মাঠে গেলেই মাটি থেকে ছোট কাঠি তুলে দাঁত খোঁচানো প্রায় অভ্যেস করে ফেলেছিলেন কর্নাটকের চান্নাপাটনা তালুকের প্রবীণ বাসিন্দা দোদ্দাথায়াম্মা। কিছু দিন পরে তাঁর বাড়ির লোক দেখেন বৃদ্ধার অহরহ খিঁচ ধরছে আর ঘাড় শক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর তিনি কিছু গিলতেই পারছিলেন না। পরিবারের লোক তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা জানান, দোদ্দাথায়াম্মা টিটেনাস-এ আক্রান্ত হয়েছেন। খবরটি ২০১৮ সালের। একটি সর্বভারতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে সেটি প্রকাশিত হয়েছিল। শুধু দোদ্দাথায়াম্মা নন, সেই সময় কর্নাটকে টিটেনাসের বেশ কয়েকটি কেসের খবর মেলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগেকার দিনে বাড়িতে সদ্যোজাত সন্তান জন্মানোর পরে অনেক জায়গাতেই শিশুর আম্বলিকাল কর্ড কাটার সময়ে সেখানে গোবর ও মাটির প্রলেপ লাগানো হত। তা থেকে টিটেনাস হয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুটি মারা যেত। এই রীতি এখন আর চালু নেই। তা ছাড়া, রোগটির প্রকোপও এখন সে ভাবে দেখা বা জানা না গেলেও, টিটেনাস অবহেলা করা একেবারেই উচিত নয় বলে জানালেন জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীরকুমার মণ্ডল।
রোগটা কী?
ব্যাকটিরিয়াম ক্লস্ট্রিডিয়াম টিটেনি-র কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। এটি এক ধরনের অ্যানেরোবিক ব্যাকটিরিয়া, অর্থাৎ অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে এর বৃদ্ধি বেশি হয়। সাধারণত নোংরা জায়গায়, বিষ্ঠায়, মাটিতে এই ব্যাকটিরিয়াম পাওয়া যায়। অনেক সময়েই মানুষের ধারণা হয় যে লোহায় কেটে গেলেই কারও টিটেনাস হতে পারে। সব ক্ষেত্রেই যে টিটেনাস হবে তা নয়। ডা. মণ্ডলের মতে, কারও যদি কোথাও কোনও ক্ষত থাকে, তিনি সেটা ঠিকমতো পরিষ্কার না করেন এবং কোনও নোংরা জায়গা থেকে ক্ষতটি সংক্রমিত হয়, তা হলে সেই ব্যক্তির টিটেনাস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
রোগের লক্ষণ
শরীরে প্রবেশ করার পরে টিটেনাস ব্যাকটিরিয়া টক্সিন তৈরি করে মানুষের শরীরে স্নায়ুর সংযোগস্থল বা জাংশনগুলোকে আক্রমণ করে। তার ফলে ধীরে ধীরে শরীরে মাংসপেশিগুলি শক্ত হতে শুরু করে। ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, চোয়াল আটকে যায়। বাংলায় এটি ‘ধনুষটঙ্কার’ নামেও পরিচিত। মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার জানালেন, বুক কিংবা গলা বা ঘাড়ের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিকমতো নিতে না পারায় এক সময় মানুষ দম আটকে মারা যান টিটেনাসে। তবে এমনটা ঘটে রোগের অন্তিম পর্যায়ে। প্রাথমিক স্তরে অন্যান্য ব্যাকটিরিয়াল সংক্রমণের মতোই এ ক্ষেত্রেও আক্রান্ত ব্যক্তির হাল্কা জ্বর, গায়ে-হাতে-পায়ে, বিশেষত মাংসপেশিতে ব্যথা হতে পারে। টিটেনাসে অনেক সময় রক্তচাপ খুব বেড়ে বা কমে যায় বলেও জানালেন ডা. মণ্ডল।
পরীক্ষা ও চিকিৎসা
সাধারণত রোগের লক্ষণ দেখেই চিকিৎসকেরা চিকিৎসা শুরু করে দেন। এ ছাড়াও তাঁরা দেখেন ব্যক্তির কোথাও কোনও পুরনো ক্ষত রয়েছে কি না কিংবা তিনি আগে ঠিকমতো টিটেনাসের টিকা নিয়েছেন কি না। টিটেনাসে মৃত্যুর হার বেশি হলেও ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা বেশি থাকে। চিকিৎসা অনেকটাই নির্ভর করে রোগীর পরিস্থিতির উপর। সাধারণত ব্যাকটিরিয়া মারার জন্য আইভি-র মতো অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রোগীর জ্বর কমানোর ওষুধ দিতে হয়। আর যেহেতু এ সময়ে রোগীর খিঁচ ধরে তাই অ্যান্টিস্প্যাজ়মোটিক দিতে হয় মাংসপেশির খিঁচ কমাতে এবং সিডেটিভ দিয়ে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় শারীরিক কষ্টের কারণে হওয়া উদ্বেগ কমাতে। আর যাঁদের খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যান তাঁদের অক্সিজেন সাপোর্ট কিংবা ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। এ ছাড়া শরীরে টিটেনাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে হিউম্যান টিটেনাস ইমিউনোগ্লোবিউলিন (টিআইজি) ইঞ্জেকশন তো দিতেই হয় বলে জানালেন ডা. মণ্ডল।
আবার বড় দুর্ঘটনায় গভীর ক্ষত হলে (কোথাও হাড় বেরিয়ে গিয়েছে বা ভিতরের মাংস দেখা যাচ্ছে) বা যাঁদের ক্যানসার বা এইচআইভি (ইমিউনোকম্প্রোমাইজ়ড) রোগীদের টিটেনাসের সময়ে সরাসরি টিটেনাস অ্যান্টিবডি শরীরে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দিয়ে দেওয়া হয়।
শিশুদের ডোজ়
ডা. তালুকদারদের মতে, সাধারণত জন্মের পরেই শিশুদের টিটেনাসের তিনটে ডোজ় দেওয়া হয়, তার পর দ্বিতীয় বছরে একটা, চার থেকে সাত বছর একটা এবং দশ বছরে একটা ডোজ় দেওয়া হয়। পুরোটাই চলে সরকারি নির্দেশানুযায়ী। এর পরে বলা হয় প্রতি দশ বছরে একটা করে বুস্টার ডোজ় নিতে। অনেক ক্ষেত্রেই ছোটবেলায় টিটেনাসের টিকা একা নয়, আরও কয়েকটি টিকা মিলে দেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েদেরও সন্তান প্রসবের আগে পর্যায়ক্রমে দেওয়া হয় এই টিকা।
ডা. মণ্ডলের মতে, কোথাও কেটে গেলে বা গভীর ক্ষত হলে সঙ্গে-সঙ্গে ধুয়ে ফেলা উচিত, যাতে সংক্রমণ না ছড়ায়। প্রয়োজনে সেটা ড্রেসিং করতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স করা যেতে পারে। তার সঙ্গে টিটেনাস টক্সয়েড ইঞ্জেকশন নেওয়া উচিত। তা হলে টিটেনাসের মতো রোগ থেকে বাঁচা সম্ভব। এ রোগে দ্রুত পদক্ষেপ করলেই অনেকটা নিরাপদ থাকা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy