চিত্তদার দোকানের সেই চিকেন স্টু। ছবি: সর্বজিৎ সেন।
ফিশ ফ্রাই, চিকেন স্টু, ডিম টোস্ট, মোমো, চাউমিন, বাসন্তী পোলাও, মাটন কষা... কী নেই ডেকার্স লেনে? অর্ডার দিলেই হাতে গরম সুস্বাদু খাবার। ধর্মতলার মোড় থেকে ট্রামের আওয়াজ সঙ্গী করে এগোতে হবে রাজভবনের দিকে। মিনিট দুয়েক মৃদুমন্দ গতিতে হাঁটলেই ডান হাতে তারজড়ানো ফলকে লেখা জেমস হিকি সরণি, নীচে ডেকার্স লেন। কলকাতার কালেক্টর ফিলিপ মাইনার ডেকার্সের নামে এই রাস্তার নামকরণ। এই রাস্তায় নাবিকদের সঙ্গে দেখা করতেন ডেকার সাহেব। কথাবার্তার পাশাপাশি চলত খানাপিনাও। পরে অবশ্য প্রথম ভারতীয় সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর প্রবক্তা জেমস অগাস্টাস হিকির নামানুসারে জেমস হিকি সরণি নামকরণ হয়। তবে অফিসপাড়ার এই ‘খাইবার পাস’ ডেকার্স লেন নামেই বেশি পরিচিত।
এক ভাঁড় চা থেকে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার আয়োজনও রয়েছে এই গলিতে। সকাল থেকেই কর্মচারীরা বিশালাকার হাঁড়ি, গামলা নিয়ে ময়দানে নেমে পড়েন। কোনও দোকানের গামলায় সিদ্ধ হয় কিলো-কিলো চাউমিন। কোথাও দিনভর পেঁয়াজ কাটা চলছে, তো কোথাও ময়ান ঠেসে মাখা হচ্ছে ময়দা— যেন যজ্ঞিবাড়ির আয়োজন! রোদ মাথায় ওঠার আগেই লুচির তরকারি, চায়ের দুধ ফোটানো, ডেভিলের পুর ভরা শেষ। এ বার একের পর এক ব্যাচ বসে পড়বে রাস্তার ধারে কাঠের বেঞ্চে। দোকানিরা দু’হাতে তিন-চারটে প্লেট ধরে সরু গলির মাঝখান দিয়ে হুস করে বেরিয়ে যাওয়া বাইক-স্কুটি কাটিয়ে পৌঁছে যাবে কাস্টমারের কাছে। প্লেট হাতে গুঁজে দিয়েই শেষ নয়, স্যালাড, সসের জোগান দিয়ে যাবেন তাঁরা। এ রাস্তা শুধু খাওয়ার নয়, খাওয়ানোরও।
শুরু থেকে...
ডেকার্স লেন লেখা বোর্ডের সামনে ঠিক ডান হাতে পড়বে নানপুরি-ঘুগনি, পুরি-সবজির দোকান। দোকানি এক টানে ময়দার লেচি বেলে ছুড়ে দেন কালো কড়াইয়ের তেলে। লম্বা হাতাওয়ালা শান্তায় ফুলকো লুচি-পুরি প্রায় মাথার উপরে তুলে ছেঁকে নেওয়া হয় তেল। তার পর সোজা খদ্দেরের প্লেটে ল্যান্ডিং। পাশে মাখোমাখো ঘুগনি, শসা-পেঁয়াজকুচি।
এই দোকানের গা ঘেঁষেই তৈরি হচ্ছে এগ, চিকেন চাউমিন, ফ্রায়েড রাইস। বিশালাকার গোল চাটুর বুকে আছড়ে পড়ছে কুচি কুচি আনাজ। তার উপরে খুন্তি চালিয়ে সেগুলোকে নেড়েঘেঁটে ভিনিগার, নুন, মশলা, সস মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে চাউমিন।
কিন্তু এ দোকানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার জো নেই। পিছন থেকে টেনে নিয়ে যাবে মিঠে আতরের গন্ধ। চোখ বুজে ঘ্রাণ নিতে নিতে পৌঁছে যাবেন বিরিয়ানির হাঁড়ির সামনে। লাল কাপড়ে আধ-ঢাকা হাঁড়ির পেট থেকে নধরকান্তি মাটনের টুকরো এসে পড়বে সাদা প্লেটে। গয়নার মতো তার গায়ে দু’চারটে হলদে-সাদা লম্বা ভাতের দানা। তার পরেই নরম মাখনের মতো ধোঁয়াওঠা আলু এসে বসবে পাশে। তাদের ঢেকে দেওয়া হবে সরু ভাতের স্তূপে। ততক্ষণে জিভের আত্মরতি শুরু হয়ে গিয়েছে। বিরিয়ানির প্লেট নিয়ে নির্জন কোণ খোঁজার আগেই হাতছানি দেবে তেল-রগরগে চিকেন চাঁপ। মোগলাই স্বাদে অবগাহন সাঙ্গ হলে নজরে পড়বে আপনজন। এ দোকানের ভোল বদলে গিয়েছে অতিমারির পরে। আপনজনের অতিপরিচিত ফিশ কচুরি, ফিশ ওরলি আর নেই মেনুতে। পুরো মেনুই ঢেলে সাজানো হয়েছে এগ রোল, চিকেন রোল, চাউমিন দিয়ে। তবে ফিশ ফ্রাই আছে তালিকায়।
জিয়া নস্টাল...
পাশেই জনপ্রিয় চিত্তদার আদি দোকান। প্রায় সত্তর বছর আগে পূর্ববঙ্গ থেকে বড় ছেলে চিত্তরঞ্জনের হাত ধরে কলকাতায় আসেন শিরীষচন্দ্র রায়। প্রথমে দোকান খোলেন টি-বোর্ডের কাছে পুরনো পাসপোর্ট অফিসের সামনে। পরে তা সরিয়ে আনেন এই গলিতে। এ দোকানের ফিশ ফ্রাই, ডিমের ডেভিল, চিকেন স্টু কলকাতার খাদ্যপ্রেমীদের রসনা-মানচিত্রে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে কর্মচারীদের জেড গতির সার্ভিস আর উষ্ণ আন্তরিকতা। কার ডায়াবিটিস, কোন খদ্দেরের স্টুয়ের সঙ্গে পাউরুটি যাবে না... সব তাঁদের নখদর্পণে। আবার মাঝেমাঝে ‘আজ একটা ডেভিল খান’ বলে টুক করে প্লেটে গুঁজে দিয়ে যান বোমার আকারের ডেভিল। ‘‘এখানে এক ডাক্তারের বাড়িতে আগে আসর বসত গানের। মান্না দে আসতেন। ফ্রাই, কাটলেট... অনেক খাবার যেত এখান থেকে। এখনও মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে এখান থেকে চিকেন স্টু ও অন্যান্য খাবার যায়,’’ বললেন চিত্তদার ভাইপো সন্দীপ রায়।
গলির ভিতরে ঢুকলে রয়েছে এঁদেরই একটি অংশ সুরুচি। এখানে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। “বাবা (চিত্তদা) এই দোকানটি পরে করেন। আমাদের স্টু সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় খেতেন। অনেক খেলোয়াড়ই তখন আসতেন। আসলে ময়দান থেকে এখানে ঝট করে আসা যেত। আর খেলোয়াড়দের জন্যই আমাদের স্টু-ও এমন ভাবে তৈরি, যাতে তাঁরা এনার্জি পান। প্রোটিনের জন্য চিকেনের টুকরো সঙ্গে পেঁপে, গাজর ও বিনস। আলু থাকে না। পুরোটাই তৈরি হয় মাখনে। খেলোয়াড়দের মধ্যে সমরেশ চৌধুরী, মিহির বসু, প্রদীপ তালুকদারকে দেখেছি। স্পিনার উৎপল চট্টোপাধ্যায়ও এসেছেন,” গর্বিত শোনাল সুরুচির মালিক সমীর রায়ের স্বর।
নস্ট্যালজিয়ার ওম নিয়ে এ বার মিষ্টিমুখ করার পালা। চিত্তদার দোকানের কাছেই শ্যাম মোহন শর্মার মিষ্টির দোকান। প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে উত্তরপ্রদেশ থেকে তাঁর বাবা কলকাতায় এসে এই দোকান শুরু করেন। মেদিনীপুরের কারিগরদের হাতে তৈরি হয় রসে টইটম্বুর, নরম তুলতুলে গুলাবজামুন, দুধসাদা রাবড়ি, পেঁপের হালুয়া, ক্ষীরের শিঙাড়া আর শীতে গাজরের হালুয়া। লস্যির উপরে থাকে মোটা মালাইয়ের প্রলেপ। গরম দুধও বিক্রি হয় এখানে।
শেষ নেই যার...
গলির ভিতরে আর-একটা চাউ-মোমোর দোকান পড়বে। সেখান থেকে একটু এগোলেই বেবো স্যান্ডউইচ। দুটো পাউরুটির মাঝে কত কী দেওয়া যায়, এ দোকানে এলে দেখতে পাবেন। চিকেন চিজ় কর্ন স্যান্ডউইচের মধ্যে একটা স্তর থাকে হলুদ কর্নের, তার পরে পেঁয়াজ, টম্যাটো, মেয়োনিজ়ে মাখানো চিকেন কুচির স্প্রেড, তার উপরে স্লাইস করা একটা গোটা ডিম। একটা স্যান্ডউইচেই দুপুরের লাঞ্চ শেষ।
তবে খানাপিনা এখানেই শেষ নয়। বাঙালি বাড়ির চিরন্তন বাসন্তী পোলাও, চিকেন কষাও রয়েছে উল্টো দিকে। সেখানে কুলচাও পাবেন। ‘‘কুলচার সঙ্গে বেশি চলে চিকেন ভর্তা, পনির বাটার মশলা। এখানকার ফিশ ব্যাটার ফ্রাই, লেমন ফিশ, গার্লিক চিকেনও সকলে খুব পছন্দ করে,’’ বললেন দোকানের মালিক মন্টু হালদার। অতিমারির পরে কাগজের প্লেটে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিল, তবে এখন আবার খদ্দেররা কাচ, স্টিলের প্লেটেই খাবার খেতে পছন্দ করছেন। তাই যত্ন নিয়ে হাইজিন বজায় রেখে প্লেট পরিষ্কার এখন এ চত্বরের ব্যবসার অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও আছে বাকি। মাছে-ভাতে বাঙালির পাত পেড়ে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে হিন্দু হোটেলে। কালো বোর্ডে খড়ির আঁকে ভেসে ওঠে রুই, কাতলা, চুনো, ভেটকি, লোটের নাম। এ দোকানে পরপর এক হপ্তা গেলেই টের পাবেন যে, এক তরকারি রোজ হয় না। আজ পালং-বড়ির চচ্চড়ি, তো কাল পোস্ত, পরশু পটলের তরকারি, তার পর দিন ভাঙাচোরা শুক্তো। তবে আলু-চোখা পাবেন রোজ।
এ ছাড়াও রয়েছে কিমা-পরোটা, মালাই টোস্ট, ডিম-টোস্ট... আরও কত কী! সারা দিনই গলির একপাশ থেকে আর একপাশে প্লেট ব্যালান্স করে দৌড়ে চলেছেন কিছু মানুষ। পড়ন্ত বিকেলেও উনুনে কয়লা পুরে দিচ্ছেন কয়েকজন। উনুনের আঁচ কি কখনও নেভে না এ চত্বরে? পরোটার লেচি পাকাতে-পাকাতেই এক তরুণের সহাস্য উত্তর, ‘‘পেটের আগুনও নিভব না, উনুনের আঁচও নিভব না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy