অঙ্ক কষে বা হিসাব করে প্রেম হয়?
২৩ বছরের শ্রেয়সী চক্রবর্তী মনে করেন, হিসাব কষে প্রেম হয়। তাঁর ক্ষেত্রে অন্তত জীবনসঙ্গীকে বেছে নেওয়ার সময়ে হিসাব করতে অসুবিধা হয়নি। আর সেই হিসাব তিনি করেছেন একেবারে নিরপেক্ষ ভাবেই। শ্রেয়সী বলছেন, ‘‘আমি দেখেছিলাম দায়িত্ব নিতে পারে কি না, আমার পরিবারের সঙ্গে কী ভাবে কথা বলছে, বাইরে বেরোলে আমার যত্ন নিচ্ছে কি না।’’ শ্রেয়সী এখন ঘোর সংসারী। পাঁচ বছর হল বিয়ের। এক সন্তানের মা তিনি। বাড়ি থেকে দূরে স্বামীর কর্মক্ষেত্রে নিজের মতো সংসার পেতেছেন। তাঁকে প্রশ্ন করা গেল, যদি সেই সময়ে হবু জীবনসঙ্গীর মধ্যে কোনও ‘মন্দ স্বভাব’ চোখে পড়ত, তা হলে কি পিছিয়ে আসতেন? শুনে তাঁর জবাব, ‘‘আসতাম। আমার কাছে একটা বড় ভয়ের বিষয় ছিল, জীবনসঙ্গী আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবেন কি না, বা তিনি একসঙ্গে একাধিক মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে থাকছেন কি না। কারণ, আমি তেমন হতে দেখেছি। আমার ক্ষেত্রে সেটা হলে আমি আর এগোতাম না।’’
শ্রেয়সীর থেকে বয়সে বেশ খানিকটা বড় শম্পা বসু সরকার। তাঁর বয়স ৫৭। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন। তিনিও কি প্রেমে পড়ার আগে অঙ্ক মিলিয়ে নিয়েছিলেন? শম্পার জবাব, ‘‘আমাদের প্রেম ছিল সাবধানি। তখন এমন হুটহাট প্রেম করলেই বিয়ে হত না। বাড়িতে সেই ছেলেটিকে নিয়ে যাওয়ার মতো কি না, তা দেখতে হয়েছিল। বাবা-মা দু’জনেই রক্ষণশীল ছিলেন। তাই সম্পর্ক এগোনোর আগে ভেবে দেখেছিলাম, এই ছেলেটিকে কি নিয়ে গিয়ে বাবা-মায়ের সামনে দাঁড় করাতে পারব? আর দেখেছিলাম, ছেলেটি দায়িত্ব নিতে পারবে কি না।’’ সে সবই হয়েছিল। যদিও শম্পার সেই প্রেম থাকেনি। দেখেশুনে পরে অন্যত্র বিয়ে হয়। কিন্তু তা বলে বেহিসাবি প্রেমের পক্ষে নন তিনি। মনে করেন, জীবনসঙ্গীর গুণ বিচার করে নেওয়াই উচিত। কিন্তু তা বলে কি সবাই হিসাব করেন? এই যে প্রথম দেখার প্রেম, তা কি শুধুই কথার কথা?
রূপা সিংহের কাহিনি কিন্তু তা বলছে না। তিনিও মধ্যবয়সি। সেই সময়ের মানুষ, যখন অনেক সময়ে পাত্রপাত্রীর প্রথম দেখা হত ছাঁদনাতলাতেই। তাঁর ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন হয়নি। পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানে মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছিলেন। ভাল লেগে গিয়েছিল প্রথম দেখাতেই। রূপা বলছেন, ‘‘দেখতে ভাল তো লেগেছিলই, কথাবার্তা বলেও ভাল লাগে। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছিলাম। সেই শূন্যতা ছিল। মানুষটিকে যে দিন প্রথম দেখলাম, খেয়াল করলাম, সব কাজ একাই সামলাচ্ছেন, দায়িত্ব নিয়ে সব করছেন। প্রথম পরিচয়ে আমার সঙ্গে খুব ভাল ভাবে কথা বললেন। আমার মনে হয়েছিল, ওঁরও নিশ্চয়ই আমাকে পছন্দ হয়েছে। প্রেমে পড়তে দেরি হয়নি।’’ খুব একটা কিছু না ভেবেই সম্পর্ক শুরু হয় রূপাদের। কিন্তু তার পরে যদি সঙ্গীর কোনও স্বভাব ভাল না লাগত, তা হলে? রূপার বক্তব্য, ‘‘সে তো হতেই পারত। হয়েছেও। এত বছরে অপছন্দের কিছুই কি হয়নি? কিন্তু মানুষটাকে যে হেতু ভালবেসেছি, তাই মানিয়ে নেওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। হয়তো তিনিও আমার ক্ষেত্রে তা-ই করেছেন,’’ বলছেন রূপা।
অর্থাৎ, হিসাব মিলিয়ে যেমন প্রেম হয়, তেমনই কোনও কোনও প্রেমের অঙ্ক মেলেও না। কিন্তু ধরুন, নিজের পছন্দ-অপছন্দ বিচার করেই সম্পর্কে জড়ালেন। সবুজ সঙ্কেত পেয়ে প্রেমের সম্পর্ক এগিয়েও গেল খানিকটা। তার পরে আবিষ্কার করলেন পছন্দের মানুষটির কোনও নেতিবাচক দিক।
বস্তুত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতিবাচক দিক ধরা পড়ে সম্পর্ক খানিক সড়গড় হওয়ার পরেই। কারণ, প্রেমের শুরুতে প্রেমিক অথবা প্রেমিকা উল্টো দিকের মানুষটির উপর এতটাই স্নেহবর্ষণ করেন যে, তার আড়াল পেরিয়ে অন্য কিছু দেখতে পায় না স্নেহপিপাসু মন। প্রাথমিক আবেগবাহুল্য কাটলে ধীরে ধীরে নজর স্বচ্ছ হয়। তখন চোখে পড়ে উল্টো দিকের মানুষটির সেই সব বৈশিষ্ট্য, যা আগে চোখে পড়েনি। সব ক্ষেত্রে সেই সব বৈশিষ্ট্য অপছন্দই হবে, তা নয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিসাব মিলিয়ে এগিয়েও ঘটে যায় দুর্ঘটনা! প্রেমের গাড়ি ঝমঝমিয়ে চলতে চলতে মাঝপথে গোত খায়। দেখে ভুল পথে চলে এসেছে। তখন কী করণীয়? যে মানুষটিকে পছন্দ হয়েছিল, যাঁর সঙ্গে মানসিক ভাবেও জড়িয়ে পড়েছেন, তাকে কি হিসাব মেলেনি বলেই এক কথায় বিদায় জানানো উচিত?
সাবধানিরা বলবেন হিসাবের বাঁধা গৎ মেনে চলাই ভাল। অপছন্দের স্বভাব আছে জেনেও সম্পর্কে এগিয়ে যাওয়াটা নিছক বোকামি। অযথা ক্ষতির পাল্লা ভারী করা। সময় নষ্টও বটে। মনোবিদেরা কিন্তু বলছেন, সঙ্গীর ‘মন্দ স্বভাব’ দেখলেই মুখ ফেরাতে হবে, এমন নয়। বরং তেমন সমস্যা যদি হয়ই, তবে নিজেকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শ্রীময়ী তরফদার বলছেন, ‘‘নিজেকে প্রশ্ন করুন, উল্টো দিকের মানুষটির থেকে আপনি কী পাচ্ছেন আর কী পাচ্ছেন না। যা পাচ্ছেন না, তার পাল্লাই কি ভারী? এই প্রশ্নের জবাবের উপরেই নির্ভর করবে কী সিদ্ধান্ত নেবেন।’’

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
পাওয়া, না-পাওয়ার হিসাব কী ভাবে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গিয়েছেন, ‘‘...বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে..’’। প্রেমে চাওয়া বা পাওয়ার চেয়ে বিলিয়ে দেওয়ার কথাই যুগে যুগে বলে এসেছেন মনীষীরা। আধুনিক তত্ত্ব যদিও বলছে, চাওয়া-পাওয়া দুই মিলিয়েই প্রেম। কেউ একতরফা দিয়ে যেতে পারেন না। প্রেমে পরস্পরের কাছে প্রত্যাশা থাকেই। কেউ প্রেমিকের কাছে স্বাধীনতা, উদার মনোভাব আশা করেন। কেউ আশা করেন বাড়তি যত্ন বা একান্ত সময়। কেউ চান বাঁধা না পড়তে। কেউ চান বেঁধে রাখতে। সবই প্রত্যাশা। শুধু তার ধরন আলাদা আলাদা। শ্রীময়ী বলছেন, ‘‘দেখতে হবে আপনি যা চাইছেন, সেই চাহিদা আপনার সম্পর্ক মেটাচ্ছে কি? হয়তো আপনি সম্পর্কে নিশ্চয়তা চান। কিন্তু যাঁর সঙ্গে সম্পর্কে রয়েছেন, তিনি সেই নিশ্চয়তা দিতে নারাজ। তা হলে সম্পর্ক স্থায়ী হওয়া মুশকিল। কিন্তু যদি নিশ্চয়তাটুকু বাদ দিয়ে দেখতে পারেন, যদি দেখেন না পাওয়াটুকু বাদ দিয়ে আপনার প্রাপ্তির ঝুলিতে কম কিছু নেই, যদি সেই প্রাপ্তিটুকুই আপনার কাছে সম্পর্কে থেকে যাওয়ার জন্য ‘যথেষ্ট’ বলে মনে হয়, তবে সম্পর্কে এগিয়ে যেতেই পারেন।’’ পাভলভ হাসপাতালের মনোবিদ জয়িতা সাহা আবার বলছেন, ‘‘সম্পর্ক ভাঙবেন কি রাখবেন, সেটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে অনেকে আছেন, যাঁরা অপছন্দের স্বভাব রয়েছে দেখেও সম্পর্কে যান এবং ভাবেন, ভবিষ্যতে মানুষটিকে বদলে দিতে পারবেন। কাউকে বদলে দেওয়ার ভাবনা যেমন ঠিক নয়, তেমনই এ-ও ঠিক যে, কেউ কারও জন্য নিজের মূলগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সহজে বদলাতেও পারেন না।’’

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
সিদ্ধান্ত কি একেবারেই বদলায় না?
ভালবেসে নিজেকে বদলে ফেলার উদাহরণ নেই, তা নয়। আবার বদলাননি এমন উদাহরণও অনেক আছে। জয়িতা বলছেন, ‘‘ধরুন একটি মানুষের আগে অনেক প্রেম ছিল। সেই প্রেমের একটিও টেকেনি। হয়তো কোনও কারণেই টেকেনি। সেই কারণটি সম্পর্কে বাঁধা না পড়তে চাওয়াও হতে পারে। যদি ওই কারণ বাকিদের ক্ষেত্রে না বদলে থাকে, তবে নতুন যে সম্পর্কে তিনি জড়াচ্ছেন, সে ক্ষেত্রেও বদলে যাবে, এমন আশা করা ভুল। আবার বদলাবেন না এমনটাও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। হয়তো নতুন যাঁর সঙ্গে সম্পর্ক হল, তার মধ্যে তিনি এমন কিছু পেলেন যে, স্বেচ্ছায় বদলে ফেললেন নিজেকে। কিন্তু যে মানুষটি সম্পর্কে জড়াচ্ছেন, তিনি যদি আগে থেকেই ভেবে ফেলেন সিদ্ধান্ত বদলে দেবেন, তবে তিনি আশাহত হতে পারেন।’’
কোন ক্ষেত্রে পিছিয়ে আসার কথা ভাবতে পারেন?
সম্পর্কে পারস্পরিক সম্মানপ্রাপ্তি অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয় বলে জানাচ্ছেন দুই মনোবিদই। তবে এ-ও ঠিক যে, কোনটিকে কে সম্মানহানি হিসাবে দেখছেন, তা ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করে। শ্রীময়ীর মতে, ‘‘কেউ যদি অসম্মান করেন, শারীরিক বা মানসিক নিগ্রহ করেন এবং তা যদি সহ্য করতে না পারেন, তবে নিজে কোনটিতে ভাল থাকবেন, তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকেই। যদি মনে করেন সেই সব সহ্য করেও আপনি ভাল থাকতে পারবেন তবে তিনি সম্পর্কে থাকবেন। যদি মনে হয় কেউ আপনাকে অসম্মান করলে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে, তবে তা থেকে বেরিয়ে আসাই ভাল।’’ জয়িতা আবার বলছেন, ‘‘সম্পর্ক ভাঙা সহজ। ধরে রাখাই কঠিন। একজন মনোবিদ হিসাবে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলতে পারি না। হয়তো যিনি মানসিক নির্যাতন সহ্য করছেন, তাঁর আর কোনও আশ্রয় নেই। তিনি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে অপারগ। সে ক্ষেত্রে পুরোটাই নির্ভর করবে মানুষটির সহ্যক্ষমতার উপর। তিনি যত দিন সহ্য করতে পারবেন, থাকবেন। না পারলে বেরিয়ে আসবেন।’’

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
কী দেখলে সম্পর্ককে সুযোগ দিতে পারেন?
দু’টি মানুষ যখন আলাদা, তখন তাঁদের মনের অমিল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিছু কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য চূড়ান্ত অপছন্দ হওয়াও স্বাভাবিক বলে জানাচ্ছেন মনোবিদেরা। তবে একটি মানুষকে শুধু কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্টের নিরিখে ভাল বা খারাপ বলে দেগে দেওয়া ঠিক নয় বলে মনে করেন শ্রীময়ী। তিনি বলছেন, ‘‘হয়তো কিছু গুরুতর বিষয়েই মতের অমিল হচ্ছে। দেখতে হবে, বাকি ক্ষেত্রগুলিতেও কি তা-ই হচ্ছে? মিলের থেকে দু’জনের ভাবনায় অমিলই কি বেশি? যদি মিল বেশি হয়, তবে সম্পর্ককে সুযোগ দিতেই পারেন। পাশাপাশিই যাঁর সঙ্গে সম্পর্কে রয়েছেন, তাঁর মধ্যে আপনার প্রতি আবেগ, সহানুভূতি বোধ, শ্রদ্ধা রয়েছে কি না, তা-ও দেখতে হবে। যদি সঙ্গীর মধ্যে এই গুণগুলি থাকে, তা হলেও সম্পর্ককে সুযোগ দিতে পারেন।’’
আরও পড়ুন:
সম্পর্ক সুস্থ রাখার চাবি বিশ্বাসে?
কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর। মনোবিদ শ্রীময়ীও মনে করেন, সম্পর্কে সমস্ত হিসাবের ঊর্ধ্বে রয়েছে পরস্পরের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বস্ততা। এ ব্যাপারে দু’পক্ষেরই দায়িত্ব রয়েছে বলে মত তাঁর। তিনি বলছেন, ‘‘সম্পর্কে বিশ্বাস থাকা সবার আগে জরুরি। সেটিই সম্পর্কের ভিত। যদি সঙ্গীকে বিশ্বাস করতে না পারেন, যদি তিনিও আপনার নিরাপত্তার অভাববোধ দূর করতে না পারেন, তবে সম্পর্ক সাধারণত বেশি দূর এগোয় না।’’ তবে এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম রয়েছে। মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, এমন মানুষও রয়েছেন, যাঁরা সঙ্গী আস্থাভাজন নয় জেনেও সম্পর্কে থেকে গিয়েছেন। কিংবা নিয়মিত শারীরিক ভাবে নিগৃহীত হয়েও সম্পর্ক ভাঙেননি। আসলে সম্পর্ক থেকে ঠিক কী চাইছেন, সেটার উপরেও নির্ভর করবে আপনার সিদ্ধান্ত। যে ভাবনায় আপনি বিশ্বাসী, সেটিই হবে আপনার পথ প্রদর্শক।