Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
corona

আমি করোনা আক্রান্ত, এখন কী কী করছি

লেখক এক জন করোনা-যোদ্ধা চিকিৎসক। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে করতে নিজেও কোভিড পজিটিভ হয়েছেন সম্প্রতি। এখন সরাসরি চিকিৎসা করতে না পারলেও নিভৃতবাসের মধ্যেই আনন্দবাজার ডিজিটালের পাঠকদের জন্য দিলেন কিছু জরুরি পরামর্শ। আতঙ্কিত না হয়ে কী করবেন বা করবেন না, সুনির্দিষ্ট ভাবে জানালেন সে কথাও। করোনা রোগীর সঙ্গে দূরত্ব বজায় থাকুক, কিন্তু পাশে থাকুন।

কোভিড পজিটিভ মানেই যে সমাজচ্যুত, এমনটা তো নয়। আতঙ্কের কোনও কারণ নেই, বলছেন আক্রান্ত চিকিৎসক। ফাইল ছবি।

কোভিড পজিটিভ মানেই যে সমাজচ্যুত, এমনটা তো নয়। আতঙ্কের কোনও কারণ নেই, বলছেন আক্রান্ত চিকিৎসক। ফাইল ছবি।

অমিতাভ চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২০ ১৯:০৬
Share: Save:

গত শুক্রবার শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল। আসলে পরিশ্রমও তো হচ্ছে। এপ্রিল মাস থেকে সেই অর্থে কোনও বিশ্রাম নেই। পেশায় একজন শল্যচিকিৎসক হওয়ায় রোগী দেখার চাপ তো ছিলই। তার উপর করোনার কারণে অতিরিক্ত সতর্কতাও রয়েছে। যাইহোক, শরীর ভাল না লাগায় শুক্রবার কাজে যাইনি। মনের মধ্যে একটা সন্দেহ হচ্ছিল। প্রথমেই বাড়ির একটা ঘরে আলাদা থাকতে শুরু করলাম। শৌচাগারও আলাদা। এমনকি, বাসন, জলের বোতল সবটাই আলাদা করে নিলাম। সঙ্গে রাখলাম একটা জল গরম করার হিটার, স্যানিটাইজারের একটা বোতল। কোনও গন্ধ পাচ্ছিলাম না মঙ্গলবার বিকেল থেকে। পাঁচ দিনের মাথায় বুধবার সকালে নিজেই গাড়ি চালিয়ে চলে গেলাম বেসরকারি হাসপাতালে সোয়াব টেস্ট করতে। বাইপাসের ধারে এই হাসপাতালের বাইরে একেবারে আলাদা জায়গায় ফিভার ক্লিনিকে বিধি মেনেই সোয়াব সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেখানেই দুপুর ১২টা নাগাদ নমুনা দিলাম আরটিপিসিআর পরীক্ষার জন্য। রাত ৯টায় জানতে পারলাম আমি কোভিড পজিটিভ। হ্যাঁ ঠিক আছে, কোভিড পজিটিভ মানেই যে সমাজচ্যুত, এমনটা তো নয়। আতঙ্কের কোনও কারণ নেই। নিয়ম মেনে থাকব ১৭ দিন। ৫ অগস্ট রিপোর্ট এসেছে আমার, ২২ অগস্ট পর্যন্ত নিজের দরজার বাইরে বেরোব না। তার পর আইসিএমআর-এর নিয়ম অনুযায়ী বাইরে বেরোলে কোনও অসুবিধা নেই।

বাড়িতে আলাদা ঘরেই থাকছি, সবটাই আলাদা করেছিলাম আগেই। আমার স্ত্রী ও ছেলেও আলাদা রয়েছেন অন্য ঘরে। খানিকটা মানসিক প্রস্তুতিও ছিল আগে থেকে। তবে শুধু পরিবারের সদস্যরাই নন, নিউ টাউনে আমি যে আবাসনে থাকি, সেই আবাসনের সদস্যরাও কিন্তু মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন মে মাস থেকেই। নিউ টাউন কলকাতা ডেভেলপমেন্ট অথরিটির তরফে বার বার আতঙ্ক দূরে রেখে পরস্পরের পাশে থাকতেও বলা হয়েছিল।এ ব্যাপারে চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন খুবই সাহায্য করেছেন।

‘নিউ টাউন ফোরাম অ্যান্ড নিউজ’ নামে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে। সেখানে আমাদের ডাক্তারদের পরামর্শেই আবাসনগুলিতে কোভিড যুদ্ধে পাশে থাকার জন্য প্রথম থেকেই বার বার সচেতন করা হয়েছিল। তাই একটা টিম তৈরি ছিল।

আরও পড়ুন: করোনা সারার কত দিন পর ব্যায়াম? ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়াতে মাথায় রাখুন এই সব​

রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর স্বাস্থ্য দফতরের তরফে সামনেটা সিল করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু প্রতিবেশীরা পাশে থাকছেন প্রতি মুহূর্তে। পৌঁছে দিচ্ছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। পুরোটাই নো-টাচ, অর্থাৎ দরজার বাইরে রাখা থাকছে। আমার স্ত্রী কেয়ারগিভারের দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি দেখছেন ওদিকগুলি।

মনে রাখতে হবে

• রিপোর্ট পজিটিভ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিন, ঘরে আইসোলেশনে থাকলে কাজ হবে না হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

• বাড়িতে আইসোলেশনে থাকার জন্য রোগী, তাঁর চিকিৎসক, তিনি যে পুর এলাকায় থাকেন সেখানে কোভিড চিকিৎসার দায়িত্বপ্রাপ্ত যে চিকিৎসক রয়েছেন, সবার কাছ থেকে লিখিত সম্মতিপত্র নিতে হবে।

• এ ছাড়া যিনি রোগীর দেখাশোনা করবেন বলে ঠিক করেছেন, তাঁর কাছ থেকেও লিখিত অনুমতিপত্র নেওয়া দরকার।

• পরিবারের বাকি সদস্যরা কোয়রান্টিনে থাকবেন।

• পরিবারের বাকি সদস্যদেরও পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে আরটিপিসিআর করে নিতে হবে।এ ক্ষেত্রে আমার স্ত্রী এবং ছেলেকে টেস্ট করতে হচ্ছে।

• প্রতি দিনের যা ওষুধ খেতেন তা নিয়মিত খেতে হবে।

• সুষম আহার খেতে হবে রোজের মতোই।

• যাঁদের থেকে সব্জি বা মাছ কেনেন, বাড়ির পাশেই দিয়ে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আগে থেকেই ফোন নম্বর নিয়ে রাখুন, যাতে মানসিক প্রস্তুতি থাকে। কোনও সমস্যা হলে খাবারের জোগানে যেন সমস্যা না হয়।

• প্রতিবেশীদেরও বোঝাতে হবে সংস্পর্শে না এলে চিন্তার কারণ নেই। করোনা রোগীর সঙ্গে দূরত্ব বজায় থাকুক, কিন্তু পাশে থাকুন।

• কাজের জায়গায় বা অন্য কোনও ভাবে করোনা রোগীর সংস্পর্শে এলে ১৪ দিনের নিভৃতবাস বাধ্যতামূলক।

আরও পড়ুন: কেউ উপসর্গহীন বাহক, কেউ করোনা সংক্রমিত, ভাইরাসের আচরণ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কেমন​

করোনা আক্রান্ত হোম আইসোলেশনে থাকলে এ গুলি মাথায় রাখতে হবে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

থাকার নিয়ম

• ঘরের বাইরে যাওয়া চলবে না মোটেই। বাড়ির বাইরে তো নয়ই।

• পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আছে এমন ঘরে রয়েছি। এসি থাকলেও চালাইনি।

• খাবার দেওয়ার সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় দরজা বন্ধ রেখেছি। পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন হলে ফোন করছি, মাস্ক পরে দরজা খুলছি। ৬ ফুট দূরত্বে মাস্ক পরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন তাঁরা।

• ঘরের বাইরে যাওয়া চলবে না। বাড়ির বাইরে তো নয়ই।

• হাত বারবার ধুয়ে নিচ্ছি।

• যেহেতু প্রায় উপসর্গহীন আমি, তাই নিজের বাসন নিজেই পরিষ্কার করে নিচ্ছি সাবান জলে।

• জামাকাপড়ও নিজে কাচছি, ঘরেই মেলছি।

• বিছানার চাদর ইত্যাদি একটি ওয়াশেবল ব্যাগে মুড়ে দরজার বাইরে রাখা হচ্ছে। কেয়ারগিভার, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে আমার স্ত্রী একটি গ্লাভস পরে সেটি ধরছেন। পুরোটাই ওয়াশিং মেশিনে ৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সাবান জলে কেচে দেওয়া হচ্ছে। ওই গ্লাভস ফেলে দিচ্ছেন তিনি।

• কেউ কেউ ডিসপোজেবল থালা-বাটি ব্যবহার করেন, সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পুরসভার দেওয়া বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যের হলুদ রঙের প্যাকেটে তা ফেলতে হবে। আমাকেও এমন একটি প্যাকেট দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, প্যাকেট ভর্তি হলে তার আগের দিন ফোন করলেই কর্মীরা এসে তা সংগ্রহ করে নিয়ে যাবেন। তবে আমি স্টিলের বাসন ব্যবহার করে সাবান-জলে পরিষ্কার করে নিচ্ছি।

• বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য বলতে রোজ একটি করে ত্রি-স্তরীয় মাস্ক পরছি, সেটি কেটে স্যানিটাইজ করে ফেলতে হবে ওই প্যাকেটে। তুলো, স্যানিটাইজার ফুরিয়ে গেলে সেই বোতলও ওই নির্দিষ্ট প্যাকেটে ফেলতে হবে।

• দরজার বাইরে একটি ট্রে রয়েছে, সেখানে পরিবারের সদস্যদের কেউ টিসু পেপার রাখছেন, ওতে মুড়িয়ে ফেলছি খাবার সংক্রান্ত বর্জ্য অর্থাৎ মাছের কাঁটা বা মাংসের হাড়জাতীয় জিনিস। সেটিকে একটি প্যাকেটে মুড়ে কেয়ারগিভারকে দিচ্ছি। তিনি বাড়ির অন্য বর্জ্যের প্যাকেটের মধ্যে সেই প্যাকেট রাখছেন। আবর্জনা সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন নির্দিষ্ট কর্মীরা।

• আমি যে ঘরে আইসোলেশনে রয়েছি, সেটি ভাইরাসনাশক দ্রবণ দিয়ে নিজেই পরিষ্কার করে নিচ্ছি।

আরও পড়ুন:শরীর অচল থেকে পক্ষাঘাত, করোনার দোসর কি এ বার গুলেনবারি সিনড্রোম? কী বলছেন চিকিৎসকেরা​

হোম আইসোলেশনে থাকলে মাথায় রাখতে হবে

• নিজস্ব বাসন (একটি থালা, দু’টি বাটি, একটি গ্লাস) থাকুক ঘরেই।

• একটি জগ (সংস্পর্শ ছাড়া যার মধ্যে জল দিতে পারবেন পরিবারের সদস্য), নিজস্ব বোতল, জল গরম করার কেটলি বা হিটার।

• দরজার বাইরে একটি র‌্যাক বা টুল, তার উপরে ট্রেতে থালা-বাটি রেখে সেখানে খাবার দিচ্ছেন কেয়ারগিভার। সম্পূর্ণটাই ‘নো-টাচ’।

• পৃথক স্যানিটাইজার

• পৃথক শৌচাগারের ব্যবহার

ঘরের মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিস রেখে দিতে হবে। দরজার বাইরে নির্দিষ্ট জায়গায় খাবার দেবেন কেয়ারগিভার। ছবি: প্রতিবেদকের

আইসোলেশনে থাকার চিকিৎসা

• ভিটামিন সাপ্লিমেন্টস আগে যেমন খেতাম খাচ্ছি। কোনও উপসর্গ নেই সেই অর্থে। তাই কোনও ওষুধ বা প্যারাসিটামল খাইনি।

• দিনে ৩-৪ লিটার জল খাচ্ছি। গরম জল।

• পর্যাপ্ত ফল-শাকসব্জি ও প্রোটিনযুক্ত খাবার খাচ্ছি।

• পালস অক্সিমিটার দিয়ে দিনে ৪-৫ বার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মেপে দেখবেন। অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫-এর উপর থাকলে চিন্তা নেই।

• নিউ টাউনে সরকারের তরফে চিকিৎসক অর্ণব রায় ট্র্যাকিং করছেন এই বিষয়গুলি। বিধি মেনে দিনে দু’বার পাল্স অক্সিমিটারের মান ছবি তুলে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

• রক্তচাপ মাপছি। নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছি। ঠিকই আছে।

• ব্রিদিং এক্সারসাইজ করছি নিয়মিত।

• বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখার প্রয়োজন নেই হোম আইসোলেশনে। কারণ, তা মনিটর ছাড়া ব্যবহার করা ঠিক নয়।

• আত্মীয়স্বজনের উচিত রোগীকে লাগাতার মনোবল জুগিয়ে যাওয়া। কাছাকাছি আসা তো সম্ভব নয়। কিন্তু ফোনে যেন যোগাযোগ থাকে।

• কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে নিউ টাউন প্রশাসনের এই বিষয়গুলিতে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব নেওয়ায় বিষয়গুলি সহজ হয়েছে।

আরও পড়ুন: সারা বিশ্বে নাজেহাল প্রায় ১৩ কোটি মানুষ, ত্বকের এই অসুখকে অবহেলা নয়​

সেবাযত্নের নিয়ম

• রোগীর সেবা যিনি করছেন, অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে আমার স্ত্রীকে ঘন ঘন হাত ধোওয়া, ত্রিস্তরীয় মাস্ক পরে থাকা, গ্লাভস পরা এ সব নিয়ম মানতে হচ্ছে।

• খাবার দেওয়া বা এমন কোনও প্রয়োজন হলে ফোন করছেন, তবেই দরজা খোলা হচ্ছে।

• পরিবারের কারও করোনা পজিটিভ রিপোর্ট এলে বাকিদেরও আরটিপিসিআর করে দেখে নিতে হবে তিনি আক্রান্ত কি না।

• অযথা আতঙ্কের কোনও কারণ নেই। সঠিক ঘুমেরও প্রয়োজন এই সময়ে। নিয়ম মেনে বাড়িতে থাকুন। সুষম খাবার, কিছু সাপ্লিমেন্টস ও পর্যাপ্ত জল খাওয়ার পাশাপাশি কোনও সমস্যা দেখা দিচ্ছে কিনা, সেটুকু খেয়াল রাখুন। সুস্থ রাখুন।

(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।

• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)

(লেখক এক জন করোনা-যোদ্ধা চিকিৎসক। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে করতে নিজেও কোভিড পজিটিভ হয়েছেন সম্প্রতি)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy