ভারতবর্ষের প্রায় ৮ কোটি মানুষ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত।
ওঁরা ছিলেন ৪ জন, কিন্তু তার মধ্যে ফ্রেডেরিক ব্যান্টিংয়ের অবদান কিছুটা বেশি ছিল। তাই ডায়াবিটিসকে বশে রাখার ওষুধ ইনসুলিনের আবিষ্কারক হিসেবে শল্যচিকিৎসক ফ্রেডেরিক গ্র্যান্ট ব্যান্টিংয়ের নামটাই উঠে আসে। এই কারণেই ব্যান্টিংয়ের জন্মদিনে বিশ্ব জুড়ে পালন করা হচ্ছে ডায়াবিটিস ডে। আর এক বছর পরেই ইনসুলিন আবিষ্কারের শতবর্ষ। অথচ এখনও বেশির ভাগ মানুষের রক্তে শর্করার মাত্রাধিক্য নিয়ে সেভাবে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। এই কারণেই আমাদের দেশে ডায়াবিটিসের এত বাড়বাড়ন্ত।
ভারতবর্ষের প্রায় ৮ কোটি মানুষ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত, জানালেন এসএসকেএম হাসপাতালের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের প্রধান এবং রিসার্চ সোসাইটি ফর দ্য স্টাডি অব ডায়াবিটিস ইন ইন্ডিয়া-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সেক্রেটারি, ডায়াবিটিস বিশেষজ্ঞ শুভঙ্কর চৌধুরী। ২০১৫–২০১৯ এই চার বছর ধরে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে নয়া দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস (এইমস) এবং রাজেন্দ্র প্রসাদ সেন্টার ফর অপথ্যালমিক সায়েন্সের যৌথ সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ১১.৮ শতাংশ ডায়াবিটিস নিয়ে জীবন ধারণ করছেন। এই লাইফস্টাইল ডিজিজে আক্রান্তদের মধ্যে ১২% পুরুষ ও ১১.৭% নারী। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবিটিস ফেডারেশনের হিসেব অনুযায়ী বিশ্বের ২০–৭৯ বছর বয়সি ৪৬ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ ডায়াবিটিসে ভুগছেন।
শুভঙ্কর চৌধুরী জানালেন যে, এই বছর ডায়াবিটিস ডে-তে প্রত্যেকের কাছে চিকিৎসকদের আবেদন, আজ আলোর উৎসব দীপাবলিতে দয়া করে কেউ বাজি পুড়িয়ে আনন্দ করবেন না। কেন না কোভিড আক্রান্তদের জন্যে তো বটেই, যাঁরা এই অসুখ থেকে সেরে উঠেছেন এবং ফুসফুসের অসুখে ভুগছেন তাঁদের জন্য বাজির ধোঁয়াযুক্ত বাতাস বিষের মতো। তাই দয়া করে বাতাসকে আরও দূষিত করে তুলবেন না। কথা প্রসঙ্গে শুভঙ্কর চৌধুরী জানালেন যে, সমীক্ষায় জানা গেছে দূষিত বাতাসও ডায়াবিটিস ডেকে আনতে পারে। তাই পরিবেশ ভাল রাখতে আমাদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত। এ দেশে মৃত্যুর প্রথম ১০টি কারণের মধ্যে অন্যতম টাইপ টু ডায়াবিটিস।
আরও পড়ুন: নিউমোনিয়া থেকে বাঁচাতে পারে পরিচ্ছন্নতা আর টিকা
শুভঙ্কর জানালেন যে, ডায়াবিটিসের মোকাবিলায় নার্স বা সেবিকাদের ভূমিকার কথা সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাই এই বছরের ডায়াবিটিস ডে-র থিম হিসেবে ‘ডায়াবিটিস— নার্সেস মেক দ্য ডিফারেন্স’— এই শপথবাক্যের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ডায়াবিটিস কোভিডের অন্যতম কোমর্বিডিটির কারণ। তাই ডায়াবিটিস থাকলে কোভিড-১৯ ভাইরাস এড়িয়ে চলার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ডায়াবিটিস সম্পর্কে কিছুটা সচেতনতা বেড়েছে, তাই সমস্যা হলে অনেকেই ব্লাড সুগার পরীক্ষা করিয়ে নিচ্ছেন। আবার রুটিন ব্লাড টেস্ট করাতে গিয়ে অনেকেরই রক্তে বাড়তি শর্করা ধরা পড়ছে। কিন্তু এখনও প্রচুর মানুষ এই মারাত্মক লাইফস্টাইল ডিজিজ নিয়ে বিন্দুমাত্র সচেতন নন।
টাইপ টু ডায়াবিটিসের নানা কারণের মধ্যে অন্যতম হল বেশি ওজন ও ২৭-এর বেশি বিএমআই, বললেন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সেমন্তী চক্রবর্তী। যদি ভুঁড়ি বেড়েই চলে, তা হলে টাইপ টু ডায়াবিটিসের ঝুঁকি বহু গুণ বেড়ে যায়। আমাদের দেশের মানুষজনের মধ্যে ভুঁড়ির প্রবণতা বেশি, তার সঙ্গে অতিরিক্ত ভাত ও ভাজাভুজি খাওয়ার ফলে অল্প বয়স থেকেই মেদ জমতে শুরু করে। ভাবছেন, শরীরে চর্বি জমার সঙ্গে রক্তের শর্করা বেড়ে যাওয়ার কী সম্পর্ক! আসলে ওজন বাড়লে ভুঁড়ি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পেটের অভ্যন্তরে লিভার ও প্যাংক্রিয়াসেও মেদ জমে যায়। এর ফলে এই সব অঙ্গের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে প্যাংক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইনসুলিনই যে আমাদের রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্রিয় ভুমিকা নেয়, তা সকলেরই জানা। ইনসুলিন কমে গেলে ব্লাড সুগার বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। ইদানীং আমাদের দেশে বাচ্চাদের মধ্যেও খেলাধুলোর অভাবে ওজন বেড়ে যাবার সমস্যা বাড়ছে। তাই ২০ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যেও টাইপ টু ডায়াবিটিসের হারও বাড়ছে।
কোনও সমস্যা থাকুক না থাকুক, বছরে এক বার অন্তত রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা দরকার।
সেমন্তী জানালেন যে, বাবা-মা অথবা দাদু-দিদিমা বা ঠাকুর্দা-ঠাকুমা সহ পরিবারে ডায়াবিটিসের ইতিহাস থাকলে রোগের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। এক সমীক্ষায় জানা গেছে যে, মা, মামা ও দিদিমার টাইপ টু ডায়াবিটিস থাকলে সন্তানদের অসুখের ঝুঁকি ৫০ %। অন্য দিকে, শুধু মা অথবা বাবার কোনও এক জনের এই অসুখের ইতিহাস থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের অসুখের সম্ভাবনা ৩২%। তবে বাবা ও মা দু’জনেরই কম বয়সে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি হলে সন্তানদের রোগের ঝুঁকি প্রায় ৭০%। তাই যাঁদের বংশে এই অসুখের ইতিহাস আছে, তাঁদের উচিত ওজন স্বাভাবিক রাখা ও নিয়মিত এক্সারসাইজ করা। আর কোনও সমস্যা থাকুক না থাকুক, বছরে এক বার অন্তত রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা দরকার।
আরও পড়ুন: কেন প্রবীণদের চেয়ে শিশুরা কম আক্রান্ত হয় কোভিডে, জানাল গবেষণা
সেমন্তীর মতে, ছোট থেকে নিয়ম করে গা ঘামিয়ে খেলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। অল ওয়ার্ক অ্যান্ড নো প্লে প্রকৃত অর্থেই একজন বাচ্চাকে ডাল করে তুলতে পারে। কেন না সপ্তাহে কমপক্ষে পাঁচদিন নিয়মিত এক ঘন্টা করে ছোটাছুটি করে খেললে একদিকে কার্ডিওরেসপিরেটরি ফিটনেস বাড়ে, অন্য দিকে মস্তিষ্কেও রক্তচলাচল বাড়ে বলে ক্ষিপ্রতা এবং বুদ্ধিও বাড়ে। খাওয়ার ব্যপারেও মায়েদের সচেতন হতে হবে। শিশু যখন শক্ত খাবার খেতে শুরু করে, তখন থেকেই তাদের পুষ্টিকর খাবারে অভ্যস্ত করতে হবে। কেক, বিস্কুট, ইনস্ট্যান্ট নুডলস সহ অন্যান্য ফাস্ট ফুডের অভ্যেস গড়ে তুলবেন না। পরিবর্তে টাটকা ফল, সবজি, রুটি সহ বাড়িতে তৈরি খাবার দেওয়া উচিত।
বংশে থাকুক বা না থাকুক, ওজন বাড়লে টাইপ টু ডায়াবিটিস, ব্লাড প্রেশার সহ মেটাবলিক সিনড্রোমের ঝুঁকি বাড়ে। পৃথিবী জুড়ে বাচ্চাদের মধ্যে ওবেসিটি বাড়ছে। তাই বেশ কিছু দেশের স্কুলে স্কুলে ওজন কমাতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জাপানে ওভার ওয়েট বাচ্চাদের ক্লাস শুরু হওয়ার ৪৫ মিনিট আগে স্কুলে পৌঁছতে হয়। সেই সময়ে ওদের ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করিয়ে তার পর ক্লাসে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। স্কটল্যান্ডের স্কুলে পিৎজা, বার্গার জাতীয় ফাস্ট ফুড টিফিনে নিয়ে গেলে আপেল, ন্যাসপাতি বা কলা দিয়ে রিপ্লেস করা হয়। ওজন ঠিক রাখতে সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে আর নিয়ম করে সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন মোট ১৫০ মিনিট হাঁটতে হবে। চিনি বা মিষ্টি, কর্নফ্লেক্স, ময়দার তৈরি খাবার সহ লো গ্লাইসিমিক ইন্ডেক্স-যুক্ত খাবার খেলে ডায়াবিটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। সেমন্তীর বক্তব্য, যাঁরা ইতিমধ্যে ডায়াবিটিসে ভুগছেন তাঁদের উচিত একজন ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ মেনে রোজকার মেনু প্ল্যান করে নেওয়া। আসলে ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণের চাবি আমাদের নিজেদের হাতেই আছে। সতর্ক হতে হবে নিজেদেরই। ইচ্ছে করলে স্বাভাবিক খাবার খেয়ে নিয়ম করে এক্সারসাইজ করে ওজন ঠিক রাখলে ডায়াবিটিস সহ কোনও লাইফস্টাইল ডিজিজ আপনার নাগাল পাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy