বিদায় জানান ধূমপানকে। —সংগৃহীত চিত্র।
করোনা পূর্ববর্তী সময়ে তামাকের সমার্থক শব্দ ছিল ক্যনসার। আর এখনকার অতিমারির সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা তামাকের সঙ্গে নোভেল করোনাভাইরাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন। করোনাভাইরাসেরও খুব পছন্দ সিগারেট, বিড়ি-সহ নানান তামাকজাত নেশার জিনিস। কেননা ধুমপান করলে শ্বাসনালী ও ফুসফুসে এসিই-২ নামে এক বিশেষ রিসেপ্টরের সংখ্যা বহু গুণ বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, কোভিড ১৯ ভাইরাস আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে থাকা এসিই-২ রিসেপটরকে সরাসরি আক্রমণ করে। তাই ধূমপায়ীদের করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটাই বেশি। তাই করোনা প্রতিরোধে আজ বিশ্ব তামাক বিরোধী দিবসে ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
তামাকে আসক্তির গোড়ার কথা
যিশু খ্রিস্টের জন্মের ছয় হাজার বছর আগে তামাক গাছের জন্মের কিছু নমুনা মিলেছে। সেই সময়ে আমেরিকানরা দাঁতের ব্যথা কমাতে ও কেটে যাওয়ার ওষুধ হিসেবে তামাক পাতা ব্যবহার করতেন। ১৫৮৮ সালে ভার্জিনিয়ার টমাস হ্যারিয়েট তামাক পাতা পুড়িয়ে ধোঁয়া টেনে নতুন নেশার জন্ম দেন। সে সময়ে মুখ দিয়ে ধোঁয়া টেনে নাক দিয়ে বের করাটা পুরুষত্বের প্রতীক ছিল। টমাস হ্যারিয়েট অত্যন্ত বেশি পরিমাণে তামাকের ধোঁয়া টেনে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কিন্তু তাতেও আটকানো যায়নি ধূমপানের বিস্তার। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে তামাক পাতা দিয়ে বেচাকেনা শুরু হল। ১৯০২ সালে শুরু হল বিশ্ব বিখ্যাত সিগারেট কোম্পানি মার্লবোরো ব্র্যান্ড। তার পর বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল সিগারেট, চুরুট, পাইপ, বিড়ি-সহ তামাকের নেশার নানা সামগ্রী।
আরও পড়ুন: করোনা থেকে বাঁচাতে বাচ্চাদের মাস্ক পরা ও হাত ধোওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
নো টোবাকো ডে
সিগারেট, বিড়ি-সহ সব ধরনের তামাক থেকে বিপদের কথা জেনে ১৯৮৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৩১ মে পৃথিবী জুড়ে তামাক বিরোধী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন থেকেই বিশ্ব জুড়ে ধূমপান ও তামাকের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা প্রচার শুরু হয়। কিন্তু তাও বিশ্বের ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ তামাকে আসক্ত। এ বারের নো টোবাকো ডে-র থিম ‘প্রোটেকটিং ইউথ ফ্রম ইন্ডাস্ট্রি ম্যানিপুলেশন অ্যান্ড প্রিভেন্ট দেম ফ্রম টোব্যাকো অ্যান্ড নিকোটিন ইউজ’। আসলে অন্যান্য দেশের তরুণ প্রজন্ম এ বিষয়ে অনেক সচেতন। কিন্তু আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এখনও সিগারেটের প্রেমে মগ্ন। তামাককে জীবন থেকে বিদায় না করতে পারলে করোনা, হার্টের নানা অসুখ আর ক্যানসারের ত্র্যহস্পর্শে দেশের ভাবীকাল ধুঁকতে থাকবে।
তামাকের ধোঁয়ার ক্ষতি
নানা ধরনের ক্যানসার থেকে শুরু করে হার্টের অসুখ, বুদ্ধিনাশ, অকাল বার্ধক্যের মতো নানা ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে তামাকের, বললেন মেডিসিন ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার চিকিৎসক দীপঙ্কর সরকার। নিকোটিন ছাড়াও সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা নানা ক্ষতিকর রাসায়ানিকের প্রভাবে মস্তিষ্কের বাইরের দিকের স্তর কর্টেক্স (এর আর এক নাম গ্রে ম্যাটার) ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। এডিনবার্গ ও ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক সমীক্ষা করে এর প্রমাণ পেয়েছেন। প্রায় ৫৫০ জন ধূমপায়ীর মস্তিষ্কের এমআরআই করে দেখা গিয়েছে, অধুমপায়ীদের তুলনায় তাঁদের গ্রে ম্যাটারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছে। প্রসঙ্গত সেরিব্রাল কর্টেক্স অর্থাৎ মস্তিষ্কের বাইরের স্তর মোট মস্তিষ্কের দুই তৃতীয়াংশ এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সিগারেটের ধোঁয়ার ক্ষতিকর রাসায়ানিকের প্রভাবে ব্রেনের গ্রে সেল ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। কর্টেক্স বা গ্রে ম্যাটার ব্রেনের সব থেকে উন্নত অংশ। এই অংশই আমাদের বুদ্ধি, ভাবনা চিন্তার শক্তি, কথা বলা ও বোঝা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা-সহ বিভিন্ন মানসিক বিকাশের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। তাই এই অংশের ক্ষয় হলে সামগ্রিক ভাবে বুদ্ধি যায় কমে।
আরও পড়ুন: প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে লকডাউন উঠলে ঘরের বাইরে যান
ধূমপানে করোনা সংক্রমণ ও অন্যান্য সমস্যা বাড়ে
· অনেক তরুণকেই বলতে শোনা যায়, ধূমপান পৌরুষের প্রতীক। চিকিৎসা বিজ্ঞান আবার উল্টো কথা বলছে। ধূমপায়ী পুরুষদের স্পার্ম কাউন্ট কমে যায়। শুক্রাণুর বিকৃত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। একই সঙ্গে পুরুষত্বহীনতা ডেকে আনতে পারে ধূমপান। পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ ধূমপান।
· মেয়েদের মা হওয়ার ক্ষমতা কমায় ধূমপান। মেন্সট্রুয়াল সাইকেল এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। মেনোপজ এগিয়ে আসে। সার্ভিক্স-সহ অন্যান্য ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়ে।
· শ্বাসনালী আর ফুসফুসের সব থেকে বেশি ক্ষতি করে সিগারেটের ধোঁয়া। শ্বাসনালীর ওপরের আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্দি, হাঁচি, কাশির পাশাপাশি বার বার শ্বাসনালীর সংক্রমণ হয়। ফুসফুসের কাজ করার ক্ষমতাও কমে যায় বলে জানালেন দীপঙ্করবাবু।
· কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, লেড-সহ অজস্র মেটাল এবং বিভিন্ন তেজষ্ক্রিয় পদার্থ থাকে সিগারেট, বিড়ির ধোঁয়ায়। এদের মধ্যে বেশির ভাগ রাসায়ানিকই ক্যানসার উদ্দীপক।
· তামাক আর ক্যানসার প্রায় সমার্থক। নাক, কান, গলা, মুখের মধ্যে ও জিভের ক্যানসারের সঙ্গে সঙ্গে গলা, স্বরযন্ত্র, ফুসফুস ইত্যাদি বিভিন্ন অঙ্গের ক্যানসারের অন্যতম কারণ তামাক।
· ঘ্রাণশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকে।
· রক্তচাপ ও হার্ট রেট বেড়ে যায় তামাক সেবনে।
· রক্তনালীর সংকোচনের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ায় শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
· রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। একই সঙ্গে রক্ত অতিরিক্ত চটচটে হয়ে যাওয়ায় জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ে। ফলস্বরূপ হার্ট অ্যাটাক হয় ও মস্তিষ্কে সমস্যা হয়।
· ধূমপান নিউমোনিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
· ত্বকে বয়সের ছাপ পড়ে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই।
· চোখের নানা সমস্যা-সহ অন্ধত্বের আশঙ্কা বাড়ে।
· মাড়ি ও দাঁতের অসুখের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
· বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।
তাই নিজের ও পরিবারের স্বার্থে তামাককে জীবন থেকে গুডবাই করে ভাল থাকুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy