মা মানেই কি পারতে হবে সব? ছবি: ফ্রিপিক।
দশ হাত। কোনওটিতে ফ্রাই প্যান, যাতে রান্না হচ্ছে খাবার, কোনও হাতে ঝাড়ু বা ‘মপার’, অন্য অন্য হাতে কোথাও ঘড়ি, কোথাও হাতুড়ি-পেরেক, হ্যাঙারে ঝোলানো মোজা, ইস্তিরি, আর সঙ্গে কোলে একটি শিশু। প্রতি বছর এ রকমই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ফিরে ফিরে আসে, মাতৃদিবসে। যেখানে মায়ের তকমা ‘সুপার উওম্যান’।
ছবিটা একেবারে যে মিথ্যে, তা অবশ্য নয়। সত্যিই তো, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, যুগে যুগে মায়েদের করতে হয় সবটাই। আমার মা সব পারে। আমরাও বিশ্বাস করি সেটা, বিশ্বাস করে মায়েরাও। বা হয়তো বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই মায়েদের কাছে। তাই টেলিভিশনের পর্দায় ছোট্ট ছেলে মা-কে সব কাজ করতে দেখে বলে ওঠে, সে হতে চায় মায়ের মতো। বাড়ির বাকিরাও সায় দেয়, মা তো দশ হাতের মা দুর্গা!
কিন্তু সেই মা-ও তো আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতো করেই বড় হয়েছে। জীবনে চলার পথে অন্য সকলের মতো করেই এক একটা পাঠ শিখে নিয়েছে। তার পরেই প্রথম যখন তার মধ্যে তৈরি হয় আর একটা প্রাণ, ঠিক যখন থেকে তার শরীর-মন তৈরি হতে থাকে তার আর একটা আমি-র জন্য, হঠাৎ করে চারপাশটা কেমন যেন বদলে যায়। তার সবটা হয়ে ওঠে সন্তানের জন্য। নাওয়া-খাওয়া ভুলে, রাত জেগে, অসুখ-বিসুখ ভুলে, শখ-আহ্লাদ ফেলে সবটুকু দেওয়া সন্তানকে। মা তো হয় এমনই।
কিন্তু, তার পর থেকে মায়ের কাছে এমন প্রত্যাশাটাই যেন নিয়মে দাঁড়িয়ে যায়। তারও যে খারাপ লাগতে পারে, সে-ও যে কিছু না পারতে পারে, যেন ভুলে যায় আশপাশের সকলে। এমনটাই তো চলে আসছে দিনের পর দিন। আর তাই মা-ও ভুলে যায়, তারও কিছু শখ ছিল। অসুখ করলে যে ওষুধ খেতে হয় বা শুয়েও থাকা যায়, বাড়ির অন্যদের আগেও যে খিদে পেলে খাওয়া যায়, ভুলে যায় সে। মা ভুলে যায়, কোনও দিন রান্না করতে না পারলে বা অফিসের কাজের জন্য সন্তানকে পড়তে বসাতে না পারলে সেটা অন্যায় নয়।
আসলে মা তো তত দিনে নিজেকে রক্তমাংসের দু’হাতওয়ালা মানুষ ভাবতে ভুলেই গিয়েছে। তাকে তো তত দিনে দশ হাতের তকমা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে তত দিনে ভাবতে শেখানো হয়েছে যে, সে আসলে সব পারে। তাই বাড়ি বসে সন্তান পালন করতে গিয়ে কেউ ভাবে, সে হয়তো বাইরের জগতে যোগ্য নয়। আবার সন্তানকে বাড়িতে রেখে কাজ করতে বেরিয়ে কেউ বা ভোগে অপরাধবোধে। বাইরের কাজ স্বেচ্ছায় ছেড়ে সন্তান মানুষ করা বা বাইরে কাজ করতে যেতে সন্তানকে পরিচারিকার কাছে রাখা, কোনও সিদ্ধান্তই যে ভুল নয়, ভাবতে ভুলে যায় সে।
টালিগঞ্জের আজাদগড়ের বাসিন্দা পেশায় শিক্ষিকা মৌসুমি ঘোষের কথায়, “আমরা মাতৃদিবসে মায়ের ছবি পোস্ট করি সোশ্যাল মিডিয়ায়, উপহার দিই। কিন্তু সত্যিই কি আমাদের সমাজ সব মায়েদের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল? আমরা কি আদৌ সেই সব মায়েদের কথা ভাবি? বর্তমান যুগে একটি মেয়েকে ঘরের পাশাপাশি বাইরেও সমান তালে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। সেই সদ্য হওয়া মা, যাকে রাতের পর রাত জেগে কাটাতে হয়, আয়নার সামনে নিজেকে দেখলে দ্বিতীয় বার আর তাকাতে ইচ্ছে করে না। যারা সন্তানকে মানুষ করার মতো গুরুদায়িত্ব নিয়েছে, আদৌ কি আমরা তাদের খোঁজ রাখি? আমাদের ধারণা, মা হয়েছে মানে সে সব পারে। কিন্তু দিনের শেষে সেই মা তো অলৌকিক কোনও শক্তির অধিকারী হয় না, তারও ঘুম পায়, খিদে পায়, কখনও বা বলতে ইচ্ছে করে, ‘আর পারছি না, আর ভাল লাগছে না।’ কিন্তু দুঃখের বিষয়, একটি কানও সে সব শোনার জন্য তৈরি থাকে না। দিনের শেষে সবটাই তাকে পেরে উঠতে হয়।”
ঢাকুরিয়ার সোহিনী সরকার বললেন, “মায়েরাও কিন্তু মানুষ। তাদেরও ভাল লাগা, খারাপ লাগা আছে। কিন্তু সেটা আমরা কেউ আর ভাবি না। মা-ও যে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়, তাদেরও যে ইচ্ছে হয় নিজের হারিয়ে যাওয়া সব কিছু ফিরে পেতে, তাদেরও যে ইচ্ছে হতে পারে কিছুটা সময় নিজের মতো করে কাটাতে, সে কথা বোঝে ক’জন? কিছু কিছু মা এ সবের মাঝেই হারিয়ে যায়। যারা এই চেনা ছকের বাইরে বেরোতে পারে, তারাই আসলে জিতে যায়।”
তবে মা হলেই শুধু নয়, মা না হওয়ার সিদ্ধান্তের সামনেও কিন্তু পড়ে যায় সেই ‘চেনা ছক’। সল্টলেকের সৌমি (নাম পরিবর্তিত) বললেন, “স্বেচ্ছায় ঠিক করেছি, মা হব না। তবে তার মানে এমন নয় যে, আমি শিশুদের ভালবাসি না। মা হতে ইচ্ছে হলে এই আধুনিক যুগে দত্তক নেওয়ার পাশাপাশি সারোগেসি বা স্পার্ম ব্যাঙ্কের মতো অনেক বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজ বা চারপাশ তো চেনা ছকে বাঁধা। তাই কোনও মহিলা বিয়ে করলেই সন্তানধারণটা কেমন একটা নিয়মের মধ্যে পড়ে যায় যেন। এটি যে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, পারিপার্শ্বিক যেন তা ভুলে যায়।”
বিয়ের প্রায় পনেরো বছর পার করে চার বার আইভিএফ প্রক্রিয়ার পর যমজ সন্তানের মা দমদমের মিতালি মিত্র (নাম পরিবর্তিত)। বললেন, “প্রাকৃতিক উপায়ে মা হতে পারিনি। নানা রকম সমস্যায় ভুগে শেষমেশ আইভিএফ করানোর সিদ্ধান্ত নিই। চার বারের বার মা হতে পারি। আইভিএফের কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়াটা সহজ ছিল না। বার বার নিরাশ হতে হতে একটা সময় স্বামীকে বিবাহবিচ্ছেদের কথাও জানিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, সে-ও হয়তো তা-ই চায়। শুধু নিজের মা হতে চাওয়া নয়, চারপাশে সকলের প্রত্যাশার চোটে কেমন যেন ভুলতে বসেছিলাম, আমিও মানুষ। মা হতে না পারলে যে বিশেষ কোনও ক্ষতি হয়ে যাবে না, সমাজ এ কথা আমাদের ভাবতেই শেখায়নি।”
যাদবপুরের সাহানার কথায়, “মা হওয়া সহজ নয়, সন্তান পালন করাও সহজ নয়। কিন্তু সেই কঠিন কাজে মায়ের পাশে আদৌ ক’জন থাকে? সন্তান বড় করতে স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়তে গেলে শুনতে হয়, সন্তান ঠিক মানুষ হয়ে যাবে। অথচ, কী ভাবে হবে, সেটা ভাবার মতো কেউ থাকে না। সন্তানকে পরিচারিকার কাছে রাখলেও সেটা নিজের অপারগতা বলেই মেনে নিতে হয়। অন্তঃসত্ত্বা কর্মীকে হঠাৎই সকলের অকাজের বলে মনে হয়। মাতৃত্বকালীন ছুটিকে এখনও বহু মানুষ ‘ছুটি কাটানোই’ মনে করেন। সদ্য হওয়া মা-কে সেই ছুটির শেষে দ্রুত কাজে যোগ দিতে তাগাদা তো দেওয়া যায়, কিন্তু সেই সব তথাকথিত ‘কর্পোরেট’ অফিসে ক্রেশের কোনও ব্যবস্থা থাকে না। আসলে আমরা চাই, মা সবটা করবে। কিন্তু মা কী ভাবে করবে, তা ভেবে দেওয়ার বিশেষ কেউ থাকে না।”
তবে সময় বদলাচ্ছে। হয়তো একটু একটু করে বদলাচ্ছে মানসিকতা। বিজ্ঞাপনে তাই সন্তানের কথা ভেবে বিদেশ সফর বাতিল করতে যাওয়া মহিলা কর্মীকে বলা হয়, যে প্রশিক্ষণ সে দিতে যাচ্ছে বিদেশে, তা যেমন বাকি কর্মীরা শিখতে পারবে, তেমনই বাড়িতে সন্তান দেখভালের প্রশিক্ষণ ঠিক নিয়ে নিতে পারবেন পরিজন।
কোনও বিজ্ঞাপনে উঠে আসে— সদ্য মায়েদের কথা ভেবেই স্থির হয়েছে অফিসের মিটিংয়ের সময়। কেউ আবার সন্তানসম্ভবা চাকরিপ্রার্থীর পাশে দাঁড়ান। আন্তর্জাতিক একটি জিনিসপত্র আদানপ্রদানকারী সংস্থা তাই তাদের মাতৃদিবসের বিজ্ঞাপনে জানিয়ে দেয়, ভালবাসা সব সময় প্যাকেটবন্দি উপহারে মেলে না, মা যেমন সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানোর অজুহাত খোঁজে, সন্তানেরও মায়ের সঙ্গে সময় কাটানো দরকার। আর সেটাই সবচেয়ে সুন্দর উপহার।
তাই শুধু উপহার আর ছবিতে না বেঁধে মাতৃদিবসে মায়েদের পাশে দাঁড়ানোটা বোধহয় বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। যেন মনখারাপ হলে বলতে পারে— “মা।” বলতে পারে, “আর পারছি না!” সব না-ই পারতে পারে মা। না-ই হতে পারে দশভুজা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy