—প্রতীকী চিত্র।
“বয়ঃসন্ধি নূপুর হয়ে বেজে উঠছে সারা শরীর জুড়ে...”
রাকার বয়স সবে চোদ্দো। অথচ গালভর্তি ব্রণ। বন্ধু মহলে, বিয়েবাড়িতে যেতে অস্বস্তিতে ভোগে সে। অন্য দিকে সদ্য কলেজ যেতে শুরু করেছে ঋজু। ছোটবেলায় মাথা ভর্তি চুল থাকলেও এখন ক্রমশ তা পাতলা হয়ে যাচ্ছে। অযত্নই কি তার একমাত্র কারণ? সোহিনীর সমস্যা আবার অন্য। ষোলো-সতেরো বছর বয়স থেকেই ঠোঁটের উপরে, চিবুক, থুতনিতে রোমের আধিক্য দেখা দিয়েছে। এখনই তাকে নিয়মিত থ্রেডিং করাতে হচ্ছে। কিন্তু এ সমস্যার কারণ আদতে কী?
ত্বক বিশেষজ্ঞ ডা. সন্দীপন ধর বললেন, “আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত এ ধরনের সমস্যায় ভুগছে এমন ছেলে, মেয়ের সংখ্যা অনেক। মূলত বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই এ সব সমস্যার সূত্রপাত হয়। বয়ঃসন্ধি আদতে একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে শিশুর শরীর একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে রূপান্তরিত হয়, প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে। মেয়েদের ক্ষেত্রে সাধারণত বয়ঃসন্ধি ৯-১৪ বছর এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে তা ১০-১৭ বছর। শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তরণের এই সময়ে উভয়েরই শারীরিক কিছু পরিবর্তন ঘটে। এই সময় মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ‘গ্রোথ হরমোন’ নামক এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ নিঃসরণ হয়, যার প্রভাবে ছেলেদের অণ্ডকোষ ও মেয়েদের ডিম্বাশয়ের পরিবর্তন হয়। তাদের শরীরে টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন নামক হরমোন তৈরি শুরু হয়। ছেলে ও মেয়েদের লিঙ্গবৈষম্য শরীরে ফুটে উঠতে শুরু করে।”
এ সময় শরীর দ্রুত বদলায়। ছেলেদের মাংসপেশি দৃঢ় হয়, গোঁফ-দাড়ি গজায়। অন্য দিকে, মেয়েদেরও স্তন, নিতম্ব আকারে বাড়ে, ভারী হয়, ঋতুস্রাব শুরু হয়। ছেলে, মেয়ে উভয়েরই উচ্চতা বাড়ে, কণ্ঠস্বরের বদল ঘটে। শরীরের নানা অঙ্গে গজায় রোম। শারীরিক এই বদল কিন্তু মানসিক ভাবেও তাদের বদলে দেয় বেশ খানিকটা। মনে অনেক রকম প্রশ্ন, ভয়-ভীতি, উদ্বেগের সঞ্চার করে। অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার আগ্রহ যেমন বাড়ে, তেমনই নানা রকম মানসিক ও শারীরিক সমস্যার সূত্রপাতও কিন্তু এ সময় থেকেই হয়।
বয়ঃসন্ধির সাধারণ সমস্যাসমূহ
ব্রণর সমস্যা
বয়ঃসন্ধি কালের শারীরিক সমস্যার মধ্যে অন্যতম হল ব্রণ। ছেলে-মেয়ে উভয়ের মধ্যেই এই সমস্যা দেখা দেয়। ৯-১০ বছর বয়স থেকে শুরু হয়ে এই সমস্যা চলতে পারে প্রায় ৩০-৩৫ বছর পর্যন্ত। অ্যাড্রিনাল বা ওভারি থেকে নির্গত অ্যাস্ট্রোজেন হরমোন এর মূল কারণ। মানবদেহের উপরিভাগে বিশেষত মুখ, পিঠ, গলায় থাকে সিবেসিয়াস গ্রন্থি। বয়ঃসন্ধিকালে অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের প্রভাবে সিবেসিয়াস গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত নির্যাস নির্গত হয়। ত্বকে থাকা হেয়ার ফলিকলের সংস্পর্শে সেই সিবেসিয়াস নির্যাস এলে ত্বকের অভ্যন্তরে বাসা বাঁধে প্রপিয়োনি ব্যাকটেরিয়াম অ্যাকনিস। এ কারণেই একে পাইলো সিবেসিয়াস অ্যাপারেটাস বলা হয়। তার থেকেই ছেলে, মেয়ে উভয়ের নরম চামড়া ভেদ করে ফুসকুড়ি বা ব্রণ উঠতে থাকে। পলিসিস্টিক ওভারি ডিজ়িজ় অর্থাৎ পিসিওডির কারণেও মেয়েদের ব্রণ বেশি হয়। ডা. ধরের কথায়, পৃথিবীতে ব্রণ প্রায় সবারই হয়। আপাত ভাবে সাধারণ সমস্যা হলেও, কিছু সময় ব্রণ খুব গুরুতর আকার ধারণ করে। ছেলে, মেয়ে উভয়ের হলেও, মেয়েদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভাবে এই সমস্যা বেশি হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে অনেক সময় মেয়েদের গুরুতর ব্রণর সমস্যা জিনগত কারণেও হয়।
সমাধান
জীবনযাপনে বদল এই সমস্যা থেকে অনেকাংশে মুক্তি দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে জাঙ্ক ফুড, প্রিজ়ারভেটিভ যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। পাশাপাশি দিনে অন্তত বার চারেক জল দিয়ে ভাল করে মুখ ধোওয়া প্রয়োজন। এতে ব্রণর সম্ভাবনা কমবে।
খুব বেশি মিষ্টি খেলে শরীরে গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স বেড়ে যায়, যা অ্যান্ড্রোজেন হরমোন নিঃসরণ বাড়ায়, সঙ্গে ব্রণও। তাই ব্রণর সমস্যা থাকলে, মিষ্টি একটু বুঝে খাওয়াই ভাল।
ব্রণর প্রাথমিক পর্যায়ে ত্বকে হালকা লালচে ভাব, গুটিগুটি দেখা দেয়। কখনও রোদ লাগলে ত্বক লাল হয়ে যাওয়ার প্রবণতাও থাকে। তাই রোদে বেরোলে সানস্ক্রিন ব্যবহার জরুরি। ডা. ধর বলছেন, “পাঁচ বছরের উপর যে কোনও বাচ্চাই সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে পারে। তবে বাজারচলতি সানস্ক্রিন নয়, বাচ্চাদের জন্য অনুমতি প্রাপ্ত ঔষধ কোম্পানির সানস্ক্রিন বেছে নেওয়া উচিত।”
ফেসওয়াশ ব্যবহার জরুরি নয়। তবে করলে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির তৈরি অয়েলফ্রি ফেসওয়াশ ব্যবহার করাই ভাল। সন্দীপনের মতে, “বাজারচলতি কেমিক্যাল ফেসওয়াশ কিন্তু ব্রণর জন্য কার্যকর নয়।”
রাতে এসিতে শোয়ার অভ্যেস থাকলে ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে যেতে পারে, যা ব্রণর পক্ষে ক্ষতিকর। তাই রাতে শোয়ার আগে অবশ্যই ক্রিম বা ময়শ্চারাইজ়ার ব্যবহার করা জরুরি। সে ক্ষেত্রেও ওষুধ কোম্পানির তৈরি কম তৈলাক্ত ময়শ্চারাইজ়ার বেছে নিতে হবে।
অতিরিক্ত ব্রণর সমস্যায় অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়।
অতিরিক্ত রোমের সমস্যা
একে হারসুটিজ়মও বলা হয়। বয়ঃসন্ধির সময়ে ধীরে ধীরে ছেলেদের দাড়ি গোঁফ গজায়। মেয়েদের ক্ষেত্রেও ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে শরীরের নানা অংশে রোমের প্রাধান্য দেখা যায়। সমস্যা হয়, যখন ছেলেদের মতো মেয়েদেরও ঠোঁটের উপরে, কানের লতিতে, গালে অতিরিক্ত রোম দেখা দেয়। ডা. ধর বললেন, “শরীরে হরমোনের তারতম্যের কারণে এ রকম হতে পারে। তা ছাড়া, পিসিওডির সমস্যার বহিঃপ্রকাশও অনেক সময়েই এই রোম। এই সমস্যা মুখের পাশাপাশি সারা শরীরেও হতে পারে। একে তখন হাইপার ট্রাইপসিস বলা হয়। তবে শতকরা পনেরো জনের শরীরে কিন্তু কোনও সমস্যা থাকে না। একে ইডিয়োপ্যাথিক হারসুটিজ়ম বলা হয়। এখানেও জিনের ভূমিকা রয়েছে।”
সমাধান
প্রাথমিক ভাবে অতিরিক্ত রোমের ক্ষেত্রে অনেকেই বাজারজাত নানা পণ্য ব্যবহার করেন। অনেকে লেজ়ার ট্রিটমেন্টও করান। তা ছাড়া ওয়াক্সিং বা প্লাকিং তো রয়েছেই। এ সব করলে হয়তো রোমের থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়া যায়, কিন্তু সমস্যাটা থেকেই যায়। তাই সমাধান গোড়া থেকে হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে ত্বক বিশেষজ্ঞ এবং এন্ডোক্রিনোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া ভাল। চিকিৎসার শুরুতেই বেশ কিছু পরীক্ষা করিয়ে শরীরে হরমোনের ভারসাম্যের অভাব রয়েছে কি না তা জেনে নেন চিকিৎসকেরা। পাশাপাশি মা, বোন সহ পরিবারের অন্য কারও এই সমস্যা রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হয়।
চুল পড়া
অতিরিক্ত রোমের পাশাপাশি বয়ঃসন্ধিকালে চুল পড়াও একটি গুরুতর সমস্যা। একে অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোকেশিয়া বলে। এ সমস্যা ছেলে, মেয়ে উভয়েরই হয়। এর পিছনেও কারণ সেই অ্যান্ড্রোজেন হরমোন।
সমাধান
অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোকেশিয়া নির্ণয় হলে তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও রয়েছে। যথাসময়ে চিকিৎসা করালে এই রোগ সম্পূর্ণ ভাবে নিরাময় হয়।
ডা. ধর বললেন, “কিশোর-কিশোরীদের এ সব সমস্যার সমাধান যেমন প্রয়োজন, তেমনই খোলাখুলি ভাবে শারীরিক বদল নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করাও জরুরি।” নয়তো শরীর নিয়ে নানা ভুল ধারণা তাদের মনে বাসা বাঁধে। শারীরিক বদলের কারণে তারা হীনম্মন্যতায় ভোগে। তাই এ সময় যেমন ছেলে, মেয়েদের প্রতি অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অতিরিক্ত নজরের প্রয়োজন, তেমনই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকাও জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy