৩০ ডিসেম্বর ২০২৪
serena williams

Serena Williams: নহ মাতা, নহ কন্যা! সেরিনা, মিমি এবং আমি

সেরিনা উইলিয়ামস দ্বিতীয় সন্তান চান। তাই খেলা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সঙ্গে তুলে দিয়েছেন বেশ কিছু প্রশ্ন।

পরিবারে মন দেবেন বলে টেনিস থেকে অবসর ঘোষণা করছেন সেরিনা।

পরিবারে মন দেবেন বলে টেনিস থেকে অবসর ঘোষণা করছেন সেরিনা। ছবি: রয়টার্স

সুচন্দ্রা ঘটক
শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০২২ ১০:০৯
Share: Save:

নিজের কথা আগে।

তিরিশের কাছাকাছি এসে যখন সংসার পাতলাম, তখন সাংবাদিকতায় বেশ কয়েক বছর হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ করি। দু’দিক সামলানোর জন্য যথেষ্ট দৌড়ঝাঁপ করতে হতই। জুড়েছে সংসার। সন্তান থাকলে কী ভাবে তার দেখাশোনা করব? চিন্তা হয়েছে। শেষমেশ পরিবারের চেয়ে কাজই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। পরিবারে কম সময় দিয়েছি। এখনও সন্তান নেই।

অনেকেরই মনে হতে পারে, এ আবার কেমন কথা! কিন্তু এমনটা আরও মেয়ে ভাবেন। বাধ্য হন। কেউ মুখে বলেন, কেউ বলেন না।

টলিপাড়ায় অনেকেই বলেন, মিমি নিজের কাজকেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন।

টলিপাড়ায় অনেকেই বলেন, মিমি নিজের কাজকেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন।

সাংসদ-অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তীর কথাই ধরে নেওয়া যাক। এক সময়ে শোনা গিয়েছিল, শহরের এক পরিচালকের সঙ্গে সংসার পাতবেন। তার পরে হঠাৎ দেখা গেল, আলাদা হচ্ছেন দু’জনে। সেই পরিচালক পরে বিয়ে করেন। সন্তানও হয় তাঁর। মিমি একাই থাকেন। অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনীতি। দেশের কনিষ্ঠতম সাংসদদের তালিকায় নাম উঠেছে তাঁর। টালিগঞ্জের সফল নায়িকা তো ছিলেনই। টলিপাড়ায় অনেকেই বলেন, মিমি নিজের কাজকেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন। তাই পরিবার বড় করেননি। গুঞ্জন, সেই কারণেই নাকি পরিচালকের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। সকলে অবশ্য এমনটা মনে করেন না। তাঁদের আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্তের পিছনে বহু কারণের কথা উঠে এসেছে আগেও। মিমির বন্ধু এবং হিতৈষীরা মনে করেন, একাধারে সফল অভিনেত্রী এবং ব্যস্ত রাজনীতিক মিমির সাফল্য দেখে যাঁরা ঈর্ষা করেন, তাঁরাই এমন সব কথা রটান। তিনি পরিবার এবং পরিবারিক ভাবনায় যথেষ্ট বিশ্বাসী। বন্ধুদের সন্তানদেরও খুব ভালবাসেন।

সেরিনা উইলিয়ামসের সিদ্ধান্ত ঠিক এ সবের উল্টো পিঠের কথা বলে। টেনিস থেকে অবসর ঘোষণা করছেন পরিবারে মন দেবেন বলে। এক সন্তানের মা তিনি। দ্বিতীয় সন্তান চান। বয়স ৪০। খুব বেশি সময় নেই হাতে। আগের সন্তানের জন্মের সময়ে সমস্যা হয়েছিল। অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন খেলতে গিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছিল। ধকল নিতে পারেনি শরীর। এ বার আর তেমনটা চান না।

সাধারণের চোখে সেরিনার জীবন রূপকথার মতো। ২৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম। চারটি অলিম্পিক্স সোনা। কম বয়স থেকেই অঢেল সাফল্য। এখন তাঁর ছোটবেলাও রীতিমতো গল্পকথা। হলিউডের ‘কিং রিচার্ড’ ছবি সেরিনা ও দিদি ভিনাসের বড় হওয়ার গল্পই তুলে ধরেছে।

যেমন দাপটের সঙ্গে খেলেন সেরিনা, কোর্টের বাইরেও তেমনই দাপুটে। স্পষ্ট বচন। স্বচ্ছ মতামত। তাঁর ব্যক্তিত্ব গোটা বিশ্বে কম মহিলাকে অনুপ্রেরণা জোগায়নি। পরের মাসে ইউএস ওপেন জিতে গেলে পেশাগত জীবনেও আসতে পারে রূপকথার মতো সমাপ্তি।

সেরিনার অবসর অবশ্য রূপকথা নয়। বরং তাঁর কাহিনি বলে, রূপকথার তারকাদের বাস্তব সাধারণের চেয়ে আলাদা হতে পারেনি। সেরিনা আরও কোটি কোটি পেশাদার মহিলার কথা বলেন। যেমন এক সহকর্মীর কাছে শুনেছিলাম তাঁর মাতৃত্বকালীন ছুটির সময়ে মানসিক টানাপড়েনের কথা। বলেছিলেন, সন্তানকে দেখে আনন্দ হত। মাতৃত্বের অনুভূতি দারুণ লাগত। কিন্তু কাজের জায়গা ছেড়ে দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকতেও অস্বস্তি হত। মনে হত, নিজের তৈরি করা কত কী হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে! কত কাজ নিজে করতে পারতেন, কিন্তু অন্যদের করতে দিতে হচ্ছে। পিছিয়ে পড়ছেন যেন।

সেরিনার কি আর অন্য রকম মনে হবে?

আমার সেই সহকর্মী তবু ছ’মাস পর অফিসে ফিরেছিলেন। সেরিনা তো আর কখনও খেলার মাঠে ফিরবেন না। নিজের অবসরের সিদ্ধান্তের ঘোষণা করার সময় বলেছেন, টেনিস ও পরিবারের মধ্যে কোনও একটিকে বেছে নিতে হবে, এমন চাননি। কিন্তু বাধ্য হয়েছেন নিতে। বলেছেন, ‘‘এটা তো হওয়া উচিত নয়। আমি যদি পুরুষ হতাম, তবেই তো এ নিয়ে লিখতে হত না। কারণ, তখন আমি খেলায় ব্যস্ত থাকতাম আর জিততাম। অন্য দিকে, পরিবার বড় করার জন্য যে শারীরিক শ্রম দিতে হয়, তা দিতেন আমার স্ত্রী।’’ অর্থাৎ, পুরুষ হলে কোনওটিই ছাড়তে হত না। সবই পাওয়া যেত।

সেরিনা যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা গোটা বিশ্বের কত মহিলা যে নিত্যদিন নিচ্ছেন! সেরিনা তবু বলতে পেরেছেন, এমন সিদ্ধান্ত ন্যায্য নয়। অনেকেই এ কথা বলার জায়গায় নেই। সেরিনার কাজ কঠিন। রোজের ট্রেনিংয়ে কায়িক শ্রম দিতে হয় অনেক। কিন্তু যাঁদের সেরিনার মতো নিয়মিত ট্রেনিংয়ের ঝামেলা থাকে না, হয়তো শুধু ট্রেনে যাতায়াত করতে হয়, বাকি কাজ অফিসে বসেই সারা যায়, এমন সিদ্ধান্ত এখনও নিতে হয় তাঁদের অনেককেও।

তার মানে কি কোনও নারী দু’হাতে সামলাননি কর্মজীবন এবং পরিবার? একসঙ্গে? সামলেছেন। সে তালিকায় বহু পরিচিত নাম আছে। শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত আছেন। আছে অজস্র অপরিচিত নামও। কেউ শিক্ষকতা করেছেন। কেউ কর্পোরেটে কাজ করেছেন। কেউ নিজের ছোট্ট সন্তানকে বাড়িতে রেখে অন্যের বাড়ির শিশুর দেখভালের দায়িত্ব সামলেছেন। কোনও দিকে কম সময় দিতে পারলে নিজেকেই তাঁরা অপরাধী মনে করেছেন। সমাজও তেমনই মনে করেছে। মনে করিয়েছে।

আমার মায়ের কথাই ধরা যাক। দুই সন্তান। স্কুলে পড়াতেন। প্রিন্সিপাল পদে কাজ করেছেন। দু’দিকই তো সমান তালে সামলেছেন। কিন্তু মাকে কতটা দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে, তা দেখেছি। এ দায়িত্ব মেয়েদেরই নিতে হয়।

আলিয়া ভট্ট অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অভিনয় করবেন কি না, তা নিয়ে চর্চা হয় সে কারণেই। পরিস্থিতির পরিবর্তন যে হয়নি, তা বোঝার জন্য আবারও উদাহরণ তৈরি হল। সেরিনার বক্তব্য সেটা স্পষ্ট করে দিল। এক বার অন্তঃসত্ত্বা থাকার সময়ে শারীরিক সমস্যা অনেক ভুগিয়েছে। আবারও তা তিনি চান না। তাই কাজ ছাড়বেন। পৃথিবীর সবচেয়ে সফল নারীদের মধ্যে একজনকেও তাই ভাবতে হয়। তবে এত প্রগতির পরেও আসলে মহিলাদের নিজেদের সবটা হয় না? সময় তাঁদের হাতে নেই। মেয়েদের সময় তাঁদের নিজেদের নয়।

সেরিনা স্পষ্ট বলছেন, তিনি সেই মেয়েটিকে ‘মিস’ করবেন, যিনি এক কালে টেনিস খেলতেন। সেরিনা বলছেন বলে তবু সে কথা কানে বাজছে। আশপাশে কত মহিলা আছেন, যাঁরা মাঝপথে লেখাপড়া ছেড়েছেন। কেউ বাদ দিয়েছেন কাজ, খেলা। সব। হয়তো বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় পর্যন্ত পান না। সেরিনার মতো তারকাকেও সেই তাঁদের দলে পড়তে হয়।

সকলে অবশ্য বিষয়টি একই ভাবে দেখেন না। যেমন লেখক তিলোত্তমা মজুমদার মনে করেন, ছেলেদের আর মেয়েদের প্রাপ্তি ও ভাবে দাঁড়িপাল্লায় মাপা যায় না। ঠিক যেমন মাপা যায় না তাঁদের দায়িত্বও। তাঁর কথায়, ‘‘মা ও সন্তানের আলাদা যোগাযোগ থাকে। সেই প্রাপ্তি মায়েরই।’’ ফলে মাতৃত্ব একেবারেই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। পেশাগত দায়িত্বকে কে কতটা প্রাধান্য দেবেন, তা তো তিনিই ঠিক করেন। তিলোত্তমার বক্তব্য, ‘‘পেশা ও ব্যক্তিগত জীবনে চাহিদার জায়গাগুলিতে তুলনা আদৌ হয় কি না, তা বলা কঠিন। আমি খালি একটি জিনিসেই বিশ্বাস করি না। তা হল কারও উপরে কিছু চাপিয়ে দেওয়া। অর্থনৈতিক ভাবে যে সব মেয়ে স্বাবলম্বী নন, তাঁদের এই সমস্যা আছে। অনেকের উপরেই পরিবারের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যিনি স্বাবলম্বী, তাঁরা অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি কী ভাবে নিজের পরিবারের দেখভাল করবেন, তা তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তার পক্ষে বা বিপক্ষে কারও মত দেওয়ার থাকে কি?’’

অর্থবানরা নানা ভাবে সন্তানলাভ করেন আজকাল। যেমন, সারোগেসি বেশ জনপ্রিয়। অর্থাৎ, নিজে গর্ভধারণ না করেও মা হচ্ছেন কেউ কেউ। নিজে গর্ভধারণ করেও অনেক মেয়ের আবার সে ভাবে নিতে হয় না দায়িত্ব। ‘ক্রাউন’ নামক ওয়েব সিরিজটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের মনে থাকবে সে কথা। ইংল্যান্ডের রানির দায়িত্ব ছিল সন্তানের জন্ম দেওয়া। কিন্তু সন্তান বড় করার দায়িত্ব সামলেছেন পেশাদার লোকজন। রানি তখন ব্যস্ত থেকেছেন দেশ শাসনের কাজে। তবে কারও কারও বক্তব্য, পরিবারের যত্ন যথেষ্ট না হলে পরবর্তীকালে তাতে ভাঙনও ধরে। যেমন ওই সিরিজে রানির পরিবারের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে।

বিজ্ঞানেও একটি কথা আছে। ‘এভলিউশন’। বিবর্তন। এতে মহিলাদের একটি বিশেষ দায়িত্ব আছে। ডারউইন সাহেব অমূল মন্ত্র দিয়ে গিয়েছেন। যে কোনও প্রাণী একটি মাত্র মন্ত্রের দ্বারা চালিত। সচেতন ও অচেতন ভাবে তাদের একমাত্র লক্ষ্য হল প্রাণের সংরক্ষণ করা। বেদবাক্য অভ্রান্ত না-ও হতে পারে। কিন্তু ডারউইনের এ বাক্য অভ্রান্ত। অন্তত এর বিরুদ্ধে কোনও যুক্তি কেউ দিতে পারেননি।

সেরিনা স্পষ্ট বলছেন, তিনি সেই মেয়েটিকে ‘মিস’ করবেন, যিনি এক কালে টেনিস খেলতেন।

সেরিনা স্পষ্ট বলছেন, তিনি সেই মেয়েটিকে ‘মিস’ করবেন, যিনি এক কালে টেনিস খেলতেন।

নারীরাই এই মন্ত্রের প্রধান পুরোহিত। জৈবিক ভাবে। সন্তানকে গর্ভে ধরা। তার জন্ম দেওয়া। তাকে পালন করা। এ সবের মধ্যে পুরুষদের তেমন কোনও ভূমিকা নেই। এত কাল মহিলারা তাঁদের ব্যক্তিস্বার্থের উপর সমষ্টিগত স্বার্থকেই জায়গা দিয়ে এসেছে। কেউ স্বেচ্ছায়। কেউ বাধ্য হয়ে। যেমন সীতাদের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়। রামদের কোনও অপরাধ হয় না।

কিন্তু দিনকাল পাল্টেছে। শিক্ষা, প্রযুক্তির প্রসার মেয়েদের স্পর্শ করেছে। নারীপন্থীরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁরা জীবনের অন্য ঐশ্বর্য থেকে বঞ্চিত হবেন কেন? তাঁরা বলেন, পুরুষদের শাসিত সমাজে পুরুষরাই নিয়ম করেন। তার পর নারীদের তা মানতে বাধ্য করেন। ফলে মাতৃত্ব লাভের পথ বদলেছে। সারোগেসি এসেছে। দত্তক নেন অনেকে। এ ভাবে সমকামীরাও অভিভাবক হচ্ছেন। কর্ণ জোহর যেমন একাই দুই সন্তানকে বড় করছেন।

বিজ্ঞানই অন্তরায় ছিল। এখন বিজ্ঞান পথ দেখাচ্ছে। কর্ণর মতো প্রিয়ঙ্কা চোপড়াও সারোগেসির মাধ্যমে মা হয়েছেন। আগামীতে হয়তো আরও প্রচলিত হবে এই পথ। মেয়েদের জীবন কিছুটা হয়তো সহজ হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy