Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
postnatal depression

নিজের সন্তানকে এ ভাবে কেন খুন করলেন মা? কী বলছেন বিশেষজ্ঞেরা

মনের কোন অবস্থা থেকে এক জন সদ্য হওয়া মা এমন নৃশংস হতে পারেন?

নিজের শিশু কন্যাকে খুনে অভিযুক্ত সন্ধ্যা মালো। —নিজস্ব চিত্র।

নিজের শিশু কন্যাকে খুনে অভিযুক্ত সন্ধ্যা মালো। —নিজস্ব চিত্র।

মনীষা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২০ ১৬:২৫
Share: Save:

আর্তনাদ রুখতে দু’মাসের শিশুকন্যার মুখে-গলায় সেলোটেপ পেঁচিয়ে দিয়েছিলেন মা। তার পর নৃশংস ভাবে খুন করে শিশুকে ম্যানহোলে ফেলেও দিয়ে এসেছিলেন তিনি। এখানেই শেষ নয়। সন্দেহ ঘোরাতে মা সন্ধ্যা মালো ফেঁদেছিলেন অপহরণের গল্প! বেলেঘাটার এই হাড় হিম করা শিশুখুনের ঘটনায় তদন্তকারীরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন অপরাধীর মনস্তত্ত্বের উপর। আপাতত এই ঘটনায় উঠে আসছে ‘পোস্টন্যাটাল ডিপ্রেশন’ তত্ত্ব।

মনের কোন অবস্থা থেকে এক জন সদ্য হওয়া মা এমন নৃশংস হতে পারেন? কী ভাবে এতটা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারেন এক জন মা, যাঁর আগে তেমন কোনও অপরাধের রেকর্ড নেই? এই ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে, পোস্টন্যাটাল তত্ত্বে সায় দিচ্ছেন মনোবিদরা। তাঁদের মতে, পোস্টন্যাটাল ডিপ্রেশন কোনও নতুন ঘটনা নয়। সকলেরই হবে, এমনটাও নয়। তবে অনেকেরই হয়। কিন্তু, তার প্রভাবে এত বড় অপরাধ করে ফেলার নজির খুব কমই রয়েছে।

এই ধরনের অপরাধপ্রবণতায় পোস্টন্যাটাল ডিপ্রেশনের চেয়েও আর একটু এগিয়ে পোস্টপার্টাম ব্লু-কেই দায়ী করছেন মনোবিদ অমিতাভ মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘‘পোস্টপার্টাম ব্লু বা পোস্টন্যাটাল ডিপ্রেশন যাই বলি না কেন, এগুলো সবই হয় মস্তিষ্কে হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য। সাধারণত প্রসবের এক মাস পর থেকেই এই পোস্টপার্টাম ব্লু দানা বাঁধে মনে। অনেকেই এর প্রভাবে প্রসবের পর নিজের পাশাপাশি সন্তানের যত্ন করা ছেড়ে দেন। ভাবতে থাকেন, এই পৃথিবীতে সন্তান ও তাঁর বেঁচে থাকা অর্থহীন। তখন সন্তানকে পৃথিবী থেকে সরাতে এতটাই বদ্ধপরিকর হন মা যে, তার জন্য যে কোনও নৃশংস পথ তিনি বেছে নিতে পারেন। অপরাধ ঢাকতেও উদ্যোগ নেন। বেলেঘাটার ঘটনাটিও এই প্রবণতার প্রমাণ। তবে এক জনের এমন মানসিকতা তৈরি হয়েছে কি না তা জানতে, তাঁর সঙ্গে চিকিৎসকের মাধ্যমে নিবিড় ভাবে বার বার কথা বলা দরকার।’’

আরও পড়ুন: একা একা খান আর হয়ে যান টানটান ছিপছিপে, বলছে গবেষণা

কেন হয় এমন?

মনোবিদদের মতে, এমনটা হওয়ার নানা কারণ থাকে। ভারতীয়দের ক্ষেত্রে মূলত যে বিষয়গুলির কারণে পোস্টন্যাটাল ডিপ্রেশন বা পোস্টপার্টেম ব্লু দেখা যায়, তা হল:

প্রথম বার মা হওয়ার সময় মাতৃত্ব নিয়ে নানা অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা থেকে সন্তানকে বোঝা মনে করেন অনেকে। মনের দিক থেকে সন্তানাকাঙ্ক্ষী না হলেও এমনটা হতে পারে। প্রথম সন্তানের জন্মের পর নানা সমস্যা বা অঘটন দেখা দিলে দ্বিতীয় বার এই প্রবণতা তৈরি হয়। সন্তানের জন্মের পর সহবাস নিয়ে উদ্বেগে থাকেন অনেকে। সেটাও ডেকে আনে এমন ডিপ্রেশন। অনেক পরিবারে পুত্রসন্তানের চাহিদা থাকে। কন্যা হলে কী কী হতে পারে তার আভাস হবু মাকে নরমে-গরমে বুঝিয়ে দিতে থাকেন পরিবারের লোকজন। অশিক্ষা থেকে এ সব চাপ এলেও এগুলোর সঙ্গে লড়ার মতো মানসিকতা থাকে না অনেকেরই। অনেকেই ভয় পান, কেউ বা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আগত সন্তানকেই এ সবের জন্য দায়ী ভাবতে থাকেন। তখন তাকে খুন করার মানসিকতা দেখা যায় অনেকের মধ্যেই। মা নিজেও অনেক সময় এতটাই পুত্র বা কন্যা সন্তানের চাহিদায় মশগুল থাকেন যে, সন্তান ইচ্ছানুয়াযায়ী না হলে তীব্র হাহাকার ঘিরে ধরে। তখনও সন্তানের প্রতি অত্যাচার বাড়তে পারে। পরিবারের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থাও এমন ডিপ্রেশনের জন্ম দিতে পারে। পারিবারিক ইতিহাসে এমন রোগের উপস্থিতি থাকলে তা-ও উস্কে দেয় অসুখের সম্ভাবনা।

বেলেঘাটার এই ঘটনাটি যদি সত্যিই এমন পোস্টন্যাটাল ডিপ্রেশনের কারণেই ঘটে থাকে, তা হলে তার উপসর্গ অনেক আগে থেকেই সন্ধ্যা মালোর মধ্যে দেখা দিয়েছিল বলে চিকিৎসকদের মত। সাধারণত এই ধরনের অসুখ এক দিনেই এতটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যায় না। তিলে তিলে বিরক্তি, ঘৃণা জমতে জমতে এমন হয়। অভিযুক্তের সঙ্গে তাঁর বাড়ির লোকজনের সঙ্গেও কথা বলা দরকার। সাধারণত এই অসুখে শিশুকে জন্ম দেওয়ার দিন ১৫ বা এক মাস পর থেকেই এর উপসর্গগুলি দেখা দেয়।

আরও পড়ুন: সংক্রামক করোনাভাইরাস নিয়ে প্রশ্নগুলির উত্তর জানেন কি? নইলে এখনই সাবধান হোন!

কী সেই উপসর্গ?

প্রেগন্যান্সির সময় যতটা মুড সুয়িং ছিল, এ বার তার পরিমাণ অনেকটা বেড়ে যায়। প্রবল বিরক্তি, অল্পেই রাগ দেখানো, জিনিসপত্র ভেঙেচুরে বা তীব্র অশান্তি করে রাগ প্রকাশ বা অযৌক্তিক ব্যবহার বাড়তে থাকে। হতাশা, ক্লান্তির সঙ্গে তীব্র অবসাদ গ্রাস করে অনেককে। সন্তানকে সহ্য করতে পারেন না এ সব থেকেই। দীর্ঘ অনিদ্রা, ভয়ে ভয়ে থাকা, সন্তানকে আদর করা থেকে বিরত থাকা এগুলো দেখেও অসুখ চেনা যায়। প্রসবের সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ৫০০ জন নতুন মায়ের মধ্যে এক জন এমন কিছু দেখতে বা শুনতে পান যা অন্য কেউ পাচ্ছেন না, অবাস্তব কিছুতে অন্ধ বিশ্বাস করতে শুরু করেন বা প্রবল উদ্যম নিয়ে ভুলভাল কাজে মেতে থাকেন। একে বলে পোস্টপার্টাম সাইকোসিস।

এমনটা রুখতে প্রথম থেকে প্রি প্রেগন্যান্সি কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন। এতে মা মাতৃত্বকে অনেক সহজ ভাবে গ্রহণ করে একে উপভোগ করতে পারেন। হবু মা-ও সন্তানকে চাইছেন কি না এটা খতিয়ে দেখাও খুব জরুরি। এ ছা়ড়া এমন রোগের উপসর্গ দেখলে মনোচিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা করলে সমস্যা মিটে যায়। এমন সময় বিপদ এড়াতে শিশুকে মায়ের থেকে দূরে রাখা উচিত।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy