প্রতীকী ছবি।
শুরু করা যাক সত্তরোর্ধ্ব এক মহিলার জীবন দিয়ে। নাম নমিতা সান্যাল। বিয়ের প্রথম ১৫ বছর কেটেছে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির নির্দেশ পালন করে। সংসারের জন্য চাকরি ছেড়েছেন। নিজের বাবা-মা, বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছেন। এত কিছু করেও সুখে থাকতে পারেননি। এক সময়ে অবসাদে ভুগতে শুরু করেন। মনোরোগ চিকিৎসক, মনোবিদের সাহায্য ধীরে ধীরে সুস্থ হন। ঝগড়া করেননি তার পরও। তবে নিজের মত প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। এখনও দাম্পত্য অটুট। ৪৫ বছর ধরে কলহহীন দাম্পত্য কাটানো ঠিক হয়েছে কি না, তা নিয়ে অবশ্য ধন্দ কাটেনি।
তাঁর কথা শুনে অনেকেই বলেছেন, ঝগড়া করলে এমনটা হত না। প্রথম থেকেই ঝগড়া করতে হবে। তবেই কি না দাম্পত্য জমজমাট হবে! তাতেই তো দু’জনে সুখে থাকবেন।
সে কথা ঠিক বলেই মনে করেন বছর চল্লিশের শিক্ষক শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেন, ‘‘একটু ঝগড়া করলে মন হালকা হয়ে যায়। নিজের মনের মধ্যে দুঃখ থাকে না। আবার নতুন করে চলা যায়।’’ কিন্তু একমত নন তাঁর সহকর্মী সুদেষ্ণা দত্ত। তাঁর মতে, ঝগড়া কোনও সম্পর্কের জন্য ভাল হতে পারে না। কোনও না কোনও ক্ষতি করেই থাকে। তা সে দাম্পত্যই হোক না কেন!
তবে চারপাশে ক’জনই বা সুদেষ্ণার সঙ্গে একমত হবেন?
যে কোনও আড্ডায় কান পাতলেই শোনা যায়, দম্পতির মধ্যে কথা কাটাকাটি হবে, সেটিই তো স্বাভাবিক! অনেকেই বলে থাকেন, বিবাহিত দুই ব্যক্তির মধ্যে কত ঝগড়া হয়, তা-ই বুঝিয়ে দেবে সেই বিবাহ কতটা মজবুত।
কিন্তু সত্যি কি তা? দাম্পত্য সুখে কলহ কি আদৌ জরুরি? নানা মুণির নানা মত থাকবেই। তবে এত বিবাহিত সম্পর্ক প্রতিনিয়ত চলতে থাকা ঝগড়ার কারণে ভাঙে কেন? তা হলে কি বিয়েতে ‘ভাল ঝগড়া’ আর ‘মন্দ ঝগড়া’ বলে আলাদা কিছু হয়? তা হয় কি না, সে নিয়ে সমীক্ষা-গবেষণা কম হয়নি। তবে যে কোনও সম্পর্ক যেমন ব্যক্তিত্ব নির্ভর, বিয়েও যে তা-ই। সেটুকু মেনে নিলে বোধ হয় ঝগড়া করার চাপ খানিক কম হতে পারে। তেমনই কমতে পারে, স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর অপরাধবোধও।
তা হলে কথায় কথায় দাম্পত্য কলহকে জরুরি বলা হয় কেন?
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, কী নিয়ে ঝগড়া, কী রকম কলহ, কী ভাবে সে কলহ করা হচ্ছে— সে সবও দেখা জরুরি। এক কথায় দাম্পত্য কলহকে জরুরি বলে দেওয়া মানে বিষয়টি অতি সরল করে দেখা। তিনি বলেন, ‘‘কখনওই সম্পর্ক নিয়ে এ রকম কোনও একমাত্রিক নিদান কার্যকরী হয় বলে বিশ্বাস করি না।’’ অনুত্তমার মত, যে কোনও সম্পর্কে কিছু অস্বস্তি তৈরি হলে তা একে অপরকে জানানো জরুরি। তবে কলহের মাধ্যমে নয়। সংলাপের মাধ্যমে। অনুত্তমা বলেন, ‘‘কলহের মধ্যে একে অপরকে অসম্মান করার জায়গা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেটি নিয়মিত চলতে থাকলে কোনও সম্পর্কেরই স্বাস্থ্য ভাল থাকে না।’’ তিনি মনে করেন, লোকে যেটা বলার চেষ্টা করছে, সেটা বোধ হয় ঠিক ঝগড়া নয়, সেটা বোধ হয় একটা সংলাপ, যার মধ্যে দিয়ে মীমাংসায় পৌঁছনো যায়। সমাধানে পৌঁছনো যায়। অর্থাৎ, একে অপরে সঙ্গীকে বলেন, বলতে পারেন সেই সংলাপ বিয়ের জন্য কিংবা যে কোনও অন্তরঙ্গ সম্পর্কের জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু কলহে পরস্পরকে বিদ্ধ করার জায়গা থাকে। সংলাপের মধ্যে ‘আমি ভাল নেই’, ‘কেন ভাল নেই’, সে কথা উঠে আসে। আর কলহের মধ্যে ‘তোমার কত দোষ’, ‘তোমাকে ভাল থাকতে দেব না’ই মুখ্য হয়।
মনোবিদ দেবশীলা বসু মনে করাচ্ছেন, কোন সংলাপকে তর্ক বলব আর কোনটিকে কলহ, তা-ও ভাবার বিষয়। সাধারণ কিছু পছন্দ-অপছন্দের কথা প্রকাশ করতে গেলেও অনেক সময়ে হয়তো তর্কাতর্কি হয়। আবার তা মিটমাটও হয় সহজে। কিন্তু সংলাপ কঠিন হয়ে উঠতে পারে জীবনবোধ আলাদা হলে। কিংবা খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয়ে মতপার্থক্য হলে। তিনি বলেন, ‘‘আমার ধারণা, অনেকেই দাম্পত্যে কলহের প্রয়োজন বলে থাকেন এমন ভাবনা থেকে যে, যাঁরা দাম্পত্যে জড়িয়ে আছেন, তাঁরা তার মানে একে অপরের মতকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে মতান্তর হলে, তা নিয়ে বোঝাপড়ায় না এসে প্রতিনিয়ত ঝগড়া করা কোনও সম্পর্কের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।’’
মনোবিদদের কথাও মনে ধরতে না পারে। মনে হতেই পারে যে এত কালের কথা ভুল হয় কী করে। কিন্তু সব কথার প্রেক্ষিত থাকে। দাম্পত্য কলহকে জরুরি বলার অভ্যাস অনেক কালের। এ কথা নতুন নয়। বিবাহিত সম্পর্কে এক সময়ে স্বামী-স্ত্রীর মতের গুরুত্বের ক্ষেত্রে আরও বেশি বৈষম্য ছিল। স্ত্রীর মত প্রকাশ করার জায়গা ছিল আরও কম। তেমন সময়ে দম্পতিতে কলহের প্রসঙ্গ ওঠা মানে একটি সম্পর্কে দু’জনের কথা বলার অধিকার তৈরি হওয়াও। একে অপরকে মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়ার ইঙ্গিত ছিল এই কথার মধ্যে। পরিস্থিতি বদলেছে। তখনকার কলহের থেকে এখনকার দাম্পত্য কলহের মানেও তাই হয়তো বদলেছে। দাম্পত্যে কলহকে গুরুত্বপূর্ণ বলার আগে সে কথাও মনে রাখা জরুরি নয় কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy