনুমতিপত্র লাগবে।

ছাত্রদের মানসিক স্বাস্থ্য

২০-২৯ বছর বয়সি ১২ হাজার পড়ুয়া ও চাকুরিরতদের নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজ়েশন অ্যান্ড পার্টনারস। তাতে দেখা গিয়েছে, কেরিয়ার ও উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে প্রতি ছ’জনের মধ্যে একজনের ডিপ্রেশন হচ্ছে। স্ট্রেস, দুশ্চিন্তার হার বেড়েছে নজরকাড়া ভাবে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘অভিভাবকেরা বন্ধুর মতো মেশার কথা মুখে বলেন, কিন্তু সেটা হাতেনাতে করে দেখাতে হবে। ওদের এই সাপোর্ট এখন খুব জরুরি। এই মুহূর্তে ধৈর্য ধরতে হবে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। অনেক দিনের স্বপ্ন ভাঙলে মন খারাপ হবে। তবে সেটা কাটিয়ে উঠতে হবে।’’

অতিমারিকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে এগোতে হবে ছাত্রদের। কারণ এই কঠিন সময় পেরোনোর প্রস্তুতিই আগামীর সব পরীক্ষা উতরোনোর সিঁড়ি হয়ে উঠতে পারে।

অন্য বিষয়গুলি:

Education Coronavirus in India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy