‘দাদাই’ মনোজের সঙ্গে মনীষা। ছবি: সংগৃহীত।
‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা....’
দাদাদের ফোঁটা দেওয়ার জন্য ছোটবেলায় এই ছড়া রীতিমতো মুখস্থ করতে হয়েছিল শান্তিনিকেতনে বড় হওয়া অবাঙালি সঙ্গীতশিল্পী মনীষা মুরলী নায়ারকে। কারণ, দক্ষিণী রীতিতে ভাইফোঁটা দেওয়া-নেওয়ার চল নেই। মনীষার ‘দাদাই’, সঙ্গীতশিল্পী মনোজ মুরলী নায়ারের কথায়, “আমরা যে হেতু শান্তিনিকেতনে বড় হয়েছি, তাই ভাইফোঁটা সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল। মা-বাবার ছাত্রীরা এসে আমাদের দু’ভাইকে ফোঁটা দিত। সেই দেখে আমাদের বোন, মানে মনীষাও ফোঁটা দেওয়ার বায়না জুড়ে বসে।”
জন্মসূত্রে কেরলের বাসিন্দা হলেও মা-বাবার কর্মসূত্রে তাঁদের হাত ধরে ‘লাল মাটির দেশে’ এসে পড়েছিলেন মনোজ, মনীষ এবং মনীষা মুরলী নায়ার। সেখানেই পড়াশোনা তার পর মনোজ এবং মনীষার পেশাদার গানের জগতে প্রবেশ করা। শান্তিনিকেতনে দীর্ঘ সময় কাটানোর সুবাদে বাঙালি রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে পরিচয় ছিল। ভাইফোঁটা, রাখি সবই পালন করা হত। মনোজের কথায়, “মা-বাবার ছাত্রীরা এসে আমাদের দু’ভাইকে ফোঁটা দিতেন, ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করতেন। মনীষাকে সে সব নিয়ম-কানুন শিখিয়েছিলেন ওঁরাই। কিন্তু বোনের সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল ভাইফোঁটার উপহার।”
কোথায় আরব সাগরের ধার ঘেঁষে নারকেল গাছ আর পাহাড়ঘেরা কেরল রাজ্য, আর কোথায় বীরভূমের ছোট একটি মফ্সসল-শহর বোলপুর। খাওয়াদাওয়া, রীতি-রেওয়াজ থেকে সংস্কৃতি— সবেতেই বিস্তর ফারাক। দক্ষিণী রীতির সঙ্গে জন্মসূত্রে বাঁধা পড়লেও বাঙালি ভাইফোঁটার উৎসাহে এতটুকু ভাটা পড়েনি মুরলী ভাই-বোনের। সে সময়ে প্রত্যেকের বাড়িতে আলাদা আলাদা করে ভাইফোঁটা পালনের চল শান্তিনিকেতনে ছিল না। চেনাজানা, বন্ধুবৃত্তের মধ্যে পালা করে এক-এক জনের বাড়িতে ভাইফোঁটার উৎসব পালিত হত। অদ্ভুত ভাবে বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ফোঁটা দেওয়ার রীতিও বদলে যেত। মনীষার কথায়, “কোনও বার বরণের থালায় শুধুই ধান-দূর্বা আর চন্দনের টিপ থাকত। পরের বার অন্য কারও বাড়িতে এ সবের সঙ্গে যোগ হত কাজল। কোনও বাড়িতে আবার চিরুনি। আমি কিন্তু মন দিয়ে সব দেখতাম।” উৎসব থাকলে তো খাওয়াদাওয়ার পর্বও থাকবে। তবে আজকালকার মতো এত আড়ম্বর ছিল না। চাইলেই রেস্তরাঁ থেকে ভালমন্দ খাবার আনিয়ে খাওয়া যেত না। মনীষা বলেন, “মা-কাকিমারাই বাড়িতে লুচি, মাংস আর পায়েস বানিয়ে দিতেন। নিজের দুই দাদা আর পাড়াতুতো দাদাদের নিয়ে আমাদের উদ্যাপন চলত।”
শান্তিনিকেতনের সেই অনাড়ম্বর ভাইফোঁটার উদ্যাপন বছর তিরিশ পর কতটা বদলে গেল?
সময় তো থেমে নেই। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত বদলে গিয়েছে সকলের জীবন। তাই এক শহরে থাকা সত্ত্বেও ভাইফোঁটার দিনটির গুরুত্ব মুরলী ভাই-বোনের কাছে খানিকটা হলেও ম্লান হয়েছে। ফোঁটা নেওয়ার আনন্দ এখন আর আগের মতো নেই। তবে দিনের দিন ফোঁটা না দিলেও দাদার মঙ্গলকামনায় ছোটবেলায় শেখা ছড়ার পঙ্ক্তিটি ভার্চুয়ালি মনোজকে লিখে পাঠান মনীষা। আর দু’জনের সুযোগ-সুবিধা দেখে একটা দিন জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হয়। রান্নাবাটির দিকে মনীষা খুব পটু না হলেও সে দিন দাদার জন্য ওঁর পছন্দের মুরগির কোনও পদ রাঁধেন। সঙ্গে ছোটবেলার মতো দাদা তাঁর কথা ভেবে কোনও একটি উপহার আনবেন, সে আশাও থাকে। মনীষা বলেন, “দাদা-বোনের সম্পর্ক তো আজীবনের। বছরের যে কোনও দিনেই তা উদ্যাপন করা যায়। আমার এক দাদা থাকেন কেরলে। আর এক জন এখানে। দুই দাদাকে তো একসঙ্গে পাওয়া মুশকিল। পেলে সে দিনই উদ্যাপন, সে দিনই আমার কাছে ভাইফোঁটা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy