স্কুল-কলেজে বাকিদের সঙ্গে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পড়ুয়ারা কি পড়াশোনা করতে পারে? তিন বছর স্নাতক স্তরে এমন এক ছাত্রকে পড়িয়ে কলেজের অধ্যাপক জানাচ্ছেন, সেটা দিব্যি সম্ভব।
একটু সহযোগিতা পেলেই বাকিদের সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারবে ছেলেটি। তাই আমরা চেষ্টা করে দেখতেই পারি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
এ বছরের অটিজিম সচেতনতা দিবসে মূলধারার মধ্যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলার প্রসঙ্গ এসেছে। সমাজে তাঁদেরও যাতে সমান জায়গা তৈরি হয়, সেই ভাবনা থেকেই এমন প্রসঙ্গ। অভিভাবকরা তাঁদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের বাকিদের সঙ্গে সাধারণ স্কুলে পড়াশোনা করাতে কতটা আত্মবিশ্বাসী সেই নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কোনও প্রতিষ্ঠান পরিকাঠামোর অভাব দেখিয়ে কোনও অটিস্টিক পড়ুয়াকে ভর্তি নেবে কি না, তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট নীতি সে ভাবে নেই। তাই বাস্তবে তারা কী করছে? শহরের এক বেসরকারী গণমাধ্যম বিষয়ক কলেজের অধ্যাপক অন্বেষ বিলাস ঠাকুর তার কর্মজীবনে এমন এক ছাত্র পেয়েছিলেন। তিনি কী ভাবে এগিয়েছিলেন প্রশ্ন করায়, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা জানালেন।
তিনি বললেন, ‘‘আমাদের কাছে যখন এমন এক পড়ুয়ার ভর্তির আবেদন জমা পড়ে, তখন শিক্ষকরা আলোচনা করেন কী করা যায়। তখন তাঁর বাবা-মাকেও ডেকে পাঠানো হয়। মুখোমুখি বসে আলোচনা করা হয় সব রকম সুবিধা-অসুবিধা। জানতে চাওয়া হয় ওঁদের সন্তানের ঠিক কোন ধরনের সমস্যা হয়। ওঁরা জানান, তাঁদের সন্তানের মনোযোগের অভাব স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। আর খুব বেশি আওয়াজে তাঁর অসুবিধা হয়। মাঝেমাঝে একটু নিজের মনে কথা বলেন সেই পড়ুয়া। আর লেখার সময়ে কখনও কখনও অক্ষরগুলি লাইনের বাইরে বেরিয়ে যায়। সব শুনে মনে হয়েছিল, একটু সহযোগিতা পেলেই বাকিদের সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারবে ছেলেটি। তাই আমরা চেষ্টা করে দেখতেই পারি।’’
অন্বেষ সেই সময়ে বাকি শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেন, তাঁরা কী ভাবে পড়াবেন। কখনওই যাতে তাঁর সঙ্গে চড়া গলায় কেউ কথা না বলে, তা নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। বাকি ছাত্রছাত্রীকেও জানানো হয় এমন এক সহপাঠীর কথা। তাঁরা অবশ্য প্রথম থেকেই এই বিষয়ে যথেষ্ট সহমর্মিতা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষকদের পড়াতে কতটা অসুবিধা হয়েছিল? তাঁদের কি বিশেষ ভাবে কোনও রকম প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল?
উত্তরে অন্বেষ জানালেন, কোনও রকম বিশেষ প্রশিক্ষণ তাঁরা পাননি। পেলে হয়তো সুবিধাই হতো। তাঁরা পড়াতেন নিজের মতো করে, ধৈর্যের সঙ্গে, ধীরে ধীরে। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমে আমি ওকে কোনও রকম বাড়ির কাজ দিতাম না। খালি বলতাম পাঠ্যক্রমের একটা করে পাতা মুখস্ত করে আনতে। কিছু দিন পর সে যখন পাঠ্যক্রমে কী কী রয়েছে তা বলতে পারল, তখন যে বিষয়গুলো ও প্রথমে বলত, সেগুলোই ধীরে ধীরে পড়ানো শুরু করলাম। আলাদা করে বসতাম ওর সঙ্গে। অল্প অল্প করে পড়াতাম। লেখার জন্য ছোটদের মতো কার্সিভ রাইটিংয়ের লাইন টানা পাতা দেওয়া হতো।’’
অন্বেষের স্ত্রী ছোটদের প্রি-স্কুলের শিক্ষিকা। যখন অন্বেষ বুঝতে পারেন, তাঁর ছাত্রের বয়স ১৯ হলেও তাঁর বোঝার ক্ষমতা ৫-৬ বছরের শিশুদের মতোই, তখন তিনি তাঁর স্ত্রীয়ের পরামর্শ নিয়েছিলেন। তিনি জানতে পারেন রং, আকার বা নম্বর দেখালে বাচ্চারা তাড়াতাড়ি শেখে। তাই সেই পদ্ধতিতেই অন্বেষ ফোটোগ্রাফি ক্লাসে ডিএসএলআর ক্যামেরা দেখাতেন, সাংবাদিকতার ক্লাসে খবর কাগজ দেখাতেন। ‘‘ও কিন্তু ধীরে ধীরে সবই বুঝতে পারল, ধরতেও পারল। পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়েছিল। প্রথম দিকে যে বিষয়গুলোর পরীক্ষায় সে পাস করতে পারেনি, পরে সেই পরীক্ষা ফের দিয়ে ভালই ফল করেছিল,’’ শিক্ষক বললেন গর্বের সঙ্গে।
যে পদ্ধতিতে পড়ানো হয়েছিল, তা কেউ শিখিয়ে দেয়নি। গোটাটাই আন্দাজের ভিত্তিতে। কখনও কখনও ধৈর্য হারিয়ে ফেলতেন শিক্ষকরা। কারণ কলেজের পড়ুয়াদের বোঝার ক্ষমতা এবং সেই মতো পড়াশোনা করার ক্ষমতা নিয়ে এক ধরনের স্বাভাবিক প্রত্যাশা থাকে যে কোনও শিক্ষকেরই। কিন্তু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পড়ুয়ারা যে একটু আলাদা হবে তা-ও স্বাভাবিক। শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি এ বিষয়ে খানিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে, তা হলেই অটিজমে আক্রান্ত পড়ুয়ারাও সহজে উচ্চশিক্ষা পেতে পারেন, এমনটাই মত অন্বেষের।
কিন্তু কলেজ মানে তো শুধু শিক্ষক নয়, রয়েছেন বাকি সহপাঠীরাও। তাঁরা কী ভাবে দেখেন বিষয়টা। এতটা ধৈর্য কি তাঁদেরও থাকে? অন্বেষ জানালেন, তাঁর অভিজ্ঞতায় এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি সচেতন। তাঁর কোনও রকম অসুবিধাই হয়নি। তাঁরা খুবই সামলে রাখতেন তাঁদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সহপাঠীকে। ক্যান্টিনে গেলে সে যন সময়ে ক্লাসে ফেরে, এদিক-ওদিক না চলে যায়, ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া করে, সব বিষয়ই কড়া নজর রাখতেন তাঁরা। বন্ধুর জন্য নোট তৈরি করা, তাঁর বাড়ি পৌঁছে দেওয়া— সবই হাসিমুখে করেছেন তাঁরা।
অন্বেষের কথায়, ‘‘আমার তিন বছরের অভিজ্ঞতাই প্রমাণ করে দিয়েছে যে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় অটিস্টিক পড়ুয়াদের পড়া সম্ভব। কিছু দিন আগেই ওর বাবা আমায় ফোন করেছিলেন। কলেজের গণ্ডি পেরোতে পেরে ওর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছে। এখন ও একটি অ্যানিমেশনের কোর্সও করছে। শুনে মনটা আনন্দে ভরে গেল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy