বাবা-মায়েরা যা যা করলে শিশুর শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে। ছবি: সংগৃহীত।
মাতৃগর্ভে থাকার সময়েই শিশুর শব্দ শোনার ক্ষমতা তৈরি হয়। বাইরের জগতের কথাবার্তা বা আওয়াজ কিছু কিছু তার কানে যায়। জন্মের পর দু’মাস তার জিভের নড়াচড়া থাকে না। তার পর থেকে ধীরে ধীরে অস্পষ্ট ধ্বনি উচ্চারণ করতে শুরু করে। পাঁচ থেকে সাত মাস বয়সে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের শুরু। ছ’মাস বয়সে ধ্বনি বুঝতে পারে এবং সেগুলোকে নিজের মতো করে জুড়তে শেখে। ক্রমাগত আবোল-তাবোল শব্দ বলতে বলতে ধীরে ধীরে সঠিক শব্দ উচ্চারণ করা বা তার মানে বুঝতে পারে। তবে শিশু যাতে নতুন নতুন শব্দ শিখতে পারে ও তার অর্থভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়, সে জন্য অগ্রনী ভূমিকা নিতে হবে বাবা-মাকেই। এই বিষয়ে পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ কিছু জরুরি উপায়ের কথা বলেছেন।
শিশু প্রথমে একটি করে শব্দ বলতে শেখে। তার পর শব্দ জুড়ে জুড়ে পদগুচ্ছ বলতে শেখা, মনের ভাব আরও স্পষ্ট করে জানাতে পারে। এটি হল ‘টু ওয়ার্ড স্টেজ’ বা দুই শব্দের পর্যায়। ব্যাকরণের ধারণা তৈরি হতে অবশ্য দুই থেকে তিন বছর বয়স হতে হয়। পায়েল বলছেন, কয়েকটি উপায় আছে, যা মেনে চললে শিশু দ্রুত কথা বলা শিখবে এবং অর্থযুক্ত শব্দও বলতে পারবে।
১) প্রথম কাজ হবে শিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা। বাবা বা মাকে শিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হবে। একটি বা দুটি কথা নয়, অনর্গল কথা বলে যেতে হবে। কোনও জিনিসকে চিহ্নিত করে কথা বলা, ঘরের ছোট ছোট জিনিস, সংখ্যা চেনাতে হবে। যে জিনিসগুলি চেনালেন, পরদিন সেগুলি আবারও বলতে হবে। শিশুকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করতে হবে।
২) যদি যৌথ পরিবার হয়, তা হলে একেক জনের কথা বলার ধরন, উচ্চারণ এক এক রকম হবে। শিশু তা শুনবে ও শিখবে। যদি ছোট পরিবার হয়, যেমন বাবা, মা ও শিশু, তা হলে খুদেকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার অভ্যাস শুরু করুন। ধরুন, বাজারে যাচ্ছেন, শিশুকেও নিয়ে যান। সেখানে সে বিভিন্ন রকম কথা শুনবে। যেমন ‘সব্জি দাও’ এই কথাটি যদি কয়েকদিন শোনে, তা হলে শিখে যাবে কী ভাবে শব্দ জুড়ে বাক্য গঠন করে বলতে হবে। তেমনই দোকানে, শপিং মলে যেখানেই যান না কেন, শিশুকে নিয়ে যান এবং বিভিন্ন জিনিস দেখিয়ে সেগুলির উচ্চারণ, অর্থ শিখিয়ে দিন।
৩) অর্থযুক্ত কথা বলা শেখাতে হবে। ছোট বেলায় বাবা-মা কেবল নন, পরিচিত জনেরাও এসে শিশুর সঙ্গে আধো আধো বুলিতে কথা বলেন। পায়েল বলছেন, আধো বুলি শুনতে শুনতে তেমন উচ্চারণ শিখবে শিশু। ওকে বোঝাতে হবে কথাটা ‘গায়ি’ নয় ‘গাড়ি’। এবং গাড়ি কী, তার অর্থও স্পষ্ট করে দিতে হবে শিশুকে। এই অভ্যাস আরও ভাল হয়, শিশু যখন প্লে-স্কুলে যাওয়া শুরু করে। সেখানে অনেক রকম শব্দ শেখানো হয়। বাবা-মায়ের দায়িত্ব হল, শিশু যা শিখে আসছে সেগুলিকে নিয়ম করে বাড়িতে অভ্যাস করানো।
৪) শিশুর ‘স্ক্রিনটাইম’ কমাতে হবে। মোবাইলে কার্টুন দেখা বা টিভিতে আপনি যা দেখছেন, শিশুও যদি তাই দেখতে থাকে তা হলে বিভিন্ন রকম ‘জাঙ্ক ওয়ার্ড’ শিখে যাবে। তখন দেখবেন বার বার সেইসব জিনিসই দেখতে চাইছে, তেমন শব্দই উচ্চারণ করে মজা পাচ্ছে। তাই ছোট থেকে মোবাইল বা টিভি দেখার অভ্যাস না করে বরং বই পড়ে শোনান। দিনে চার থেকে পাঁচ রকম বই পড়ে শিশুকে শোনান ও বিষয়গুলি গল্পের মতো করে বুঝিয়ে দিন। বই পড়লে অনেক অর্থবহ ও নতুন শব্দ শিখতে পারবে শিশু। ওর শব্দভাণ্ডারও উন্নত হবে।
৫) মজার খেলা খেলুন। পায়েলের পরামর্শ, ধরুন আপনি চিকিৎসক সাজলেন, শিশু রোগী। এ বার খেলার ছলেই সহজ কিছু শব্দ শেখান। ধীরে ধীরে একটু কঠিন শব্দের দিকে যান। ওষুধ, চিকিৎসা এমন শব্দ উচ্চারণ করুন। চিকিৎসক কী ভাবে রোগী দেখেন, প্রেসক্রিপশন লেখেন, তা নাটকের মতো করে শিখিয়ে দিন শিশুকে। তা হলে বাস্তব জগতের অনেক বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করবে শিশু। একেক দিন একেক রকম খেলা খেলুন। সমাজ ও পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়গুলি নিয়েও শিশুকে ধীরে ধীরে শেখাতে শুরু করুন।
৬) শব্দ নিয়েও মজার খেলা হয়। ধরুন একটি অক্ষর বেছে নিলেন সে বাংলা হোক বা ইংরেজি। এ বার শিশুকে সেই অক্ষর দিয়ে পাঁচটি করে শব্দ বানাতে বলুন। মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতেও শব্দ শেখাতে হবে। পরদিন সেই শব্দগুলিই আবার বলুন, দেখুন শিশুর মনে আছে কি না। এইভাবে নতুন নতুন অক্ষর নিয়ে শিশুকে শব্দ তৈরির খেলা শেখান। এই পদ্ধতিতে দ্রুত শিশুর শব্দভাণ্ডার উন্নত হবে।
৭) শিশু যখন প্রি-স্কুলে যেতে শুরু করবে, তখন পড়াশোনার পাশাপাশি আবৃত্তি, নাটক শেখানোর ক্লাসেও ভর্তি করে দিন। পায়েল পরামর্শ দিচ্ছেন, শিশু কবিতা আবৃত্তি করবে, নাটকের চরিত্রগুলির সঙ্গে পরিচিত হতে হতে অর্থবহ বাক্য গঠন করাও শিখবে।
বাবা-মায়েরা যা যা মনে রাখবেন
১) পায়েল বলছেন, “অনেক বাবা-মা আছেন যাঁরা কথা কম বলেন অথবা ব্যস্ততা এতটাই বেশি যে শিশুকে সময় দিতে পারেন না। কিন্তু সন্তানের ভাষার উপর দখল যদি বাড়াতেই হয়, তা হলে বাবা-মাকেই সবচেয়ে বেশি কথা বলতে হবে শিশুর সঙ্গে। সুন্দর কথা, পরিচ্ছন্ন কথা বলতে হবে। শিশুর সামনে ঝগড়া করা বা কটূ কথা বললে সে-ও তাই শিখবে। যত বেশি গুছিয়ে কথা বলবেন, শিশুও আপনাদের দেখাদেখি তেমন করেই কথা বলবে।”
২) ধৈর্য ধরতে হবে। ধীরে ধীরে কথা বলুন। আপনার কথা বলার ধরন, উচ্চারণ, মুখ ও শরীরের অভিব্যক্তি শিশু লক্ষ্য করবে ও তাই নকল করার চেষ্টা করবে।
৩) যে কোনও জিনিসকে সুন্দর করে বর্ণনা করুন। ধরুন কোনও জায়গার ছবি দেখাচ্ছেন, তা হলে সেই জায়গার বৈশিষ্ট্য সুন্দর সুন্দর শব্দ ব্যবহার করে বর্ণনা করুন। ভাল ভাল বিশেষণ প্রয়োগ করুন, যাতে শিশু সেই শব্দগুলি শিখতে পারে। তা হলেই শিশু খুব তাড়াতাড়ি বাক্য গঠন করে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy