ঘন বনের মাঝে এক প্রস্রবণ। চার পাশে মেঘের মতো বাষ্প জমেছে। ধূম্র আঁচলের ও পারে অস্পষ্ট এক পরমাসুন্দরী। কিংবা প্রাসাদ অভ্যন্তরে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে সুগন্ধি ধূম। সেই কুয়াশার আড়ালে রাজকন্যার ছায়া। ধ্রুপদী সাহিত্য, ছবি বা ইতিহাস আশ্রিত ছবিতে এমন দৃশ্য বা কল্পনার সঙ্গে পরিচিত আমরা। দেখেশুনে মনে হয়, সৌন্দর্যের সঙ্গে কোথাও এই মেঘলা বাষ্প বা ধূম্রজালের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
তবে পুরনো দিনের রূপসীরা সত্যিই ঈষৎ তপ্ত বাষ্পের সাহায্যে চেহারার যত্ন নিতেন। তখন না ছিল পার্লার, না ছিল হেয়ার ড্রেসার। খোঁজ নিলে জানা যায়, সে যুগে রূপ খোলতাই করার জন্য তাঁদের প্রিয় ছিল গরম জলের ভাপ। অর্থাৎ স্টিম থেরাপি। এ কালেও ফেসিয়ালে স্টিম মাস্ট। বাড়িতেও অনায়াসে মিলতে পারে স্টিমের সুফল।
কর্কটক্রান্তি ও কোমল কান্তি
প্রাচীন গ্রিস ও রোমে সৌন্দর্য রক্ষায় স্টিমের ব্যবহার দারুণ জনপ্রিয় ছিল। এ দেশে মুঘল অন্তঃপুরিকারাও ‘ফেসিয়াল স্টিম’ পছন্দ করতেন। আর এখন তো মৌসুমি জলবায়ু সামলে ঘেমেনেয়েই ঘর-বাইরের কাজ সারছেন মহিলারা। তাই স্টিম নেওয়ার প্রয়োজনও বেড়েছে।
উপকারী বন্ধু
স্টিমের প্রধান কাজ ত্বকের ভিতরের স্তরে ঢুকে ধুলোময়লা বার করে আনা। গরম বাষ্পের স্পর্শে ত্বকের উপরের অংশ ঘেমে ওঠে। রোমকূপের মুখ খুলে যায়, সেখানে আটকে পড়া জমাট বাঁধা তেলময়লা গলে বাইরে বেরিয়ে আসে। মৃত কোষের পরতও তুলে দেয়। স্টিম রক্ত চলাচল বাড়ায়, তাই মুখ উজ্জ্বল হয়। এই রক্ত চলাচলের সুবাদে ত্বকে কোলাজেন আর ইলাস্টিন তৈরির মাত্রা বাড়ে। চামড়া টানটান নিটোল থাকে, বয়স কম দেখায়। বাষ্পে তৈলগ্রন্থিগুলি উদ্দীপিত হয়, প্রাকৃতিক ভাবেই ত্বক ময়শ্চারাইজ়ড থাকে। ব্যাকটিরিয়া ধ্বংস করায় ব্রণ, অ্যাকনের সমস্যা দূর হয়। নিয়মিত স্টিম নিলে ত্বকের শোষণ ক্ষমতা বাড়ে, প্রসাধনী ও মেকআপ বেশি ভাল কাজ করে।
শুধুই জল নয়
পরিস্রুত জল ও চা পাতা ছেঁকে নেওয়া লিকারকে স্টিমের জন্য ব্যবহার করা যায়। ত্বকের ধরন বুঝে সেই তরলে বিশেষ উপকরণ মিশিয়ে নিলে আরও ভাল।
• তৈলাক্ত ত্বক: কয়েকটা তাজা তুলসী পাতা দ্রবণে ফেলে দিন। ভাপ নেওয়ার ঠিক আগে দু’-তিন ফোঁটা টি ট্রি অয়েল দেবেন।
• শুষ্ক ত্বক: শুকনো গোলাপ পাপড়ি আর কুঁড়ি মিশিয়ে তরল ফোটান। ক্যামোমিল, ল্যাভেন্ডারের নির্যাস মেশাতে পারেন।
• মিশ্র ত্বক: ল্যাভেন্ডারের নির্যাস, জেরেনিয়াম এসেনশিয়াল অয়েল তিন ফোঁটা। এই দ্রবণ সংবেদনশীল ত্বকেও কাজ দেয়।
অ্যাকনের সমস্যা থাকলে ইউক্যালিপ্টাস অয়েল দিতে পারেন। বিবর্ণ ত্বকের জন্য কমলালেবুর খোসা, তিন ফোঁটা লেমন এসেনশিয়াল অয়েল মেশান। সব উপকরণই প্রসাধনীর দোকানে সহজেই মেলে।
তিন ভাবে স্টিম
গরম জলের পাত্রের উপর মাথা ঝুঁকিয়ে বা মুখে গরম জলে ভেজানো তোয়ালের ভাপ দিয়ে এবং হোম ফেসিয়াল স্টিমার মেশিন (সহজলভ্য, আকারে ছোট) — এই তিন ভাবে স্টিম নিতে পারেন। স্টিম নেওয়ার আগে অতি অবশ্যই জেন্টল এক্সফোলিয়েটিং ক্লেনজ়ার দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে নেবেন। চুল আঁটোসাঁটো করে বেঁধে রাখবেন। তিন ক্ষেত্রেই স্টিম নেওয়ার প্রক্রিয়া আলাদা।
• পাত্র বা গামলা: যে টেবিলে জলপূর্ণ পাত্র রাখবেন, তার উচ্চতামাফিক চেয়ার বেছে নিন। যে চেয়ারে বসলে কিছু ক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে রাখতে কষ্ট হবে না। শরীর সম্পূর্ণ আরাম পেলে তবে বিউটি রুটিনের পুরো ফল মেলে। পাত্রে পরিমাণ মতো জল দিয়ে গ্যাসে বসান। জল ফুটতে শুরু করলে ভেষজ দেবেন। তার পর কম আঁচে দু’-তিন মিনিট রেখে, দরকার মতো এসেনশিয়াল অয়েল ফেলে টেবিলের উপরের জামবাটি বা গামলায় জলটা সাবধানে ঢালবেন। ওই পাত্রের উপর সন্তর্পণে ঝুঁকে মুখ আর গলা গরম বাষ্পের সংস্পর্শে আনুন। পরিষ্কার, নরম, বড় তোয়ালে মাথার উপর দিয়ে রাখুন। জল থেকে মুখ অন্তত ছ’ ইঞ্চি দূরে থাকবে। স্টিম নেবেন পাঁচ-দশ মিনিট।
• ওয়র্ম টাওয়েল: ভেষজ মিশ্রিত গরম জলে তোয়ালে ডুবিয়ে তুলুন। নিংড়ে জল ঝরিয়ে নিন। আরাম করে শুয়ে তোয়ালেটা মুখের উপর আলগোছে ফেলে রাখুন। কপাল, চোখ, গলা সবটা ঢাকা থাকবে। তবে নিশ্বাস নিতে যেন অসুবিধা নয়। এ ভাবে পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নিন।
• ইলেকট্রিকাল স্টিমার: নিজে জল গরম করলে একটু পরে তাপ কমে যায়। এই স্টিমার যন্ত্রে সেই সমস্যা মিটবে। যে হেতু ইলেকট্রিকাল, তাই লিফলেটের ব্যবহারবিধি অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। কখন ভেষজ ও তেল মেশাবেন, তাও সেখানেই লেখা থাকে। স্টিমারের যে নল থেকে বাষ্প বার হবে তা মুখ ও গলা থেকে সাধারণত দশ ইঞ্চি দূরে রাখতে হয়। দু’-তিন মিনিট স্টিম দিয়ে একটু থামুন, তার পর আবার দু’মিনিট ভাপ নিন।
সাবধানতাও জরুরি
• বাষ্পের স্পর্শে ত্বক যেন পুড়ে না যায়। এতে বড় ক্ষতি না হলেও ত্বকে দাগ হয়ে যেতে পারে।
• স্টিম নেওয়ার সময় চোখ বন্ধ রাখুন।
• ওয়ার্ম টাওয়েল মেথডের ক্ষেত্রে তোয়ালেটি ত্বকে ঘষবেন না। তোয়ালে যেন প্রচণ্ড গরম না হয়।
• দু’ মিনিট মতো স্টিম নিয়ে ব্রেক নিন। বাষ্পের তাপ ত্বকে সহ্য হচ্ছে কি না বুঝতে পারবেন। এক মিনিট পর আবার ভাপ নেবেন।
• সপ্তাহে এক দিন স্টিম নেওয়া ভাল। খুব শুষ্ক বা সংবেদনশীল ত্বকের ক্ষেত্রে বর্ষা কালে তিন সপ্তাহ অন্তর থেরাপিটি চলতে পারে।
• ত্বকে কোনও সংক্রমণ থাকলে স্টিম নেবেন না।
• স্টিম নেওয়ার পর ঈষদুষ্ণ জল ত্বকে ছিটিয়ে ফ্যানের হাওয়ায় শুকিয়ে নিন। ময়শ্চারাইজ়ার, সিরাম বা অ্যান্টি এজিং ক্রিম লাগান।
এর পর কপালে, গালে, চোখের পাতায়, গলায় আঙুল বোলালেও সদ্য উদ্দীপিত ত্বকের রক্ত চলাচল হবে। আর আপনার ত্বকের জেল্লাও চোখ টানবে সকলের।
মডেল: দর্শনা বণিক
ছবি: দেবর্ষি সরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy