স্টেরয়েড শব্দটা আমরা হামেশাই শুনি। কিন্তু বস্তুটি কী, সে সম্পর্কে হয়তো অনেকেরই ধারণা স্পষ্ট নয়। রোজ প্রতি মুহূর্তে আমাদের দেহে স্টেরয়েড তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি অঙ্গ সঞ্চালনায় এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু শরীরে তা তৈরি হতে সমস্যা হলে কিংবা বহু গুরুতর রোগের চিকিৎসায় স্টেরয়েড মেডিসিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি একটি জীবনদায়ী ওষুধও বটে। তাই জানা জরুরি কখন স্টেরয়েড বন্ধু আর কখন তা ক্ষতিকর।
কী কী কারণে স্টেরয়েড প্রয়োজন হয়?
আমাদের কিডনির উপরে একটি অ্যাড্রিনালিন গ্ল্যান্ড রয়েছে, মূলত সেখানেই তৈরি হয় স্টেরয়েড। এর কাজ হল শরীরে নানা জায়গায় বিভিন্ন সময়ে চলতে থাকা প্রদাহ অর্থাৎ ইনফ্ল্যামেটরি রিঅ্যাকশনকে নিয়ন্ত্রণ করা। প্রদাহের ফলে প্রচুর প্রোটিন সাবস্ট্যান্স তৈরি হয়। কিন্তু এটি অতিরিক্ত মাত্রায় তৈরি হলে তার ফল ভাল না-ও হতে পারে। স্টেরয়েড তা নিয়ন্ত্রণ করে। দু’টি কারণে বাইরে থেকে স্টেরয়েড দেওয়ার প্রয়োজন হয়। প্রথমত শরীরে যতটা তৈরি হওয়া দরকার, স্টেরয়েড তার চেয়ে কম তৈরি হলে। দ্বিতীয়ত, যতটুকু স্টেরয়েড তৈরি হচ্ছে, তা শরীরকে পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট না হলে। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যাচ্ছে। ফুসফুসে বা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ইনফ্ল্যামেশনের কারণে অ্যান্টিজেন, অ্যান্টিবডির যে রিঅ্যাকশন হচ্ছে, তার ফলে শরীরে প্রচুর পরিমাণে এনজ়াইম তৈরি হচ্ছে। যেটুকু তৈরি হলে শরীরের পক্ষে ভাল, তার চেয়ে অনেক বেশি তৈরি হওয়ায় নানা রকম শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। সেগুলো থেকে বাঁচানোর জন্য করোনার ক্ষেত্রে স্টেরয়েড ব্যবহার করা হচ্ছে।’’
কোন কোন রোগে স্টেরয়েড দেওয়া হয়?
শরীরের প্রয়োজন অনুসারে স্টেরয়েড তৈরি না হলে বা তৈরি হওয়া বন্ধ হলে, প্রেশারে সমস্যা হবে, খিদে কমে যাবে, এমনকি চেহারাও ভেঙে যায়। সেই সঙ্গে দেখা দেয় নানা রোগের প্রকোপ। অটো ইমিউন ডিজ়িজ়, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজ়মা, সিওপিডি, হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে বছরের পর বছরও স্টেরয়েড দিতে হতে পারে। অটো ইমিউন রোগে হয়তো সারা জীবন ধরেও স্টেরয়েড খেতে হতে পারে। আবার রোগী যদি ক্রিটিকাল অবস্থায় থাকেন, যখন শরীরে স্টেরয়েড তৈরি হচ্ছে না বা পেশেন্ট শক স্টেজে চলে গিয়েছেন কিংবা কারও হঠাৎ করে প্রেশার খুব ফল করেছে... তখন স্টেরয়েড দেওয়া হয় অল্প কয়েক দিনের জন্য। তাই সমস্যা বিচার করে দু’ভাবে স্টেরয়েড দেওয়া হয়। কখনও অল্প দিনের জন্য কখনও বা দীর্ঘ দিন ধরে।
অপব্যবহার
স্টেরয়েডের যেমন ভাল দিক আছে, তেমনই কিছু খারাপ দিকও আছে। এবং সে দিকটি সম্পর্কে বিশেষ সচেতনতা জরুরি। স্টেরয়েড বহু দিন ধরে খেলে ওজন বেড়ে যায়, খিদেও বাড়ে। অনেক সময়ে দেখা গিয়েছে কেউ হয়তো ওজন বাড়াতে চান, তাঁকে স্টেরয়েড দিয়ে ওজন বাড়ানো হল। ডা. তালুকদার বললেন, ‘‘এমনও দেখা গিয়েছে, কারও হয়তো দীর্ঘ দিন ধরে জ্বর কমছে না বা রোগটি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না, সে রকম ক্ষেত্রে ওষুধের সঙ্গে সামান্য স্টেরয়েড মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে উপসর্গগুলো কমে যাবে। জ্বর বা গা-হাত পা ব্যথা থাকবে না। একটা সার্বিক সুস্থতা বোধ কাজ করবে। মনে হয়, আমি ভাল আছি। তবে সেটা দু’চার দিনের জন্য। আসল রোগটা ভিতরে থেকেই যাবে। গ্রামে, মফস্সলে স্টেরয়েড অকাতরে বিক্রি হয়, মোটা হওয়ার, ব্যথা কমানোর ওষুধ হিসেবে। তাই স্টেরয়েড খাওয়ার আগে সচেতন থাকা উচিত, কেন তিনি তা খাচ্ছেন। অ্যাজ়মা রোগীরাও সাধারণ শ্বাসকষ্টের ওষুধে যতটা না উপকার পান, স্টেরয়েড দিলে রিলিফ পাবেন তাড়াতাড়ি। আসলে স্টেরয়েড ম্যাজিকের মতো কাজ করে। কিন্তু ভুল ভাবে এটির ব্যবহার হলে গুরুতর শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।’’
স্টেরয়েড দীর্ঘদিন খেতে হলে কী হতে পারে?
এক দিকে শরীরে দেখা দেয় নানা সমস্যা, অন্য দিকে চেহারাতেও তার প্রভাব পড়ে। চর্বি বাড়তে থাকে, মুখ ফুলে ভারী হয়ে যায়। গায়ের রোম পুরু হতে থাকে। পেপটিক আলসার হতে পারে, ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়, ব্লাড সুগার দেখা দিতে পারে, ক্যাটারাক্ট হতে পারে, ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড় নরম হয়ে ভঙ্গুর হয়ে যায়, অন্য রোগের সংক্রমণের ভয় বাড়ে। আর আমাদের দেশে যে রোগে সংক্রমিত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি, তা হল টিবি। স্টেরয়েড অল্প কিছু দিন খেলে এ ধরনের সমস্যা হয় না। কিন্তু কাউকে দীর্ঘ সময় ধরে স্টেরয়েড দিতে হলে, সেই ব্যক্তির এ ধরনের কোনও রোগ আছে কি না, সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া জরুরি এবং বিভিন্ন ওষুধের মাধ্যমে তখন প্রোটেকশনও নিতে হয়। ডা. তালুকদার বললেন, ‘‘প্রতি দু’মাস-তিন মাস অন্তর পরীক্ষা করে দেখা হয়, ডায়াবিটিস, প্রেশার ইত্যাদি রোগ শরীরে বাসা বাঁধছে কি না।’’ যে সব রোগীকে দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড খেতে হচ্ছে, তা কি বন্ধ করার কোনও উপায় নেই? উত্তরে চেস্ট ফিজ়িশিয়ান ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশ্যালিস্ট ডা. অনির্বাণ নিয়োগী বললেন, ‘‘দীর্ঘকালীন রোগের ক্ষেত্রে দেখতে হবে, ডোজ় কমিয়ে কমিয়ে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া যায় কি না। সব সময়ে অবশ্য তা করা যায় না। শরীরে হঠাৎ দুর্বলতা তৈরি হয়। মাসলে ক্র্যাম্প ধরতে পারে। তখন হয়তো লং টার্মে ওষুধ চালিয়ে যেতে হয়। স্টেরয়েডের সহযোগী কিছু ওষুধও দেওয়া হয়, যা দিলে স্টেরয়েডের মাত্রা কিছুটা কমিয়ে আনা যায়। ফলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও কম হয়।’’ মনে রাখবেন, সুস্থ থাকার জন্য ওযুধ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সতর্কতাও সমান জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy