চোখে চোখে...। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভার্চুয়াল শুনানিতে ‘অপার প্রেম’ দেখে বিহ্বল বাঙালি। ‘হিংসুটে’দের বানানো মিমের বন্যা বইছে। কিন্তু সত্যিই কি বাঙালি চেনে না এমন প্রেমালাপ? যুগে যুগে কি এমনই নির্বাক প্রেমের নিরুচ্চার অথচ সরব প্রকাশ হয়নি?
মফস্সলের এক কোচিং ক্লাসে একইসঙ্গে রসায়নের পাঠ নিত কিশোর-নন্দিনী। তাদের কেমিস্ট্রিতে মিল থাকলেও মনের কথা মুখে আনতে পারেনি কেউ। একদিন নন্দিনীর খাতায় নীল কালিতে কিশোর লিখে দিয়েছিল, ‘গীতবিতান ১১৪’। নন্দিনী বাড়ি গিয়ে সেই পাতা খুঁজে বের করল। রবি ঠাকুরের লেখা পড়ে রাত কেটে ভোর হয়ে গেল। ১১৪ নম্বর গান বলছে, ‘খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর, বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে, দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও, এসো দুই বাহু বাড়ায়ে।’
নির্বাক প্রেমের উত্তরে কিশোরের দেখানো রবিপথেই হেঁটেছিল নন্দিনী। পরের ক্লাসে কিশোরের ব্যাগের পাশে চিরকুট ফেলে এসেছিল— ‘গীতবিতান ৯০’। বাড়ি ফিরে রবির সুরে নন্দিনীর স্বর শুনেছিল কিশোর, ‘রূপে তোমায় ভোলাব না / ভালবাসায় ভোলাব / আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলবো না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাব।’
ছেলেমানুষি প্রেমের কথা থাক। ‘রাজনীতিক প্রেম’ নিয়ে বাঙালির আর নাক সিঁটকানোর দিন নেই। সেই জড়তা কাটিয়ে দিয়েছেন শোভন-বৈশাখী। তবে সে প্রেম অনেক সরব। তাতে নৃত্য, গীত, সোহাগ, আদালত, রাজনীতি সব মিলেমিশে রয়েছে। কেউ দোষ দেখেন, কেউ দেখতেন। এখন ঈর্ষা ছাড়া আর কিছু হয় না। অনেকেই হয়তো মনে মনে বলেন, ‘‘আজ যেমনই কাটুক, কালটা যেন ওদের মতো হয়।’’
সেই কবে নাগরিক কবিয়াল গেয়ে গিয়েছেন, ‘আমি চাই মন্ত্রীরা প্রেম করুন সকলে নিয়ম করে, আমি চাই বক্তৃতা নয় কবিতা বলুন কণ্ঠ ভরে।’
নিয়োগ দুর্নীতির ভার্চুয়াল শুনানিতে কবিতার স্বর পৌঁছে দিতে পারেননি প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কিংবা এত দিন যাঁকে শুধু ‘ঘনিষ্ঠ’ বলা হচ্ছিল, ইশারায় তাঁকে ‘আপনজনের’ স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। তবু জমে থাকা কিছু কথা ওঁরা বলে নিয়েছেন। কমপক্ষে দুই ভাললাগা মানুষ একে অপরের ভাল বা খারাপ থাকার খোঁজ নিয়েছেন। খাওয়াদাওয়ার মতো দৈনন্দিনতার খোঁজও তো প্রেমই। এটুকু খোঁজ নেওয়ার মানুষের অভাবে কতজন হেদিয়ে ওঠে। কত বিনিদ্র রজনী কেটে যায়। চুল, গোঁফ, ফতুয়া, ঠোঁট তো প্রতীকী! আসল হল খোঁজখবর।
উত্তম-সুচিত্রার এই বাংলায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর শেষ নেই। চাউনি আর ইশারা কেড়ে নেয়, ছুঁয়ে নেয় মন। জেনে নেয় মনের কথা। খোঁপার গোলাপ কত জনকে বিদ্ধ করে কলেজের নবীনবরণ থেকে সরস্বতী পুজোর পুষ্পাঞ্জলিতে। বা কনেযাত্রীর মধ্যে মিষ্টি মেয়েটিকে। তবে সিনেমার মতো সকলে লক্ষ্য স্থির রাখতে পারে না। হাওয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে গোলাপ একের বদলে অন্যের কাছে চলে যায়।
সে যাক! কিন্তু কলকাতা জানে প্রেমের জন্য কী ভাবে কাঁদতে হয়। এই শহরকে তা জানিয়েছিল প্রিয়ঙ্কা-রিজওয়ানুরের কাহিনি। সেই অকালপ্রয়াত প্রেমের জন্য মিছিল, ধর্নায় ছিলেন অধুনা কারাবাসী পার্থও। ছিলেন কলকাতা ছাড়িয়ে বাংলার মানুষ। দল-মত-পেশা-গোত্র নির্বিশেষে তাঁরা শাসকের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এক প্রেমকাহিনির নিদারুণ পরিণতি দেখে। সম্ভবত প্রেমের জন্য সেই প্রথম বাঙালি মিটিং-মিছিল-বন্ধ দেখেছিল। মোমবাতি জ্বেলেছিল ফুটপাথে।
বাঙালির সাহিত্যে, কাব্যে প্রেমের ছড়াছড়ি। সেই মঙ্গলকাব্যের সময় থেকে। মৈমনসিংহ গীতিকায় মহুয়া পালায় নদ্যার ঠাকুর প্রেম নিবেদনের সঙ্গে হুমকিও দিয়ে রেখেছিলেন, ‘কোথায় পাইবাম কলসি কইন্যা, কোথায় পাইবাম দড়ি / তুমি হও গহীন গাঙ্গ আমি ডুইব্যা মরি।’
পার্থ-অর্পিতার প্রেমালাপের মতোই ইশারার এক প্রেমালাপ ২০১৮ সালের বসন্তে আসমুদ্রহিমাচলকে এক করে দিয়েছিল। ২৬ সেকেন্ডের সেই ভিডিয়োতে সংলাপের বিন্দুবিসর্গ ছিল না। ছিল পটভূমিকায় মিষ্টি সুর আর প্রেমিক-প্রেমিকার চাহনি। একে অপরের দিকে অপলকে চেয়ে থাকা আর সঙ্গে ভ্রুকুঞ্চন। কথা না বলেও দু’জনেই যেন বলছে, ‘ইশারায় দাও গো সাড়া’। পরে জানা যায়, ভিডিয়োটি আদতে মালয়ালম ছবি ‘অরু আদর লভ’ ছবির ‘মাণিক্য মালারায়া পুভি’ গানের ক্লিপ।
অপার ভিডিয়ো ক্লিপ ছড়িয়ে পড়বে না। কারণ, ঘটনা ঘটেছে আদালতে। পার্থের টানকে কেউ ‘বুড়ো বয়সে ভিমরতি’ বা কেউ ‘বুড়ো সালিখের ঘাড়ে রোঁ’ বলতেই পারেন। কিন্তু প্রেম এ সবের তোয়াক্কা করে না। প্রেম যে অন্ধ, সে কথা তো আর অজানা নয়। ‘অপার প্রেম’ দেখাল, প্রেম মূক হলেও বধির নয় মোটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy